মোদীর মঞ্চে অবন ঠাকুরের আঁকা ভারতমাতার ছবি! ভাষণে বাংলা-বাঙালি নিয়ে মমতার অভিযোগের জবাব

ভোটের দামামা আলিপুরদুয়ারের সভা থেকেই মাস দেড়েক আগেই বাজিয়ে গিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। এ বার দুর্গাপুরের মঞ্চ থেকে বলে দিয়ে গেলেন প্রতিপক্ষ তৃণমূলকে মোকাবিলার ভাষ্য। ২০২৬ সালের ভোটের আগে বাঙালি অস্মিতাকে বিজেপির বিরুদ্ধে বড় ‘হাতিয়ার’ করে তোলার যে কৌশল বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়েছেন, শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী মোদী সব রকম ভাবে সেই কৌশলের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করলেন। আর যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বাঙালি অস্মিতা নিয়ে মোদী কথা বললেন, সেই মঞ্চকে বঙ্গ বিজেপি আগে থেকে সাজিয়ে রাখল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ভারতমাতার ছবি দিয়ে। গাঁদা বা গোলাপে নয়, প্রধানমন্ত্রীকে বঙ্গ বিজেপি বরণ করল রজনীগন্ধার মালা দিয়ে। শিল্পায়ন, নারী নিরাপত্তা, সিন্ডিকেট রাজ, আইনশৃঙ্খলা, অনুপ্রবেশ— সব বিষয়ই ঘুরেফিরে প্রধানমন্ত্রীর মুখে শোনা গেল। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে শোনা গেল বাঙালিয়ানার বন্দনা। কর্মী-সমর্থকদের ‘জয় শ্রীরাম’ ছাপিয়ে শোনা গেল মোদীর ‘জয় মা কালী, জয় মা দুর্গা’।

গত বেশ কিছু দিন ধরে বিজেপি শাসিত বিভিন্ন রাজ্যে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের হেনস্থা, ধরপাকড়ের ঘটনা প্রকাশ্যে আসছে। এই বিষয়কে কেন্দ্র করে তৃণমূলনেত্রী মমতা বিজেপি বিরোধী কণ্ঠস্বর তুঙ্গে তুলছেন। মমতা এবং তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় পদযাত্রা এবং সংক্ষিপ্ত সভাও করেছেন। প্রধানমন্ত্রী মোদী শুক্রবার দুর্গাপুর থেকে সেই আক্রমণ সামলাতেই সবচেয়ে বেশি সময় নিলেন। ৩৬ মিনিটের ভাষণের এক তৃতীয়াংশ জুড়ে বললেন বাংলার অস্মিতার কথা, বাঙালির সম্মানের কথা এবং বাংলার সংস্কৃতির প্রতি বিজেপির শ্রদ্ধার কথা।

শুধুমাত্র মমতার আক্রমণের জবাব দিয়েই মোদী ‘বাঙালি অস্মিতার প্রতি সম্মান’ জানানোর চেষ্টা করেছেন, এমনটা নয়। সভার ব্যবস্থাপনা থেকে মঞ্চসজ্জা, সব কিছুতেই বাঙালিয়ানা বোঝানোর ‘সযত্ন প্রয়াস’ দেখা গিয়েছে মোদীর সভায়। তাঁর রাজনৈতিক সভার মঞ্চে প্রথামতোই ভারতমাতার ছবি রাখা ছিল। কিন্তু গোটা দেশে বিজেপি ভারতমাতার যে ছবি ব্যবহার করে, দুর্গাপুরের সভামঞ্চে সেই ছবি ছিল না। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা গেরুয়া বসনধারী, চতুর্ভুজা যে ভারতমাতার ছবি বাঙালির কাছে পরিচিত, মোদীর সভামঞ্চে সেই ছবিই রাখা হয়েছিল।

