কার্গিলে ক্লিন্টনের পরে এ বার ট্রাম্প, ভারত-পাক সংঘর্ষবিরতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল আমেরিকার ভূমিকা, অনুঘটক আর কী কী?

আড়াই দশক পরে আবার আমেরিকার মধ্যস্থতার সংঘর্ষবিরতি হল ভারত-পাকিস্তানের। ১৯৯৯ সালের ৫ জুলাই তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের সঙ্গে ওয়াশিংটনে গিয়ে বৈঠক করার পরে কার্গিল-দ্রাস-বাটালিক থেকে নিঃশর্তে সেনা প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। এ বার ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষবিরতির কথা ঘোষণা করে দিলেন।

ঘটনাচক্রে, ইসলামাবাদের ‘কুর্সি’ এখন নওয়াজের ভাই শাহবাজের দখলে। আর কার্গিল যুদ্ধের সময় প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন প্রয়াত অটলবিহারী বাজপেয়ীর দলীয় উত্তরসূরি নরেন্দ্র মোদী গত ১১ বছর ধরে ভারতে ক্ষমতায়। কিন্তু এ বার যুযুধান দু’পক্ষের কেউ নন, শনিবার সন্ধ্যায় গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়ে প্রথম সংঘর্ষবিরতির কথা ঘোষণা করলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট স্বয়ং। নিজের সমাজমাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ একটি পোস্ট করে ট্রাম্প লেখেন, ‘‘আমেরিকার মধ্যস্থতায় রাতভর (আমেরিকার হিসাবে) আলোচনার পর, আমি আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করছি, যে ভারত এবং পাকিস্তান অবিলম্বে পূর্ণ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।’’

এর পরেই ভারত এবং পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে স্বাগত জানিয়ে ট্রাম্পের মন্তব্য, ‘‘বাস্তবজ্ঞান এবং অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার সদ্ব্যবহার করার জন্য দুই দেশকে অভিনন্দন। এই বিষয়ে (যুদ্ধবিরতি) মনোযোগ দেওয়ার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ!’’ ট্রাম্পের ওই পোস্টের পরে পাক উপপ্রধানমন্ত্রী তথা বিদেশমন্ত্রী মহম্মদ ইশাক দারও যুদ্ধবিরতি নিয়ে নয়াদিল্লি-ইসলামাবাদ ঐকমত্যের কথা জানান। তিনি বলেন, ‘‘আংশিক নয়, দিল্লি এবং ইসলামাবাদ পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।’’

মার্কিন বিদেশসচিব মার্কো রুবিয়োও শনিবার সন্ধ্যায় ওয়াশিংটনের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির কথা জানিয়ে এক্স পোস্টে লেখেন, ‘‘ভান্স (মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট) এবং আমি গত ৪৮ ঘণ্টা ধরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং শাহবাজ শরিফ, ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, পাক সেনাপ্রধান আসিম মুনির এবং ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল এবং আসিম মালিক (আইএসআই প্রধান)-সহ ঊর্ধ্বতন ভারতীয় ও পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি।’’ তারই পরিণতিতে সংঘর্ষবিরতি হয়েছে বলে জানান তিনি।

যদিও শনিবার রাতেও কাশ্মীরের শ্রীনগর উপত্যকায় বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গিয়েছে।

‘মার্কিন মধ্যস্থতা’ উহ্য রেখে বার্তা দিল্লির

ওয়াশিংটনের মধ্যস্থতার কথা সরাসরি স্বীকার না করলেও ট্রাম্পের ঘোষণার পরেই যুদ্ধবিরতির বার্তা দেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। সমাজমাধ্যমে তিনি লেখেন, “আজ ভারত এবং পাকিস্তান সামরিক অভিযান এবং গোলাগুলি বন্ধ করার বিষয়ে একটি বোঝাপড়ায় এসেছে।” একই সঙ্গে তিনি লেখেন, “ভারত ধারাবাহিক ভাবে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় এবং আপসহীন অবস্থান নিয়ে এসেছে। এটি বজায় থাকবে।”

এক ধাপ এগিয়ে বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রী দাবি করেন, নয়াদিল্লি-ইসলামাবাদ সামরিক স্তরের আলোচনাই সংঘর্ষবিরতির অনুঘটক হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘শনিবার দুপুর ৩টে ৩৫ মিনিটে ভারতীয় সেনার ডিরেক্টর জেনারেল মিলিটারি অপারেশনস (ডিজিএমও)-কে ফোন করেছিলেন পাকিস্তান সেনার ডিরেক্টর জেনারেল মিলিটারি অপারেশনস (ডিজিএমও)। তার পর দু’পক্ষই গোলাগুলি এবং সামরিক অভিযান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়।’’

