মাংসাশী ছিল না লম্বা গলার ডাইনোসরেরা! জীবাশ্ম পরীক্ষা করে এই প্রথম মিলল প্রমাণ

‘ল্যান্ড বিফোর টাইম’ কার্টুনে এক চরিত্র ছিল, নাম তার ‘লিটলফুট’। লম্বা গলার এই ডাইনোসর খেত শুধু ঘাস, পাতা। তৃণভোজী ডাইনোসর দেখা গিয়েছে ‘জুরাসিক পার্ক’ ছবিতেও। কিন্তু এ সবই ছিল জল্পনাকল্পনা। কারণ, লম্বা গলার ‘সরোপড’ ডাইনোসরেরা তৃণভোজী— এ কথা বিজ্ঞানীরা কয়েক দশক আগে খাতায়কলমে ঘোষণা করে দিলেও এ পর্যন্ত তার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ মেলেনি। মেলেনি জীবাশ্মও। এত দিনে সেই প্রমাণ মিলল অস্ট্রেলিয়ার কুইন্‌সল্যান্ডে।

সোমবার ‘কারেন্ট বায়োলজি’ জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় এই যুক্তির সমর্থনে প্রথম সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। কুইন্‌সল্যান্ডে এক সরোপডের পেটে মিলেছে উদ্ভিদের আকারের জীবাশ্ম, যা থেকেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন গবেষকেরা। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, ১৩ কোটি বছর ধরে পৃথিবী জুড়ে দাপিয়ে বে়ড়ানো সরোপডের জীবাশ্ম এর আগেও বহু বার পাওয়া গিয়েছে। এদের মধ্যে মাংসাশীদের তুলনায় তৃণভোজীদের সংখ্যাই বেশি। সরোপডেরা ছিল মূলত চারপেয়ে বিশালাকার ডাইনোসর, যাদের দেহের চেয়ে গলা আর লেজ ছিল বেশি লম্বা। পার্থের কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ান অর্গ্যানিক অ্যান্ড আইসোটোপ জিওকেমিস্ট্রি সেন্টারের ডেপুটি ডিরেক্টর তথা জীবাশ্মবিদ স্টিফেন পোরোপাট সংবাদমাধ্যম ‘নিউইয়র্ক টাইম্স’কে বলছেন, ‘‘এদের ছোট ছোট ভোঁতা দাঁত এবং বিশাল বপু শিকার তাড়া করার জন্য জুতসই ছিল না। অগত্যা উদ্ভিদই ছিল এক মাত্র বিকল্প।’’

স্টিফেনের কথায়, এটিই কোনও সরোপড ডাইনোসরের পেটে পাওয়া প্রথম প্রত্যক্ষ প্রমাণ, যা এর আগে কখনও পাওয়া যায়নি। ২০১৭ সালে কুইন্‌সল্যান্ডে খননকার্য চালিয়ে ওই জীবাশ্মটি পাওয়া যায়। কোরফিল্ডের ‘অস্ট্রেলিয়ান এজ অফ ডাইনোসর্‌স মিউজিয়াম’-এর বিজ্ঞানীদের একটি দলের সঙ্গে সেই খননকার্যে গিয়েছিলেন স্টিফেনও। সেখানেই প্রায় ৩৬ ফুট লম্বা একটি কিশোর ডায়ম্যান্টিনাসরাস ম্যাটিল্ডাই-এর জীবাশ্ম মেলে, যা সরোপড গোষ্ঠীভুক্ত। ওই জাদুঘরের সহ-প্রতিষ্ঠাতা জুডি এলিয়টের নামে তার ডাকনাম দেওয়া হয় ‘জুডি’। এ পর্যন্ত সব রুটিনমাফিকই চলছিল। কিন্তু আচমকা অদ্ভুত এক জিনিস দেখে থমকে যান বিজ্ঞানীরা। দেখা যায়, সরোপডের অন্ত্রের সঙ্গে লেপ্টে রয়েছে উদ্ভিদের জীবাশ্মের একটি স্তর!