বিজেপির নতুন রাজ্য সভাপতি হিসাবে শমীক ভট্টাচার্যের নাম ঘোষণার মঞ্চে কালীঘাটের কালীমূর্তির ছবি যেমন অনেকের নজর কেড়েছিল, শুক্রবার মোদীর মঞ্চে অবন ঠাকুরের আঁকা ভারতমাতার ছবিও সে ভাবেই আলাদা করে চোখে পড়েছে। মোদী নিজের ভাষণ শুরুও করেছেন ‘জয় মা কালী, জয় মা দুর্গা’ বলে, যা শক্তিপুজোয় অভ্যস্ত হিন্দু বাঙালির সবচেয়ে পরিচিত ধর্মীয় ধ্বনি। সভার আমন্ত্রণপত্রেও ‘জয় মা কালী, জয় মা দুর্গা’ লেখা ছিল। ভাষণে প্রায় প্রত্যেক প্রসঙ্গের শেষেই এক-দু’লাইন বাংলা বাক্য শোনা গিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর মুখে। বলেছেন, ‘‘বাংলা পরিবর্তন চায়। বাংলা উন্নয়ন চায়।’’

মোদীর ভাষণে উঠে এসেছে কবি বিষ্ণু দে-র নাম। ঘটনাচক্রে, শুক্রবার অর্থাৎ ১৮ জুলাই কবি বিষ্ণু দে-র জন্মদিন। ভাষণে সে কথাও উল্লেখ করেন মোদী। আরজি করে মহিলা চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুনের ঘটনা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে টেনে এনেছেন আর এক কৃতী বাঙালি কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা, যিনি পাশ্চাত্য চিকিৎসাশাস্ত্রে শিক্ষিত প্রথম বাঙালি মহিলা চিকিৎসক। ঘটনাচক্রে, শুক্রবার তাঁরও জন্মদিন।

Narendra Modi gives answer to Mamata Banerjee’s accusation on Bengali Men being forced to Bangladesh

মোদী মনে করিয়ে দেন যে, তাঁর সরকারই বাংলা ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দিয়েছে। মোদীর কথায়, ‘‘বিজেপি এমন এক দল, যার বীজ বাংলায় অঙ্কুরিত হয়েছে।’’ বিজেপির পূর্বসূরি জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সূত্র ধরেই মোদীর এই মন্তব্য। শ্যামাপ্রসাদের দেখানো পথেই যে বিজেপি অটল, সে কথা স্মরণ করিয়ে মোদী বলেন, ‘‘বাংলা অস্মিতা বিজেপির জন্য সবার উপরে। যতগুলি রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় রয়েছে, সর্বত্র বাঙালিদের জন্য সর্বোচ্চ সম্মান রয়েছে।’’

তৃণমূল বাঙালি অস্মিতা এবং বাংলার সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে চাইছে বলে অভিযোগ করেছেন মোদী। তিনি বলেন, ‘‘তৃণমূল বাংলার পরিচয় বদলে দিচ্ছে। অনুপ্রবেশকারীদের জন্য তারা ভুয়ো নথি তৈরি করছে। তৃণমূল যা করছে, তা দেশের পক্ষে বিপদ। বাংলার সংস্কৃতির জন্য বিপদ।’’

দিল্লি, পঞ্জাব, তামিলনাড়ু, কেরল, মহারাষ্ট্র, ছত্তীসগঢ়, ওড়িশা-সহ বিভিন্ন রাজ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে বাংলাভাষীদের হেনস্থা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলে সরব হয়েছে তৃণমূল। দিল্লিতে তৃণমূল সাংসদদের নেতৃত্বে এ নিয়ে ধর্নাও হয়েছে। তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র বিষয়টিকে আদালত পর্যন্তও টেনে নিয়ে গিয়েছেন। তৃণমূলের এই ‘সক্রিয়তা’কে আক্রমণ করে মোদী বলেন, ‘‘আসল রূপ প্রকাশ্যে এসে যাওয়ার পর তৃণমূল অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বাঁচাতে সরাসরি মাঠে নেমে পড়েছে।’’

