রানাঘাট থেকে শিয়ালদহ প্রথম এসি লোকাল ট্রেনে সওয়ার হল আনন্দবাজার ডট কম! কেমন গেল আরাম-দায়ক ১০৩ মিনিট

আরে, রাজধানী যাচ্ছে, রাজধানী! সবে দমদম ছেড়েছি। সহযাত্রীদের বিস্মিত গলা কানে এল। সেটা ছাপিয়ে কানে এল, ‘‘তাতে কী! আমরা তো ওর চেয়েও ভাল ট্রেনে চড়ছি!’’ কাচের ওপারে আমাদের পাশে পাশে ডাউন রাজধানী এক্সপ্রেস ছুটছে। কখনও এগোচ্ছে, কখনও পিছোচ্ছে। লোকালের ‘স্পর্ধা’ দেখে কি রাজধানীর বাতানুকূল কামরার জানলার কাচে কেউ কেউ নাক ঠেকিয়ে দেখছিলেন? মনে হল, রাজার ঘরে যে ধন আছে, টুনির ঘরেও সে ধন আছে। তোমরা বাতানুকূল রাজধানী তো আমরাও এসি লোকাল!

রানাঘাট-শিয়ালদহ এসি লোকাল থেকে রাজধানী এক্সপ্রেস। সোমবার সকালে।

টিকিট কাউন্টারে গিয়ে প্রথম থমকালাম। আসলে আমার কথা শুনে থমকে গেলেন চশমাচোখে মাঝবয়সি মহিলা টিকিটবিক্রেতা। এসি লোকালের টিকিট চাই শুনে খানিক থতমত খেয়ে গেলেন, ‘‘অ্যাঁ? এসি লোকাল? কী ভাবে টিকিট দেব? কোথায় পাব? কিছুই তো জানি না!’’ কয়েক সেকেন্ড পরে খানিকটা ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘‘দাঁড়ান, দেখছি।’’ মিনিট পাঁচ-সাত চলে গেল। সাত-পাঁচ বুঝে, সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে, কম্পিউটারে সিস্টেম দেখে-টেখে রানাঘাট থেকে শিয়ালদহ টিকিট দিলেন মহিলা। ঘটনাচক্রে, রানাঘাট-শিয়ালদহ পুরো যাত্রাপথের জন্য ১২০ টাকা দিয়ে এসি লোকালের প্রথম টিকিটটা কাটলাম আমিই। তত ক্ষণে পিছনের লাইনে খানিকটা ভিড় হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানলাম, শিয়ালদহ পর্যন্ত এসি লোকালের মাসিক ভাড়া (মান্থলি) ২,২০০ টাকা। প্রতিদিন সকালে ৮টা ২৯ মিনিটে রানাঘাট থেকে ছাড়বে এই ট্রেন। ফিরতি ট্রেন শিয়ালদহ থেকে ছাড়বে সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিটে।

রানাঘাট জংশনের টিকিট কাউন্টার।

টিকিট পকেটে নিয়ে ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম রানাঘাট স্টেশনে। সামনেই সাড়ে ৭টার রানাঘাট-শিয়ালদহ ‘গ্যালপিং’ লোকাল (যে ট্রেন সব স্টেশনে থামে না) দাঁড়িয়ে। দরজায় চার তরুণ ঝুলছিলেন। এসি লোকালে যাবেন না? তাঁদের উত্তর, ‘‘না-না। ওই ট্রেনে কে যাবে? দরজা বন্ধ থাকবে তো! আমাদের দরজায় ঝুলতেই ভাল লাগে।’’ বোঝো কাণ্ড! টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে মোবাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে সময় কাটাচ্ছিলাম। কানে এল ক্ষীণ কণ্ঠ, ‘‘দাদা, এসি লোকাল ট্রেনের দুটো টিকিট দিন তো। শিয়ালদহ।’’ এই তো! এঁর জন্যই তো আমি দাঁড়িয়ে আছি! ভদ্রলোকের পরনে মলিন সাদা চেক শার্ট। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। সাংবাদিক শুনে এক গাল হাসলেন। এসি লোকালের টিকিট কাটলেন কেন, প্রশ্ন শুনে মধ্যবয়সি সুবোধ দে বললেন, ‘‘আমাদের তো যেতেই হবে এসি লোকালে। আমার স্ত্রীর ক্যানসার, কেমো চলছে। ওঁকে নিয়ে কলকাতায় যাচ্ছি। এত দিন ভিড় লোকালে যেতে হত। ওঁর কষ্ট হত। এতে কষ্ট কম হবে।’’