স্টিফেন বলেন, ‘‘আমরা জানতাম আমরা ব্যতিক্রমী কিছু খুঁজে পেয়েছি, কিন্তু আমরা তাড়াহুড়ো করে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে চাইছিলাম না।’’ অন্ত্রের ভিতরের উপাদান জীবাশ্মে পরিণত হওয়ার ঘটনা এমনিতেই বিরল, একে ‘কোলোলাইট’ বলা হয়। বিশেষত তৃণভোজী ডাইনোসরদের ক্ষেত্রে এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা আরওই ক্ষীণ। কারণ, মাংসাশী প্রাণীদের পাকস্থলীতে হাড় যে ভাবে যুগ যুগ ধরে সংরক্ষিত হয়, তৃণভোজীদের ক্ষেত্রে উদ্ভিদজাত খাদ্য সে ভাবে হয় না।

আবার, ওই ঘাসপাতাগুলি যে পরে ‘জুডি’র অন্ত্রের পাশে জীবাশ্মে পরিণত হয়ে থাকতে পারে, সেই সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছিল না। তবে ওই গোটা এলাকায় আর কোথাও সে রকম গাছপালা দেখা যায়নি। তা ছাড়া, পাতাগুলির কয়েকটি ‘জুডি’র জীবাশ্মীভূত ত্বকের স্তরের সঙ্গে এমন ভাবে মিলেমিশে গিয়েছিল যে শেষমেশ বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতে বাধ্য হন, ঘাসপাতাগুলি আসলে ছিল ‘জুডি’র পাকস্থলীতেই। গবেষকেরা জীবাশ্ম হয়ে যাওয়া ঘাসপাতার ভর বিশ্লেষণ করে দেখেন, ওগুলি মূলত ‘আণবিক জীবাশ্ম’। জীবাশ্মে একই সঙ্গে নানা যৌগের উপস্থিতি এও ইঙ্গিত দেয় যে, ‘জুডি’র অন্ত্রে থাকা পাতাগুলি আলাদা আলাদা উদ্ভিদ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর মধ্যে যেমন লম্বা পাইনজাতীয় (কনিফেরাস) গাছের পাতা ছিল, তেমনই ছিল মাটির কাছাকাছি বেড়ে ওঠা গুল্মজাতীয় ফুলগাছও। ফলে ‘জুডি’র কোলোলাইট থেকে কেবলমাত্র লম্বা গলার ডাইনোসরেরা কী খেত তা-ই নয়, বরং কী ভাবে খেত, সে সম্পর্কেও সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। বেশির ভাগ ঘাসপাতাই মিলেছে প্রায় অবিকৃত অবস্থায়। এর থেকে প্রমাণ হয়, সরোপডেরা তেমন ভাবে চিবিয়ে খাবার খেত না। বরং সামনে উদ্ভিদজাতীয় যা পেত, তা-ই গিলে ফেলত তারা! তার পর সপ্তাহ দুয়েক ধরে বাকি কাজ করত তাদের অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়াগুলি। পাচনের পর খাদ্যের অবশিষ্টাংশ স্বাভাবিক নিয়মেই মল হয়ে বেরিয়ে যেত শরীর থেকে।

তবে দুনিয়া-কাঁপানো অসংখ্য লম্বা গলার ডাইনোসরদের মধ্যে ‘জুডি’ একা একজন! ফলে এই একটিমাত্র জীবাশ্মের ভিত্তিতে সামগ্রিক ভাবে সরোপোড ডাইনোসরদের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে ধারণা করে ফেলা যুক্তিযুক্ত নয়। সে কথা মানছেন বিজ্ঞানীরাও। তাই প্রাগৈতিহাসিক ওই প্রাণীদের জীবনচরিত নিয়ে এখনও চলছে বিস্তর গবেষণা। তবে আপাতত ভরসা ‘জুডি’ই। আর তাতে এত বছর পরে যদি প্রমাণ হয়, ভয়ানক চেহারার বিশালদেহী সরোপডেরা আসলে ছিল গোবেচারা তৃণভোজী, সেই বা কম কী?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.