অবৈধ অনুপ্রবেশ সংক্রান্ত টানাপড়েনে কেন্দ্র যে পিছু হটবে না, সে কথা দুর্গাপুরের মঞ্চ থেকে স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন মোদী। তিনি বলেছেন, ‘‘ভাল করে শুনে নিন, যে ভারতের নাগরিক নয়, যে অনুপ্রবেশ করেছে, তার সঙ্গে ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী ন্যায়সঙ্গত পদক্ষেপই করা হবে। বাংলার অস্মিতার আঘাত লাগে, এমন কিছু বিজেপি হতে দেবে না। এটা মোদীর গ্যারান্টি।’’

মোদীর মন্তব্যের পাল্টা জবাব দিয়েছে তৃণমূলও। শাসকদলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ এক্স হ্যান্ডলে লি‌খেছেন, ‘‘সত্যের অপলাপ, মিথ্যার প্রয়োগ, তথ্যবিকৃতি, মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা। কেন্দ্রের জমানায় বেকার বাড়ছে। বিজেপিশাসিত রাজ্যে দুর্নীতি, নারী নির্যাতন, অপশাসন। কেন্দ্রের বৈষম্য সত্ত্বেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বাংলা এগিয়ে। কেন্দ্রের রিপোর্ট, নীতি আয়োগের রিপোর্টেও স্পষ্ট। শিল্প থেকে কর্মসংস্থান, বাংলা উন্নতি করছে।’’ শাসকদলের দাবি, মোদীর এমন সভার পর এ রাজ্যে বিজেপি ৪০টি আসনও পাবে না।

শুক্রবার মোদীর সভার কয়েক ঘণ্টা আগে থেকে দুর্গাপুরে প্রবল বৃষ্টি হয়েছে। সভাস্থলে জলও জমে গিয়েছিল। নেহরু স্টেডিয়ামমুখী রাস্তায় ধসও নামে। ঘটনাচক্রে, অন্ডাল বিমানবন্দর থেকে প্রধানমন্ত্রী সভাস্থলে যাওয়ার পথে বিজেপি রোড শোয়ের মতো ব্যবস্থাপনা রাখবে বলে স্থির করেছিল। তা আর হয়নি। মোদীর যাত্রাপথে শেষ তিন কিলোমিটারে, রাস্তার দু’ধারে বিজেপি কর্মীদের জমায়েত থাকার কথা ছিল। সেই পরিকল্পনা ভেস্তে গিয়েছে। তবে জলকাদার মাঝেও সভাস্থলে জমায়েতের চেহারা দেখে বিজেপি নেতৃত্ব স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। শিল্পনগরীর সভামঞ্চ থেকে প্রধানমন্ত্রী বাংলার শিল্পের পুনরুজ্জীবনের বার্তা দিয়ে গিয়েছেন। বাংলার তথা ভারতের শিল্প এবং আর্থিক ক্ষেত্রের উন্নয়নে শ্যামাপ্রসাদ, বিধানচন্দ্র রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর, স্যর বীরেন মুখোপাধ্যায়দের ভূমিকার কথাও দুর্গাপুরে গ়ড়গড় করে বলে গিয়েছেন মোদী। তার পরেই বলেছেন, ‘‘আগেই সকলে বাংলায় ব্যবসার জন্য, কাজের জন্য আসতেন। এখন পুরো পরিস্থিতি উল্টে গিয়েছে। এখন এখান থেকে সকলে কাজের খোঁজে বাইরে চলে যাচ্ছে।’’

পশ্চিমবঙ্গের এই পরিস্থিতি বদল ঘটানো সম্ভব এবং বিজেপি রাজ্যে ক্ষমতায় এলেই এক বছরের মধ্যে বাংলার পরিস্থিতি বদলে যাবে বলে মোদী আশ্বাস দেন। দুর্গাপুরের মঞ্চ থেকে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসবাণী, ‘‘এক বার বিজেপিকে সুযোগ দিন। বিকশিত বাংলা মোদীর গ্যারান্টি, বিজেপির সংকল্প।’’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.