রেওয়াজ অনুযায়ী কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক দলের রিপোর্ট করার কথা কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকে। তবে অনুদানপ্রাপ্ত বিভিন্ন প্রকল্পের নজরদারিতে এ বার পশ্চিমবঙ্গে আসা কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক দলগুলির রিপোর্ট সরাসরি পৌঁছে যেতে পারে ‘পিএমও’ বা প্রধানমন্ত্রীর দফতর পর্যন্ত! প্রশাসনিক সূত্রে এমন সম্ভাবনার কথাই শোনা যাচ্ছে। এবং অনেক প্রশাসনিক আধিকারিকের বক্তব্য অনুযায়ী এটা ‘নজিরবিহীন’।
প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের মতে, শেষ পর্যন্ত এমন ঘটনা ঘটলে ধরে নিতে হবে, গত ১০ দিনের মধ্যে পরিস্থিতির অনেকটা বদল হয়েছে। কারণ, গত ৫ অগস্ট বকেয়া-সহ বিভিন্ন প্রকল্পে বন্ধ থাকা কেন্দ্রীয় অর্থ ছেড়ে দেওয়ার আর্জি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠক হয়েছিল। ১৫ অগস্ট লালকেল্লা থেকে দুর্নীতি দমনে কড়া বার্তা দিয়েছেন মোদী। তার পরেই কেন্দ্রীয় দলগুলির তৈরি রিপোর্ট যদি প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পৌঁছয়, সেটা হবে তাৎপর্যপূর্ণ!
প্রবীণ আধিকারিকেরা জানাচ্ছেন, অতীতে প্রকল্পের খোঁজখবর নিতে আসা কেন্দ্রীয় দল রিপোর্ট জমা দিত গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকেই। কারণ, একশো দিনের কাজ, আবাস বা সড়ক যোজনা পরিচালিত হয় সেই মন্ত্রকের মাধ্যমে। আধিকারিকদের মতে, গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক প্রধানমন্ত্রীর দফতরে সেই রিপোর্ট পাঠালে কিছু বলার নেই। কিন্তু সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট পাঠানোর নজির নেই।
গত ২৫ জুলাই থেকে বাংলার ১৫টি জেলায় ভাগ হয়ে একশো দিনের কাজ, আবাস এবং সড়ক যোজনার কাজকর্ম খতিয়ে দেখছে কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক দল। জেলা-কর্তারা ইঙ্গিত পেয়েছেন, ওই সব প্রকল্পের পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট প্রধানমন্ত্রীর দফতরে সরাসরি পাঠানোর জন্য কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকদের কাছে নির্দিষ্ট বয়ান পাঠিয়েছে মন্ত্রক। সেই বয়ানেই রিপোর্ট তৈরি করতে হবে। গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের এক যুগ্মসচিব সেই সব রিপোর্ট একত্র করে চূড়ান্ত করবেন। গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক হয়ে রিপোর্ট যেতে পারে ক্যাবিনেট সচিব এবং পরে পৌঁছতে পারে প্রধানমন্ত্রীর কাছে।
রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “অতীতে অনেক বারই কেন্দ্রীয় দল এসেছে পশ্চিমবঙ্গে। তবে এ বারের মতো এত বেশি জেলায় একসঙ্গে কখনও কাজ করতে দেখা যায়নি তাদের। তা ছাড়া আগের বিভিন্ন দলে রাজ্যের অফিসার এবং ‘থার্ড পার্টি’ বা তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি থাকত। এ বার দলগুলি তৈরি হয়েছে শুধু কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের অফিসারদের নিয়ে। প্রতিটি দলে এক জন উপসচিবের নেতৃত্বে রয়েছেন এক জন প্রকল্প আধিকারিক এবং এক জন ইঞ্জিনিয়ার। যা বোঝা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর দফতরে রিপোর্ট পেশ করার জন্যই হয়তো এত উদ্যোগ।”
প্রশাসনিক কর্তাদের মতে, এ বারের কেন্দ্রীয় দলগুলির কাজের পদ্ধতিতেও পার্থক্য রয়েছে। যেমন, আগে জেলা প্রশাসনের স্থির করে দেওয়া এলাকায় ঘুরতে দেখা যেত কেন্দ্রীয় অফিসারদের। এখন একসঙ্গে এত বেশি জেলায় কেন্দ্রীয় দলগুলি নিজেদের মতো করে যাত্রাপথ স্থির করছে। এমনকি কোনও কোনও এলাকায় গাড়ি থেকে নেমে চার-পাঁচ কিলোমিটার হেঁটেও পর্যবেক্ষণ করতে দেখা যাচ্ছে তাদের। প্রকল্পের গুণমান, দাবির সঙ্গে সম্পূর্ণ হওয়া কাজ মিলিয়ে দেখা, প্রকল্পের নাম ইত্যাদি সবই খুঁটিয়ে দেখছে তারা। চোখে দেখে, ছবি তুলে জেলা সদরে ফিরে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক নথি-ফাইল মিলিয়ে দেখছে ওই সব দল। কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকদের প্রশ্নের জবাব দিতে হচ্ছে জেলা-অফিসারদেরও। এই সবই রাখা হচ্ছে জেলা-ভিত্তিক রিপোর্টে।
প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “এ বারের পর্যবেক্ষণের গুরুত্ব অনেক আগে থেকেই টের পাওয়া যাচ্ছিল। তাই একাধিক প্রকল্পের নাম বদল নিয়ে ওঠা অভিযোগ সংশোধন করতে স্থায়ী ভাবে ফেরানো হচ্ছে আসল নাম। ভুয়ো উপভোক্তা এবং কর্তব্যে গাফিলতিতে অভিযুক্ত অফিসারদের বিরুদ্ধে জিডি-এফআইআর করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে ত্রুটি সংশোধনের বার্তা রয়েছে এই সব পদক্ষেপের মধ্যে।”
একশো দিনের কাজ, আবাস এবং সড়ক যোজনা পরিচালনায় স্বচ্ছতার অভাব নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ তুলছে বিরোধী শিবির। যদিও রাজ্য সরকারের দাবি, কেন্দ্রের বেঁধে দেওয়া নিয়মবিধি মেনেই সব কিছু পরিচালিত হচ্ছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী ওই তিনটি প্রকল্প মিলিয়ে কেন্দ্রের কাছে বাংলার প্রাপ্য প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় (গ্রামীণ) বকেয়ার পরিমাণ সব চেয়ে বেশি— ৯৩২৯ কোটি টাকা। একশো দিনের কাজ প্রকল্পে বকেয়া ৬৫৬১ কোটি এবং প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনায় ২১০৫ কোটি টাকা। রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটের মুখে একশো দিনের কাজ প্রকল্পে টাকা বন্ধ হওয়ায় চাপ বেড়েছে রাজ্যের উপরে। প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকেরা জানান, সেই কারণেই জবকার্ডধারীদের বিভিন্ন দফতরের মাধ্যমে বিকল্প কাজের সুযোগ করে দিতে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৫০০ কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে রাজ্যকে। বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতিতে সেই ‘অতিরিক্ত’ খরচ দীর্ঘদিন ধরে বহন করা বেশ সমস্যার। আবার গরিবেরা বাড়ি তৈরির অনুদান না-পেলে সেটাও সরকারের উপরে চাপ তৈরি করবে।