প্রয়াগরাজে ৪২ ঘণ্টা! ধর্ম নয়, পুণ্যও নয়, মানুষের মিলনমেলায় এক পাত্রে গোটা ভারত

কুম্ভ নিয়ে আগ্রহ আচমকাই তৈরি হয়েছিল। কিন্তু যাব কী ভাবে! কোথাও টিকিট নেই! না ট্রেন, না প্লেন। প্রয়াগরাজে বহু বিমান যাচ্ছে। তা-ও টিকিট পাচ্ছিলাম না! টিকিটের দামও আকাশছোঁয়া। শেষে ট্রাভেল এজেন্টকে বললাম, চেষ্টা করে দেখুন। যদি কেউ টিকিট বাতিল করে! যদি বিড়ালের ভাগ্যে কোনও ভাবে শিকে ছেঁড়ে! শেষে রবিবার বেলার দিকে ফোন এল। টিকিট হয়েছে। এক সহকর্মী ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে সোমবার সকালে আমার টিকিট পাকা! ফোনে ট্রাভেল এজেন্টের সাবধানবাণী ভেসে এল, ‘‘এয়ারপোর্টে একটু আগে পৌঁছবেন।’’

বাবা-মা শিবের উপাসক। আমার নামে তাই শিবের ‘ছোঁয়া’ রেখেছেন তাঁরা। ভাই শিবপ্রতিমের তা-ই। যদিও আমি কোনও কালেই ধার্মিক নই। কিন্তু কুম্ভ নিয়ে উৎসাহটা তৈরি হয়ে গেল! এত মানুষ যাচ্ছেন। স্নান করছেন। ছবি দেখে মুগ্ধ হচ্ছি আর ভাবছি, এক বার নিজের চোখে এই মহা মিলনমেলাটা দেখা যায় না?

বিমান ছাড়বে সকাল সাড়ে ৮টায়। বাড়ি থেকে বেরোলাম ভোর সাড়ে ৫টায়। বিমানবন্দরে গিয়ে বুঝলাম, কেন ট্রাভেল এজেন্ট আগে পৌঁছে যেতে বলেছিলেন। রানওয়েতে যে বাস পৌঁছে দিল, সেটাই একটা ‘মিনি ভারত’। বেশির ভাগই অবাঙালি। সকলের পোশাকেই নানা রঙের ছোঁয়া। হঠাৎ কানে এল, ‘‘কী রে? তোরাও যাচ্ছিস? কবে দেশে ফিরলি?’’ দু’জোড়া বাঙালি দম্পতির কথাবার্তায় বুঝলাম, ওঁরা কাতার থেকে এসেছেন। আরও পরে আসার কথা ছিল। কিন্তু কুম্ভে যাবেন বলে মাসখানেক আগেই দেশে ফিরেছেন। যাচ্ছেন আমাদের সঙ্গেই। শুধু কাতার? কাতারে কাতারে মানুষ! দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রয়াগরাজের দিকে চলেছেন তাঁরা। তারই একটা ছোট সংস্করণ আমাদের বিমান। যার পেটে ভরা বিহার, উত্তর-পূর্ব ভারত, ওড়িশা। সকলেই চলেছেন প্রয়াগরাজের মহাকুম্ভে।

ঠিক ৭০ মিনিট পরে নামলাম প্রয়াগরাজ বিমানবন্দরে। ছোটখাটো চেহারা। কুম্ভ উপলক্ষে সাজানো হয়েছে ফুল দিয়ে। বাইরে বেরোতেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল রঙে। সকালের প্রয়াগরাজ যে কী রঙিন! বিমানবন্দরে আমাদের নিতে এসেছেন ঋষভ জয়সওয়াল। আগামী ৪২ ঘণ্টা আমরা তাঁরই অতিথি। আদতে ট্রাকের ব্যবসা। কিন্তু নিজের ছোট গাড়ি নিয়ে আমাদের নিতে এসেছেন। ওঁর বাড়িতেই আমরা উঠব। ‘গ্রিন করিডর’ করে দিয়েছে পুলিশ। তাতেও রক্ষা নেই। স্থানীয় বাসিন্দা ঋষভ ট্রাফিকের হালহকিকত ভাল জানেন। এ-গলি সে-গলি, এ-রাস্তা ও-রাস্তা পেরিয়ে ঘণ্টা দেড়েক পরে পৌঁছলাম ঋষভের মহল্লায়। আসতে আসতে মনে হচ্ছিল বারাণসীর কথা। গলি থেকে তস্য গলি, প্লাস্টারহীন দেওয়াল। পৌঁছে যে আতিথেয়তা পেলাম, তাতে অভিভূত হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। ওঁদের বাড়ির ঘরগুলো দেখে মনে হয়েছিল, এখানে থাকব কী করে! নড়াচড়ারই তো জায়গা নেই। কিন্তু স্রেফ আতিথেয়তার মুগ্ধতাই আমাদের রেখে দিল।