ভূমিকায় ৩৬, দাবি ইসলামাবাদের

ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষবিরতি কার্যকর করতে ৩৬টি দেশ সক্রিয় ভাবে আলোচনা প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিল বলে শনিবার সন্ধ্যায় দাবি করেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী তথা বিদেশমন্ত্রী ইশাক। পাক সংবাদমাধ্যম জিও নিউজ়কে ইশাক বলেন, “তিন ডজন দেশ সক্রিয় কূটনীতিতে যুক্ত ছিল।” মার্কিন বিদেশসচিব মার্কো রুবিও ছা়ড়াও সৌদি আরব এবং তুরস্কও অস্ত্রবিরতি সংক্রান্ত আলোচনায় জড়িত ছিল বলে দাবি পাক বিদেশমন্ত্রীর।

ঘটনাচক্রে, ভারতীয় সেনার অপারেশন সিঁদুর ঘিরে সংঘাতের আবহে পূর্বঘোষিত সফরসূচি ছাড়াই বৃহস্পতিবার দিল্লিতে এসেছিল সৌদি আরবের বিদেশ প্রতিমন্ত্রী আদেল আল-জুবের। জয়শঙ্করের সঙ্গে নিভৃত বৈঠকও করেন পশ্চিম এশিয়ায় আমেরিকার প্রধান বন্ধুরাষ্ট্রের মন্ত্রী। ঈশাক শনিবার ব্রিটেনের কূটনৈতিক সক্রিয়তার কথাও বলেন। শনিবার সকালে ব্রিটেনের বিদেশসচিব ডেভিড ল্যামির সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে বলেও জানান। পাশাপাশি, দ্বিপাক্ষিক ডিজিএমও স্তরের বৈঠকের মাধ্যমে সংঘর্ষবিরতির সিদ্ধান্তের দাবি করে পাক উপপ্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা (ভারত এবং পাকিস্তান) যৌথ ভাবে (অস্ত্রবিরতিতে) সম্মত হয়েছি, তবে এই দেশগুলিও যুক্ত ছিল।”

সামরিক সংঘাতের পথ ছেড়ে আলোচনার টেবিলে বসার জন্য ভারত এবং পাকিস্তানের কাছে শনিবার আবেদন জানায় চিনও। চিনা বিদেশ দফতরের তরফে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘আমরা দু’পক্ষের কাছে শান্তি ও স্থিতিশীলতার বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করার, ধৈর্য ও সংযম প্রদর্শন করার এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে রাজনৈতিক সমাধানের পথে ফিরে আসার আবেদন করছি। উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে এমন কোনও পদক্ষেপ থেকে বিরত আহ্বান জানাচ্ছি।’’ সীমান্তে তৈরি হওয়া সংঘাতের আবহ নয়াদিল্লি এবং ইসলামাবাদ, কারও পক্ষেই লাভজনক হতে পারে না-জানিয়ে চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সরকার বলেছে, ‘‘ভারত এবং পাকিস্তান দু’দেশের মৌলিক স্বার্থের জন্যই একটি সুস্থিত এবং শান্তিপূর্ণ অঞ্চল প্রয়োজন।’’ প্রসঙ্গত, গত ২২ এপ্রিলের পহেলগাঁও হত্যাকাণ্ডের জবাবে মঙ্গলবার পাক অধিকৃত কাশ্মীর এবং পাক পঞ্জাবের ন’টি জঙ্গিডেরায় ভারতীয় সেনার অপারেশন সিঁদুরের পরে প্রকাশ্যে ইসলামাবাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল বেজিং।

মার্কিন মধ্যস্থতার ইঙ্গিত ছিল আগেই

পহেলগাঁও কাণ্ডের চার দিন পরে গত ২৬ এপ্রিল আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রথম প্রতিক্রিয়া জানয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘একটি খারাপ ঘটনা ঘটেছে।’’ কিন্তু পহেলগাঁও-পরবর্তী পর্যায়ে ভারত-পাক সীমান্ত এবং জম্মু ও কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখায় (এলওসি) উত্তেজনা যে তাঁর কাছে অস্বাভাবিক কিছু নয়, সে কথাও স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন ট্রাম্প। তাঁর কথায়, ‘‘বহু বছর ধরে সীমান্তে উত্তেজনা রয়েছে। তারাই (ভারত এবং পাকিস্তান) কোনও না কোনও ভাবে বিষয়টির সমাধান করবে। আমি নিশ্চিত।’’

প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের কথা বহুল প্রচারিত হলেও শাহবাজ়ও যে তাঁর ঘনিষ্ঠ, সে কথাও সে দিন স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘‘দুই নেতাকেই আমি দীর্ঘ দিন ধরে চিনি। আপনারা জানেন, আমি ভারতের খুব কাছের। আমি পাকিস্তানেরও খুব কাছের।’’ এর পরে গত ৬ মে রাতে পাক অধিকৃত কাশ্মীর এবং পাক পঞ্জাব প্রদেশের ন’টি জঙ্গিডেরায় ভারতীয় সেনার অপারেশন সিঁদুরের পর ট্রাম্প সরাসরি বিষয়টিকে ‘লজ্জাজনক’ বলেছিলেন। পাশাপাশি, দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের সংঘাত থামানোর জন্য মধ্যস্থতার বার্তা দিয়েছিলেন তিনি।

