মৃত পাইলটদের উপর ‘দায় ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা’! বিমান বিপর্যয়ের প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্টে উত্তরের চেয়ে প্রশ্নই উঠে এল বেশি করে

এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান বিপর্যয়ের প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসতেই দেশ জুড়ে শোরগোল পড়ে গিয়েছে। বিমানের ককপিটে বসে থাকা পাইলটদের কথোপকথনের একটি অংশ রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। উঠে এসেছে জ্বালানি সুইচ ঘিরে দুই পাইলটের মধ্যে ‘বিভ্রান্তি’র কথা। তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিমানচালকদের সংগঠন ‘এয়ারলাইন পাইলট্‌স অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া’। তাদের অভিযোগ, তদন্তের ভঙ্গি এবং অভিমুখ একতরফা ভাবে পাইলটদের ত্রুটির দিকে ইঙ্গিত করছে।

বিমান দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে তদন্তকারী সংস্থা ‘এয়ারক্রাফট অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো’ (এএআইবি)-র প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট শনিবার প্রকাশ্যে এসেছে। তাতে উঠে এসেছে, বিমানের জ্বালানি সুইচ আচমকা ‘রান’ (চালু) থেকে ‘কাটঅফ’ (বন্ধ)-এ চলে এসেছিল। কী ভাবে তা হল, সে বিষয়টি স্পষ্ট নয় এখনও। ওই সময় পাইলটদের কথোপকথনের একটি অংশও প্রকাশ্যে এসেছে। রিপোর্ট অনুসারে, পাইলটদের মধ্যে এক জন অপরকে প্রশ্ন করছেন, “কেন তুমি বন্ধ করে দিলে?” অপর জন উত্তর দেন, “আমি করিনি।” তবে কোন পাইলট কী বলেছিলেন, তা প্রাথমিক রিপোর্টে স্পষ্ট নয়।

কথোপকথনের এই অংশ ঘিরেই বিতর্ক দানা বাঁধতে শুরু করে। কী ভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বিমানের জ্বালানি সুইচ? তার কোনও উত্তর এখনও জানা যায়নি। রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিমানটি যখন গতি নিয়ে নিয়েছে, ঠিক সেই সময়ে দু’টি ইঞ্জিন মাত্র এক সেকেন্ডের ব্যবধানে পর পর বন্ধ হয়ে যায়। জ্বালানির সুইচ ‘রান’ (চালু) থেকে ‘কাটঅফ’ (বন্ধ)-এ চলে এসেছিল। কী ভাবে এক সেকেন্ডের মধ্যে জ্বালানির সুইচ ‘রান’ থেকে ‘কাটঅফ’ হয়ে যায়, তার কোনও সম্ভাবনার কথা প্রাথমিক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়নি।

১৫ পাতার প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্টে কী ঘটেছে, কী ভাবে ঘটেছে— তা নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর রয়েছে। তবে সেগুলি কেন ঘটেছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ নেই। এই নিয়ে বিভিন্ন মহলেও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বাণিজ্যিক বিমানের প্রাক্তন পাইলট তথা ইউটিউবার গৌরব তানেজা ওরফে ‘ফ্লাইং বিস্ট’ এই রিপোর্ট নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এক সমাজমাধ্যম পোস্টে তিনি লিখেছেন, “এটাই হওয়ার ছিল। মৃত পাইলটদের দিকে দায় চাপানো হচ্ছে। কারণ, তাঁরা আর ফিরে এসে নিজেদের হয়ে সাফাই দিতে পারবেন না।”