স্ত্রীর ক্যানসার। রানাঘাট স্টেশন থেকে এসি লোকালের টিকিট কাটলেন সুবোধ দে।

নতুন কনের মতো ৫ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ধীরে ধীরে এসে দাঁড়াল ট্রেন। বাইরে থেকে একেবারে এমনি লোকাল ট্রেনের মতোই দেখতে। তাতে অবশ্য কারও হেলদোল নেই। কেরামতি তো ভিতরে! দেখলাম, উল্টো দিকে থেকে প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে শান্তিপুর-শিয়ালদহ লোকাল। সামনে থিকথিকে ভিড়। যাত্রীদের উৎসুক চোখ অবশ্য ৫ নম্বরের প্ল্যাটফর্মে। কেউ ভিডিয়ো করছেন। কেউ ট্রেনটার ছবি তুলছেন। কেউ কেউ এসি লোকালের সঙ্গে নিজস্বী তুলতে ব্যস্ত। শান্তিপুর-শিয়ালদহেই উঠলেন উল্টো দিকের প্ল্যাটফর্মের প্রায় সকলে। এসি লোকালের পাশে দুয়োরানির মতো লাগছিল রোজকার আটপৌরে ট্রেনটাকে। স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়তি আরপিএফ মোতায়েন করা হয়েছিল ৫ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। মেট্রোর আদলেই পাশাপাশি দরজা খুলে গেল এসি ট্রেনের। উঠে পড়লাম। ভিতরটা অবশ্য মেট্রোর কামরার মতো নয়। এমনি ট্রেনের কামরার মতোই। ধাতব আসন। মাথার উপরে ধরার হাতল। যাত্রীরা দাঁড়িয়েও যেতে পারবেন। সাধারণ যাত্রীদের অনেকে তো বটেই, টিকিট পরীক্ষকেরাও নতুন ট্রেনের সঙ্গে নিজস্বী তুলে রাখছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন মনে হল, একবার বাড়িতে ভিডিয়ো কলও করে ফেললেন।

রানাঘাট-শিয়ালদহ এসি লোকালে। সোমবার।

রানাঘাট থেকে বারাসতের নিত্যযাত্রী দেবাশিস চট্টোপাধ্যায়। তিনিও এসি লোকালের টিকিট কাটলেন উৎসাহ নিয়ে। তবে তাঁর কারণ অন্য। এ রেলযাত্রা তাঁর কাছে ‘জয়রাইড’। বলছিলেন, ‘‘রোজ এমনি ট্রেনে যাই। এক দিন এসি লোকালে চড়ে দেখি কেমন লাগে। রোজ তো চড়তে পারব না। সেই সামর্থ্য নেই।’’ শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ প্রবীরকুমার বিশ্বাস থাকেন শিয়ালদহের কাছে লেবুতলায়। প্রতি শনিবার সকাল সাড়ে ৮টার লোকাল ধরে কলকাতা থেকে চাকদহের চেম্বারে যান। শনিবার ও রবিবার রুগী দেখে সেখানেই রাত কাটিয়ে সোমবার ফেরেন। রানাঘাট থেকে সোমবার তিনিও এসি লোকালেই চড়লেন। জানালেন, এ বার থেকে এসি ট্রেনেই সাপ্তাহিক সফরটি সারবেন। ভিড়ের কষ্টটা আর পেতে হবে না। রানাঘাট স্টেশনে আলাপ হল সিঙ্গুরের তপনকুমার রায়ের সঙ্গে। আমার মতোই ভোরবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন। নিছক প্রথম এসি লোকালে চড়বেন বলে। হুগলির ‘ন্যানো-খ্যাত’ সিঙ্গুর থেকে প্রথমে শ্যাওড়াফুলি এসেছেন। সেখান থেকে ঘাট পেরিয়ে ব্যারাকপুর। তার পরে আমার মতো উল্টোদিকের ট্রেন ধরে রানাঘাট। তপনের কথায়, ‘‘এটা আমার শখ। নতুন নতুন ট্রেনে চ়ড়তে ভালবাসি। আজ প্রথম এসি লোকাল রানাঘাট থেকে ছা়ড়বে শুনে লোভ সামলাতে পারলাম না।’’ দমদম পর্যন্ত যাবেন তিনি। ৮টা ১০ মিনিটে ঘোষণা হল, শিয়ালদহমুখী এসি লোকাল ৫ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে। প্ল্যাটফর্মে গিয়ে আলাপ হল তিন যুবকের সঙ্গে। বয়স ২০ থেকে ২৫-এর মধ্যে। তাঁরা ‘ভ্লগার’। এসি লোকালের সফর ভিডিয়োবন্দি করে রাখবেন। কোথা থেকে এসেছেন? একজনের জবাব চমকিত হলাম— রায়গঞ্জ থেকে! অর্থাৎ, উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জ। অন্য জন কলকাতার বাগুইআটির কাছে কেষ্টপুরের বাসিন্দা। তৃতীয় জনের বাড়ি অবশ্য রানাঘাটেই। প্ল্যাটফর্মে আলাপ হল মনোজ মণ্ডলের সঙ্গে। সঙ্গে স্ত্রী। স্ত্রীর কোলে তাঁদের তিন মাসের সন্তান। মনোজরা যাবেন অন্ধ্রপ্রদেশে। ব্যাগপত্র এবং একরত্তিকে নিয়ে লোকাল ট্রেনের ভিড়ে যেতে চান না। তাই একটু বেশি টাকা দিয়ে শিয়ালদহ পর্যন্ত এসি লোকালের টিকিট কেটেছেন। শালিমার থেকে অন্ধ্রের ট্রেনে উঠবেন। বললেন, ‘‘অনেক সুবিধা হল। অতটুকু বাচ্চাকে নিয়ে ওই ভিড়ে উঠতে হল না!’’ জানলার ধারে পছন্দের আসন বেছে নিয়ে বসেছিলেন টিসিএস কর্মী রিচা সেন। পাশে স্বামী। বলছিলেন, ‘‘আমার অফিস সল্টলেকে। এত দিন সাধারণ ট্রেনে যেতাম। অটো বা টোটো ধরতে হত। সপ্তাহে চার দিন অফিস যাই। এখন থেকে এসি লোকালেই যাব ঠিক করে ফেললাম।’’