নাম ‘রসগুল্লা’! দেখতে গোলাপজামের মতো। একটু চ্যাপ্টা। কয়েকটা ‘রসগুল্লা’ মুখে চালান করে একটু বিশ্রাম। সাড়ে ১২টা নাগাদ ঋষভ আমাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর সঙ্গমে স্নান করতে যাব। গন্তব্য ‘বোট হাউস’। প্রয়াগরাজের অসংখ্য ঘাটের মধ্যে এটা একটা। রাস্তায় প্রচুর গাড়ি। কিন্তু পুলিশের দক্ষতা দেখার মতো। কখন কোন রাস্তা খুলবে, কখন বন্ধ রাখা হবে— একেবারে ‘রিয়েল টাইম ম্যানেজমেন্ট’। ‘বোট হাউস’ পৌঁছে অন্য ছবি। তিরতিরে দুলুনি খাওয়া জল। তাতে ভাসছে অজস্র নৌকা। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উড়ে, জল ছুঁয়ে, নদীতে ভেসে সাদা রঙের ‘ব্ল্যাক হেডেড গাল’ আর ‘ব্রাউন হেডেড গাল’-এর সারি!

জল ছুঁয়ে, নদীতে ভেসে সাদা রঙের ‘ব্ল্যাক হেডেড গাল’ আর ‘ব্রাউন হেডেড গাল’-এর সারি!

নৌকায় উঠতে হল দর কষাকষি করে। প্রথমে দর ছিল মাথাপিছু ৫ হাজার টাকা! সেটা এসে দাঁড়াল জনপ্রতি ১,৫০০ টাকায়। উঠে পড়লাম। পাশাপাশি আরও নৌকা। যমুনার বাঁ-পাশ ঘেঁষে একের পর এক ঘাট পেরিয়ে যাচ্ছি। সঙ্গে পাখিদের সারি। জলেই ভাসছে ওদের খাবার বিক্রি করার নৌকা। পাওয়া যাচ্ছে নিমকির মতো ‘কটকটি’। অনেকে কিনে পাখিদের খাওয়াচ্ছেন। নৌকায় এসে, দাঁড়ে বসে আবার কখনও উড়তে উড়তেই হাত থেকে খাবার নিয়ে যাচ্ছে ওরা।

From Kolkata to Kumbh Mela: sudden journey of a corporate lady with her unknown crowd of believers

বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর স্পিড বোট কড়া নজরদারি নিয়ে ছুটে যাচ্ছে এ-পাশ থেকে ও-পাশ। রয়েছে নদীর জল পরিষ্কার করার যন্ত্রও। প্রতিনিয়ত সেই যন্ত্র কাজ করে যাচ্ছে। পাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাশি রাশি মানুষ। পোশাকের রং হলুদ বা গেরুয়া। যেন ‘বসন্ত সেনা’। রয়েছেন সাধুরাও। এক বার যমুনার জলে হাত দিলাম। ঠান্ডা। কিন্তু মাথার উপর কটকটে রোদ।

From Kolkata to Kumbh Mela: sudden journey of a corporate lady with her unknown crowd of believers