প্রশ্ন পাইলট সংগঠনের

এএআইবি-র এই রিপোর্ট নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিমানচালকদের সংগঠন ‘এয়ারলাইন পাইলট্‌স অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া’। তদন্ত প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে তারা। এক বিবৃতিতে তারা জানিয়েছে, “তদন্তের ভঙ্গি এবং অভিমুখ একতরফা ভাবে পাইলটদের ত্রুটির দিকে ইঙ্গিত করছে। আমরা আগে থেকে এমন কিছু ধরে নেওয়ার বিরোধিতা করছি। আমরা চাই একটি ন্যায্য, তথ্য-ভিত্তিক তদন্ত হোক।” তদন্ত প্রক্রিয়ায় কেন এত রাখঢাক রাখা হচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন পাইলট সংগঠনের। তাদের দাবি, এর ফলে তদন্তের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। কেন যোগ্য এবং অভিজ্ঞ পাইলটদের তদন্ত প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা হচ্ছে না, সেই প্রশ্নও তুলেছে পাইলটদের ওই সংগঠনের। কোনও স্বাক্ষরহীন একটি রিপোর্ট কী ভাবে সংবাদমাধ্যমের হাতে পৌঁছে যায়, তা নিয়েও প্রশ্ন ওই সংগঠনের।

জ্বালানি সুইচে বিভ্রান্তি

ইঞ্জিনে জ্বালানি পৌঁছোচ্ছে কি না, তা নির্ভর করে ককপিটের জ্বালানি সুইচের উপরেই। সাধারণত বিমানবন্দরে বিমান অবতরণের পর এই সুইচ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া, কোনও আপৎকালীন পরিস্থিতিতে সুইচ বন্ধ করেন পাইলটেরা। ইঞ্জিনে আগুন লাগলে এই সুইচ ব্যবহার করা হয়। তেমন কোনও পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল কি না, প্রাথমিক রিপোর্টে তার উল্লেখ নেই। বিমানটি যেখানে ভেঙে পড়েছিল, সেই দুর্ঘটনাস্থল থেকে যখন জ্বালানির দু’টি সুইচই উদ্ধার করা হয়, তখন তা চালু অবস্থাতেই ছিল।

বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, ভুলবশত পাইলট জ্বালানির সুইচ বন্ধ করে ফেলবেন, এমনটা হতে পারে না। সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে বিমান বিশেষজ্ঞ জন নান্স জানিয়েছেন, এক সেকেন্ডের ব্যবধানে দু’টি সুইচ বন্ধ হয়েছে। একটি বন্ধ করে অন্যটি বন্ধ করতে যেতে আরও বেশি সময় লাগার কথা। কোনও পাইলটই সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় এটা করবেন না। বিশেষত, যখন বিমানটি উড়তে শুরু করেছে।

নেই অন্তর্ঘাতের প্রমাণ

অহমদাবাদের বিমান দুর্ঘটনায় যে ২৬০ জন নিহত হয়েছে, তাঁদের মধ্যে দুই পাইলট সুমিত সবরওয়াল (৫৬) এবং ক্লাইভ কুন্দর (৩২)-ও রয়েছেন। সুমিতের ১৫,৬৩৮ ঘণ্টা বিমান ওড়ানোর অভিজ্ঞতা ছিল। ক্লাইভের ছিল ৩,৪০৩ ঘণ্টার অভিজ্ঞতা। তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট অনুসারে, দুই পাইলটই শারীরিক ভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন। পর্যাপ্ত বিশ্রাম পেয়েছিলেন তাঁরা। তাঁদের শারীরিক দিক থেকে কোনও ত্রুটি ছিল না। দুর্ঘটনায় প্রাথমিক ভাবে অন্তর্ঘাতের কোনও প্রমাণও মেলেনি বলেও জানিয়েছে এএআইবি। তা হলে কী কারণে জ্বালানি সুইচ ঘিরে এই বিভ্রান্ত তৈরি হল পাইলটদের মধ্যে, তা স্পষ্ট নয়।

প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্টে এ-ও বলা হয়েছে, দু’টি ইঞ্জিনই বিকল হওয়ার পরে সেগুলি পুনরায় চালু করার চেষ্টা করছিলেন পাইলটেরা। একটি ইঞ্জিন আংশিক চালু হয়েও গিয়েছিল। কিন্তু অন্য ইঞ্জিনটি কোনও ভাবেই চালু করা যায়নি। ইঞ্জিন চালু করার জন্য ‘রাম এয়ার টার্বাইন’-ও চালু করা হয়েছিল। এটি হল বিমানের মধ্যে থাকা একটি বিকল্প যন্ত্র, যা ইঞ্জিনে স্বয়ংক্রিয় ভাবে জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ (হাইড্রলিক পাওয়ার) পৌঁছে দিতে পারে।