যদিও এর পরে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স কিছুটা অবস্থান বদলে বলেছিলেন, ‘‘আমেরিকা ভারতীয়দের তাদের অস্ত্র সংবরণের নির্দেশ দিতে পারে না। আমরা পাকিস্তানিদের তাদের অস্ত্র জমা দিতে বলতে পারি না। তাই আমরা কূটনৈতিক পথ অনুসরণ করব।’’ কূটনীতিকদের একাংশ মনে করেছিলেন, গাজ়া এবং ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর ক্ষেত্রে অতিসক্রিয়তায় কাজ না-হওয়াতেই দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে ধীরে চলো নীতি নিতে চাইছে ওয়াশিংটন। ভান্সের কথায় সেই ইঙ্গিত দেখেছিলেন তাঁরা। কিন্তু মার্কিন বিদেশসচিব রুবিয়ো শনিবার স্পষ্ট করে দিয়েছেন, দক্ষিণ এশিয়ার দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের সংঘাত নিয়ন্ত্রণে ধারাবাহিক ভাবে সক্রিয় ছিল ওভাল অফিস।

আইএমএফের ঋণে কোন বার্তা?

ভারতের আপত্তি উপেক্ষা করেই শুক্রবার পাকিস্তানকে প্রায় ১০০ কোটি মার্কিন ডলার (প্রায় ৮০০০ কোটি টাকা) অতিরিক্ত ঋণ মঞ্জুর করে আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার (আইএমএফ)। ভারত আইএমএফের ঋণ সংক্রান্ত বোর্ডের বৈঠকে ভোটদানে বিরত ছিল। নয়াদিল্লির তরফে জানানো হয়, এর আগে ঋণের টাকার সদ্ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘খারাপ ট্র্যাক রেকর্ড’ রয়েছে পাকিস্তানের।

আইএমএফের নিয়ম অনুযায়ী, ভোটাভুটির ক্ষেত্রে বিরোধিতার কোনও সুযোগ নেই। অর্থাৎ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেওয়া যায় না। হয় সমর্থন করতে হবে নয়তো ভোটদানে বিরত থাকতে হবে। পাকিস্তানকে ঋণ মঞ্জুর না করার সপক্ষে ভারতের জোরালো যুক্তি থাকলেও ভোটাভুটিতে বিপক্ষে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। তাই ওয়াশিংটনে আইএমএফের ঋণ সংক্রান্ত বোর্ডের বৈঠকে ভোটদানে বিরত থেকেই প্রতিবাদ জানায় মোদী সরকার। ঘটনাচক্রে, আইএমএফে আমেরিকার অংশীদারি ১৬ শতাংশ। সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রশ্নে তাদের ভূমিকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

পহেলগাঁও হত্যাকাণ্ডের পরে আমেরিকা, ব্রিটেন-সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ঘটনার তীব্র নিন্দা করলেও সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করেনি। ৬ মে পাক জঙ্গিঘাঁটিতে ভারতীয় সেনার আকাশ-হানার পরে এক মাত্র ইজ়রায়েল ছাড়া প্রকাশ্যে কোনও দেশ নয়াদিল্লির পদক্ষেপকে সমর্থন জানায়নি। বুধবার সীমান্তে সংঘাতের আবহে ট্রাম্প বলেছিলেন, “আমি দু’দেশকে (ভারত এবং পাকিস্তান) নিয়েই চলতে পারি। আমি ওদের খুব ভাল করে জানি। আমি চাই তারা থামুক। আশা করি তারা এখন থামতে পারবে।” শেষ পর্যন্ত শনিবার বিকেলে পূর্ণ হল তাঁর আশা।

শনিবার রাতে ফের বিস্ফোরণের শব্দ

অস্ত্রবিরতির জন্য ভারত এবং পাকিস্তান সম্মত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরেই ফের কাশ্মীরের শ্রীনগর উপত্যকায় বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। প্রথমে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানায়, জম্মু শহরে বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গিয়েছে। কিছু ক্ষণের মধ্যে জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা সমাজমাধ্যমে জানান, তিনিও শ্রীনগরে বিস্ফোরণের শব্দ পেয়েছেন। অস্ত্রবিরতির কী হল, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শনিবার রাতে জম্মু ও কাশ্মীরের উধমপুর, কাঠুয়া, জম্মু-সহ বেশ কিছু শহরে ব্ল্যাকআউট করে দেওয়া হয়। পাশাপাশি রাজস্থানের বারমেঢ়, জৈসলমের এবং পঞ্জাবের ফিরোজ়পুর, পঠানকোট, মোগায় ব্ল্যাকআউট করে দেওয়া হয়। গুজরাতের পুলিশমন্ত্রী হর্ষ সঙ্ঘভি সমাজমাধ্যমে লিখেন, কচ্ছ জেলায় কিছু ড্রোন দেখা গিয়েছে। ওই এলাকাতেও ব্ল্যাকআউটের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.