পৌঁছলাম সঙ্গমে। ফাইবার বা প্লাস্টিক জাতীয় কিছু ভাসমান বস্তু দিয়ে তৈরি করা হয়েছে একটা চাতাল। নৌকা গিয়ে ভিড়ল তারই কাছাকাছি। আমাদের সামনে আরও তিনটে নৌকা। আমাদের নম্বর চার। মাঝি বললেন, ‘‘উঠে পড়ুন। ওই নৌকাগুলো পেরিয়েই আপনাদের হেঁটে যেতে হবে।’’ ভাসমান চাতালে উঠে দেখি, বহু মানুষ। তাঁরা এক এক করে চাতাল থেকে নেমে যাওয়া স্টিলের সিঁড়ি দিয়ে জলে নামছেন। স্নান করছেন। আবার উঠে আসছেন ওই পথেই। চাতালেই রয়েছে ভেজা পোশাক বদলানোর জায়গা। সকাল থেকে শহরটা দেখে মনে মনে পরিচ্ছন্নতার জন্য দশে-দশ দিয়েছিলাম। এখানে একটু নম্বর কমে গেল। দেখলাম, অনেকে স্নান করার পর ভেজা পোশাক ছেড়ে চাতালেই রেখে যাচ্ছেন। সেগুলো আর সাফাই হচ্ছে না।

From Kolkata to Kumbh Mela: sudden journey of a corporate lady with her unknown crowd of believers

তবে বহু মানুষের সঙ্গে ডুব দিয়ে স্নান করে ভিতরে ভিতরে একটা পবিত্রতার বোধ কাজ করছিল। দেখলাম, শান্ত পরিবেশ তো বটেই, মানুষজনের আচরণও মনটা শান্ত করে দিয়েছে। ভাবছিলাম, এই তা হলে সেই ‘শাহী স্নান’! যার জন্য এত দূর আসা! স্নান সেরে ওঠার পরে কপালে চওড়া করে চন্দন লেপে দেওয়া হচ্ছে। সঙ্গে লাল তিলক। দেখলাম, নদীর তিলক এক রকমের। রাস্তার অন্য রকম। রাস্তা দিয়ে গেলে তিলকের ‘স্টাইল’ পাল্টে যাচ্ছে। সেখানে চওড়া চন্দনের সঙ্গে নানা কিছু লেখা তিলক পরানো হচ্ছে।

কৌতূহল হচ্ছিল। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত নদীতে যাঁরা নৌকা চালান, তাঁদের সকলেরই লাইসেন্স আছে। বছরের অন্য সময়ে এঁরা অন্যান্য কাজকর্ম করেন। ঠিক যেমন শহরের পথে পথে যাঁরা ভ্যান রিকশা নিয়ে ঘুরছেন, তাঁদেরও অন্য পেশা আছে। যে মেয়েটি একটা ছোট্ট তাঁবু নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে মহিলাদের পোশাক বদলাতে সাহায্য করবে বলে, সে তার মহল্লায় বাবার মুদির দোকানে কাজ করে। যে তরুণ নৌকায় পাখিদের খাবার ফেরি করছিলেন, তিনি বছরের বাকি সময়ে সব্জির দোকানদার। যিনি তিলক পরাচ্ছিলেন, তিনি সারা বছর কাজ করেন হনুমান মন্দির চত্বরে।

আবার ঋষভের ডেরায় ফিরলাম। তত ক্ষণে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। কিন্তু খিদে কি আর দুপুর-বিকেল মানে! সঙ্গমের তিন কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে কোথাও কোনও আমিষ খাবার পাওয়া যায় না। সব নিরামিষ। ঋষভের বোন সযত্নে খাওয়ালেন ভাত, রুটি, পালং-আলু, স্যালাড আর পাঁপড়।