সাবধানী কেন্দ্র

অহমদাবাদ বিমান বিপর্যয়ের প্রাথমিক রিপোর্ট নিয়ে সাবধানী কেন্দ্রীয় সরকারও। কেন্দ্রীয় অসামরিক বিমান পরিবহণমন্ত্রী কে রামমোহন নাইডু জানিয়েছেন, এখনই রিপোর্ট দেখে কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাবে না। আরও পোক্ত তথ্য প্রয়োজন বলে মনে করছেন তিনি। মন্ত্রীর কথায়, “এটির মধ্যে বিভিন্ন প্রযুক্তিগত বিষয় জড়িয়ে রয়েছে। তাই এই রিপোর্টটি সম্পর্কে এখনই মন্তব্য করা ঠিক হবে না। প্রাথমিক রিপোর্ট আমরা পেয়েছি। কিন্তু পোক্ত কিছু আসার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।” শুধু তা-ই নয়, দেশের পাইলটদের ভূয়সি প্রশংসাও করেছেন তিনি। নাইডু বলেন, “আমার বিশ্বাস, গোটা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে ভাল পাইলট এবং বিমানকর্মীরা আমাদের (ভারতের) কাছে রয়েছেন। তাঁরা হলেন অসামরিক বিমান পরিবহণের মেরুদণ্ড। তাঁরা অসামরিক বিমান পরিবহণের প্রাথমিক সম্পদ।”

অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী মুরলীধর মোহলের মুখে এর আগে শোনা গিয়েছিল নাশকতার সম্ভাবনার কথা। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। তবে শনিবার রিপোর্টটি প্রকাশ্যে আসার পরে মোহলও রিপোর্ট নিয়ে বেশ সাবধানী। এটি যে কোনও চূড়ান্ত রিপোর্ট নয়, তা স্মরণ করিয়ে দেন প্রতিমন্ত্রীও। মোহল বলেন, “চূড়ান্ত রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত আমাদের কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছানো উচিত নয়। এএআইবি একটি স্বতন্ত্র সংস্থা। তাদের কাজে মন্ত্রক কোনও হস্তক্ষেপ করে না।”

সাত বছর আগেই সতর্কবার্তা

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে আমেরিকার ফেডেরাল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ) বোয়িং ৭৩৭ জেটগুলি নিয়ে একটি উপদেশাবলি (অ্যাডভাইজ়রি) জারি করেছিল। স্পেশ্যাল এয়ারওর্দিনেস ইনফরমেশন বুলেটিন (এসএআইবি)-এ বলা হয়েছিল, বোয়িং ৭৩৭-এর কিছু বিমানে জ্বালানি নিয়ন্ত্রণকারী সুইচ ত্রুটিপূর্ণ ভাবে লাগানো হয়েছে। তাতে ‘লকিং ফিচার’ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে। তবে এটি সাধারণ একটি উপদেশাবলি ছিল। এর ফলে বোয়িংয়ের নির্দিষ্ট ওই বিমানগুলিকে ‘অসুরক্ষিত’ বলে দেগে দেওয়া হয়নি। সাধারণত বিমানের কোনও ত্রুটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে এয়ারওর্দিনেস ডিরেক্টিভ্‌স জারি করে থাকে এফএএ। তাতে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ওই ত্রুটি সংশোধনে আইনত বাধ্য থাকে। এ ক্ষেত্রে তেমন কিছু করা হয়নি। ফলে এয়ার ইন্ডিয়ার জন্যেও এই পরামর্শ মেনে বিমানের জ্বালানির সুইচ পরীক্ষা করার ক্ষেত্রে কোনও আইনগত বাধ্যবাধকতা ছিল না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.