কামারপুকুর আমার কাছে এক অপূর্ব ঐশী ক্ষেত্র। কারণ পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ দেবের জন্মস্থান। একটি গানের কলি, “মানিক রাজার আম্র কাননে/কে ওই শিশু খেলে ফুল্ল আননে” — এই যে লীলা অভিনয় কামারপুকুরকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হয়েছে, হিয়া শিহরিত করার মতোই ব্যাপার! ঠাকুর মর্ত্যে এসেছেন (১৮৩৬) মেকলে সাহেবের অভিসন্ধি (১৮৩৫)-কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, তাঁর বিবেক-বৈরাগ্য ঝুলি দুই কাঁধে ঝুলিয়ে। আমি রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনে আশ্রমিক হিসাবে থাকবার সময় ঠাকুরের গানগুলি প্রেয়ার হলে সকলের সঙ্গে গাইতাম, আর মনে মনে আঁকতে চাইতাম আনন্দঘন দিনগুলির কাল্পনিক ছবি! মনে হতো আমিও গদাই-এর নিত্যসাথী, আমিও বিরাটের এক অতিক্ষুদ্র লীলা-বালক! আজ বুঝি সেই খেলার সময় এলো! যখন মানিক রাজার এবং গদাধরের স্মৃতিধন্য বাগানটি নতুন করে গড়ে তুলতে হবে, এমন প্রস্তাব দিলেন কামারপুকুর রামকৃষ্ণ মঠ কর্তৃপক্ষ। ২০১৯ সালের ৫ ই জানুয়ারি ওই বাগানের ভিত্তি-প্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল। তারপর থেকে নিয়মিত সেই ভূ-খণ্ডে যাওয়া-আসা, তদারকি, আলোচনা এবং বাগান গড়ে তোলার কাজ। আম বাগানের জমিতে জরিপে নামলাম, মনে হচ্ছিল, অতলকে মাপছি। এ যে কত তল, বোঝাই কী করে! শ্রীরামকৃষ্ণদেব কী এভাবেই খেলবার সাধ পূর্ণ করবেন আমার?
মানিক রাজার আম বাগানটি নতুন করে গড়া হয়েছিল, ২০১৯ সালের ৪ ঠা জুলাই। ওই দিন শুভারম্ভ এই ঐশী উদ্যানের। শুভ উদ্বোধন হবে, তারই চূড়ান্ত প্রস্তুতি চলছে। কামারপুকুর রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের আয়োজনে, প্রযুক্তিগত সহায়তা বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল গবেষণা কেন্দ্রের দুই বিজ্ঞানীর, তারই সঙ্গী রহড়া বালকাশ্রমের কিছু প্রাক্তন ছাত্র, আমার ডাকে এসেছেন পুণ্যপরশ পাবেন বলে। উদ্বোধন করলেন রামকৃষ্ণ মঠের তদানীন্তন ট্রাস্টি, রামকৃষ্ণ মিশনের পরিচালন সমিতির সদস্য তথা কাঁকুড়গাছি যোগদ্যান রামকৃষ্ণ মঠের অধ্যক্ষ স্বামী বিমলাত্মানন্দজী মহারাজ। উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল কামারপুকুর মঠের অধ্যক্ষ স্বামী লোকোত্তরানন্দজী মহারাজের। কামারপুকুর রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অধীনে এই বাগানটির পরবর্তী পরিচর্যা এবং তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন আশ্রমের সন্ন্যাসী মহারাজেরা।

সেদিন ২৯ এপ্রিল, ২০১৯। বিকেল বেলা। কামারপুকুর রামকৃষ্ণ মঠে উপস্থিত হয়েছি। দাঁড়িয়ে আছি শ্রীরামকৃষ্ণ দেবের নিজের হাতে লাগানো আম গাছের তলায়। সঙ্গে রয়েছেন বাগান দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত শ্রদ্ধেয় সুকুমার মহারাজ এবং আমার সহকর্মী অধ্যাপক দিলীপ কুমার মিশ্র। পাশেই মন্দির। ঠাকুরের ইচ্ছে…..আমি সেই অসীমকালে প্রসারিত সঙ্গীত ধ্বনিতে সঙ্গত করি। জীবনে অনেকবার ভেবেছি, যদি শ্রীরামকৃষ্ণের সময় জন্মাতে পারতুম! যদি সমকালের লীলাসাক্ষী হতে পারতুম! বেশ হতো, জীবন ধন্য হোত। তখন কি ছিলুম এই জগতে? কামারপুকুর গ্রামে? দক্ষিণেশ্বরেও কি আমার চিহ্নই আছে! “হয়তো মানুষ নয় শঙ্খচিলের বেশে/ হয়তো বা ভোরের কাক হয়ে।” ঠাকুর আবার ডেকে পাঠিয়েছেন, হয়তো আজ গভীর রাতে বলবেন সে কথা। তাই কান পেতে শুনছি, “আজি শুভদিনে পিতার ভবনে অমৃতসদনে/ চলো যাই”। অন্তরে মোর ঠাকুর আসুন নেমে!
শ্রীরামকৃষ্ণ আম খেতে পছন্দ করতেন। তিনি নিজের হাতে লাগিয়েছিলেন বীজের থেকে তৈরি চারা। আজ তা মহীরূহ হয়ে রয়েছে কামারপুকুর মঠ ও মিশনের মন্দিরের গায়েই। অনেক ডালপালা ছাঁটতে হয়েছে মন্দিরের প্রয়োজনে, তবুও তার স্নিগ্ধ ছায়ায় আজও ভক্তের প্রাণে বয়ে আনে ঐশী চেতনা। লকডাইনের সময় ফোনেই মহারাজদের জানিয়ে দিতে হয়েছে, কখন কী কীটনাশক/ছত্রাকনাশক/অনুখাদ্য ও হর্মোন জাতীয় রসায়ন দিতে হবে, দিতে হবে সেচ।
মানিকরাজার আমবাগানে প্রযুক্তি এবং চারা দিয়ে সহযোগিতা করেছে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল গবেষণা কেন্দ্র। মোট ২৪ টি জাতের ৭২ টি আমের গাছ লাগানো হয়েছে পুরো বাগানটি জুড়ে। সবই কলমের চারা। বাগান তৈরি হবার পর নিয়মিত গেলেও, করোনা পরিস্থিতিতে ভার্চুয়ালি পরামর্শ দিতে হত। ২০২০ সালে মুকুল এলো প্রায় সব ক’টি চারায়। গাছের বৃদ্ধি বাড়াতে প্রথম বছর মুকুল ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দিলাম। অবশ্য কয়েকটি গাছে কিছু মুকুল রাখা হল। ২০২০ সাল থেকেই বাগানের ফল পাওয়া যাচ্ছে এবং তা মন্দিরে ঠাকুকে ভোগ দেওয়া হচ্ছে। ২০২১ সালে বাগান থেকে সবজাত মিলে তিনশো টির মতো পাকা ফল চয়ন করা হয়েছিল। ২০২২ সালে আরও ভালো মুকুল ভালো এলো। আমের সঙ্গে সাথি ফসল হিসাবে বারোমাস নানান সব্জি নেওয়া হচ্ছে। বাগানে খেলে বেড়াচ্ছে গদাধর প্রকল্পের স্থানীয় শিশুরা। তারা পুষ্টি, শিক্ষা এবং সনাতনী সংস্কৃতির পরশ পায় মঠ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। ২০২৫ সালেও দারুণ মুকুল।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।