খেয়েদেয়ে বেরিয়ে পড়লাম মেলা দেখতে। মানুষের মেলা। এটাও সঙ্গমের দিকেই। তবে হণ্টন। হাঁটছি তো হাঁটছিই। এটা মেলা চত্বরে দেখলাম অযোধ্যার রাম মন্দিরের অনুকরণে মন্দির। কিন্তু দেখে কে বলবে, আসল নয়। পরিষ্কার রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে লাখো মানুষ। হনুমান মন্দিরের কাছাকাছি পৌঁছে হঠাৎ শিহরণ হল! মন্দিরটা একটু উঁচুতে। দেখলাম, সেখান থেকে একটা স্রোত নেমে আসছে। আলো-আধাঁরির মধ্যে সেই স্রোতটাকে হু-হু করে গড়িয়ে নীচে নামতে দেখে ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম! তার পর অনুভব করলাম, ওটা জনস্রোত। আমরাও সেই স্রোতেরই একটা অংশ। আমরাও সেই স্রোতেই গা ভাসিয়ে এগোচ্ছি। কিন্তু কোনও হুজ্জুতি নেই। অশান্তি নেই। কারও সঙ্গে কারও ঝুটঝামেলা নেই। ঝগড়া নেই। একে অপরকে ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে যাওয়া নেই। দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, কুম্ভ এমন এক মেলা, যেখানে ‘প্রাডা’ বা ‘গুচি’ পরেও লোকে মাটিতে থেবড়ে বসে পড়ছেন। তাঁরাও সাধারণের সঙ্গে হাঁটছেন, কথা বলছেন, এগিয়ে চলেছেন। রেস্তরাঁয় যেমন দেখেছি নাক পর্যন্ত ঘোমটা টানা বিহারি বধূকে, তেমনই রাস্তায় দেখেছি পাগড়ি পরে ঘুরে বেড়ানো রাজস্থানের যুবককে। মধ্যপ্রদেশের নম্বরের একটা বোলেরো গাড়ি। পিছনের অংশে দুটো থাক। যেন দোতলা গাড়ি। উপরে পুরুষেরা। নীচে মহিলারা। আশ্চর্যের আরও বাকি ছিল। উপর থেকে নীচে এমন ভাবে দড়ি দিয়ে বাঁধা, যাতে কেউ গাড়ি থেকে যেন পড়ে না যান। কোথাও কোনও বিরোধ নেই। বিবিধের মাঝে এই মিলন কুম্ভেই সম্ভব।

রাতে খেলাম একটা রেস্তরাঁয়। নিরামিষ। পর দিন গোটা প্রয়াগরাজটা ঘুরে দেখব বলে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু মনে হল, আর এক বার সঙ্গমে যাই। আবার ‘বোট হাউস’ ঘাট। আবার নৌকা। আবার সঙ্গম। সকালে ভিড়টা একটু বেশি মনে হল। মনে হল, সকাল আর বিকেলের তফাতে প্রশান্তিরও কয়েক গুণ তফাত হয়। শহর ঘুরে দেখলাম, কুম্ভ উপলক্ষে গোটা প্রয়াগরাজটাই রঙিন। স্কুলপড়ুয়া থেকে শিল্পী— সকলে মিলে নানা রকমের ছবিতে ভরিয়ে দিয়েছেন গোটা শহরটা। ধর্ম নয়, একটা শিল্পই যেন আদর করছে প্রয়াগরাজকে। সহিষ্ণুতার শিল্প। সহাবস্থানের শিল্প। রঙের শিল্প।

রাতে ফিরলাম ঋষভের বাড়িতে। ফেরার উড়ান রাত তিনটেয়। বেরিয়ে পড়লাম মাঝরাতেই। অত রাতেও রাস্তায় ভিড়। সেই ভিড়, সেই অনুশাসন, সেই শৃঙ্খলা।

কলকাতায় ফিরে মনে হচ্ছিল, ছোট ছোট দৃশ্য। ছোট ছোট মুহূর্ত। সেগুলোই মিলেমিশে ‘মিনি ভারতবর্ষ’। মেলায় গিয়ে বুঝলাম, এই হল ভারতবর্ষ। নানা ধরনের মানুষ। নানা রঙের সমাহার। নানা ধরনের খাবারদাবার। আর ভাষা? থাক সে কথা! মনে হচ্ছিল, চেখে নিতে চেয়েছিলাম এই ভারতকেই।

ফৌজি পরিবারে জন্ম আমার। বাবার চাকরির সুবাদে গোটা ভারত ঘুরে বেড়িয়েছি। থেকেছি। কিন্তু সে সব ছিল খণ্ডচিত্র। কুম্ভে এসে গোটা ভারতকে একটা পাত্রে দেখতে পেলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.