(বাঁ দিক থেকে) নিত্যযাত্রী দেবাশিস চট্টোপাধ্যায়, চিকিৎসক প্রবীর কুমার বিশ্বাস এবং তপন কুমার রায়।
(বাঁ দিকে) বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। সল্টলেকের তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী রিচা সেন (ডান দিকে)।

রানাঘাট ছাড়ার পর ট্রেন থামবে চাকদহে। মেট্রোর মতোই ঘোষণা হল, ‘‘পরবর্তী স্টেশন চাকদহ। প্ল্যাটফর্ম বাঁ দিকে।’’ যেমন নৈহাটিতে প্ল্যাটফর্ম ডান দিকে। সেখানে ঘোষণা হল সেই অনুযায়ী। রানাঘাট থেকে শিয়ালদহ যাত্রাপথে দু’টি প্রান্তিক ধরে মোট স্টেশন ২৪টি। মধ্যবর্তী স্টেশন ২২টি। সব স্টেশনে অবশ্য থামবে না এই আরামের ট্রেন। থামবে মধ্যবর্তী ন’টি স্টেশনে— চাকদহ, কল্যাণী, কাঁচ়রাপাড়া, নৈহাটি, ব্যারাকপুর, খড়দহ, সোদপুর, দমদম, বিধাননগর। শেষ ‘স্টপেজ’ শিয়ালদহ। মোট সময় ১০৩ মিনিট। অর্থাৎ, ১ ঘন্টা ৪৩ মিনিট। সাধারণ ট্রেনে ১ ঘন্টা ৫১ মিনিট। প্রান্তিক স্টেশন শিয়ালদহে অবশ্য প্ল্যাটফর্ম দু’দিকেই। সেখানে সম্ভবত তাই প্ল্যাটফর্ম সংক্রান্ত ঘোষণা হল না। শুধু বলা হল, ‘‘অন্তিম স্টেশন শিয়ালদহ।’’ তার পরে দু’দিকের ‘স্লাইডিং’ দরজাই সরে গেল মসৃণ ভাবে।

রানাঘাট-শিয়ালদহ এসি লোকালের যাত্রী তিন উৎসাহী ভ্লগার। সোমবার।

পৌনে ৯টা নাগাদ টিকিট পরীক্ষা শুরু হয়েছিল। খোঁজ নিয়ে জানলাম, এই ট্রেনে কেউ টিকিট ছাড়া ওঠেনইনি। তবে বেশ কয়েক জনকে জরিমানা করা হয়েছে। কেন-কেন? টিকিট থাকলে জরিমানা কেন? আসলে তাঁদের কাছে টিকিট ছিল। তবে এসি লোকালের নয়। কেউ কেউ সাধারণ লোকালের ‘মান্থলি’ নিয়েই এসি-তে উঠে পড়েছিলেন। এসি লোকালের প্রথম জরিমানা যিনি দিলেন, তাঁর নামটা নোটবইয়ে টুকে রাখলাম— রোশন সিংহ। জরিমানা দিতে হল ২৮০ টাকা। সরকারি কর্মচারীদের একটা দল ছিল সামনের দিকের কামরায়। তাঁরা রোজ দল বেঁধে মফস্সল থেকে কলকাতায় অফিসে আসেন। আমার প্রশ্নে শুনে এক জন বললেন, ‘‘ভাড়াটা বড্ড বেশি! প্রতি দিন দেওয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া যে সময় এই ট্রেন শিয়ালদহ পৌঁছোচ্ছে, তাতে আমাদের অফিসে দেরি হয়ে যাবে।’’ তাঁর পাশ থেকে একজন হালকাচালে বললেন, ‘‘আমরা তো আর রানাঘাট অবধি মেট্রো কোনওদিন দেখতে পাব না। এটাই আমাদের মেট্রো।’’ মেট্রোই বটে। ট্রেনের একমাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত যাওয়া যায় (ভাগ্যিস! নইলে গোটা যাত্রা পথে সারা ট্রেন ঘুরে ঘুরে যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলতাম কী করে) । মেট্রোর প্রথম দিনই এসি লোকালের ‘মান্থলি’ কেটে ফেলেছেন ব্যারাকপুরের কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী মানবেন্দ্র ঘোষ। তাঁকে দেখে টিকিট পরীক্ষকও অবাক! মানবেন্দ্রই এই বাতানুকূল লোকাল ট্রেনের প্রথম নিত্যযাত্রী। সোদপুরের পর থেকে ভিড় আরও বেড়ে গেল। তবে সাধারণ ট্রেনের চেয়ে প্রত্যাশিত ভাবেই ভিড় কম। স্বস্তি বেশি। এক জন যেমন ট্রেনে বসেই স্কুলের খাতা দেখতে শুরু করে দিলেন। লোকাল ট্রেনের দরজার মতো ভিড় নেই। স্বাভাবিক। দরজার সামনে দাঁড়ানোরও প্রশ্ন নেই। ছিনতাইয়ের ভয় নেই! হাতে-হাতে মোবাইলে ক্যামেরা চালু। ট্রেনের ভিতরে ইতিউতি ঘোরাফেরা আরপিএফ জওয়ানদের। রানাঘাট থেকে ১০ জন টিকিট পরীক্ষক উঠেছিলেন। ব্যারাকপুর থেকে উঠলেন আরও ছ’জন। সব মিলিয়ে ট্রেনে ছিলেন ১৬ জন টিকিট পরীক্ষক। তাঁদের নেতা এক জন। অর্থাৎ, মোট ১৭ জন। তাঁদেরই এক জন জানালেন, এসি লোকালে টিকিট যাচাই করার কাজটা গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি দিনই কি ১৭ জন করে টিকিট পরীক্ষক থাকবেন এই ট্রেনে? জবাব এল, এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। আরও কিছু দিন যাত্রীদের ভিড় দেখে-টেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

গন্তব্য অন্ধ্রপ্রদেশ। রানাঘাট-শিয়ালদহ এসি লোকালে স্ত্রী, সন্তানের সঙ্গে শিয়ালদহের পথে মনোজ মণ্ডল। সোমবার।

ডাউন রাজধানী এবং রানাঘাট-শিয়ালদহ এসি লোকাল শিয়ালদহে ঢুকল প্রায় একই সঙ্গে। তখন ১০টা ১২ মিনিট। রাজধানী ১২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। আমাদের এসি লোকাল ৫ নম্বরে। বেরোতে বেরোতে ১২ নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকিয়ে উপেন্দ্রকিশোর রায়ের লাইনটা আবার মনে হল, ‘রাজার ঘরে যে ধন আছে, টুনির ঘরেও সে ধন আছে’।

রানাঘাট স্টেশনে ছবি তোলার হিড়িক। সোমবার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.