একটি মেয়ে। ৩৭ বছর বয়স। এখন সে পরিণত , এটা বুঝতে পারার জন্য যে, মাত্র ৬ মাস বয়সে যখন সে মাতৃহারা হয়েছিল , যখন তার মা’র ৩১ বছর বয়স কি মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে কষ্ট পাচ্ছিল। তার মা মুক্তি পেতে চেয়েছিল আর শাস্তিও দিতে চেয়েছিল সেই দেশের সবথেকে শক্তিশালী মানুষ টি কে। সেই মানুষটি তার নিজের বাবা।
দেশের সবথেকে শক্তিশালী মানুষ হতে গিয়ে , ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গিয়ে সে কাকে মারে নি ? সন্দেহ যাকে হয়েছে, তাকেই নির্বাসনে পাঠিয়েছে। সন্দেহ হলেই ‘শাস্তি’ , হয় নির্বাসন , নয়তো মৃত্যদন্ড। আর দেশের মানুষ কে ঠকানোর জন্য লোকদেখানো বিচার আর অপরাধীর স্বীকারোক্তি।
দেশের বা বলা ভালো সারা বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তির মেয়ে হয়েও তার শৈশব কষ্টে ভরা। বাবা বলেই সে বাবাকে ভালো না বেসে পারে না, আবার বাবার অপরাধগুলোকেও না বলে পারে না। সবথেকে বড় অপরাধ তাকে মাতৃহারা করা।
শুধু কি তার মা ? তার মাসি , মেসো , ভাই, আত্মীয়-পরিজন কেউ এই হত্যালীলার বলি না হয়ে বাঁচে নি। এমনকি বাড়ির চাকর পর্যন্ত হঠাৎ করে নিরুদ্দেশ হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু, হাজার হলেও বাবা তো ! মন চায় না তার বাবা কে অপরাধী, গণহত্যাকারী বলতে। তাই বাবা বলে তার অপরাধ কে বিশ্বের চোখে একটু কম দেখাতে, সেই গণহত্যাকারী কে প্যারানয়েড-এর রুগী বলেছে। দায় কখনো দিয়েছে তার বিশ্বস্ত কোনো আধিকারিকের ঘাড়ে, কখনো বলেছে তার বাবাকে ভুল বুঝিয়ে করানো হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় হত্যাকাণ্ডগুলিকে।
কিন্তু, ইতিহাস ও তথ্যপ্রমাণ বলে অন্য কথা ।
প্রতি পদে নিজের দলের কর্মী, দেশের স্বনামধন্য কবি , লেখক, বিজ্ঞানী , অধ্যাপক মেয়েটির বাবাকে ভুল ধরানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু ভুল ধরানোর সাজাই হচ্ছে মৃত্যু।
তার মা’র মৃত্যুর কারণ প্রায় ৩০ বছর লুকিয়ে রাখা হয়েছিল মেয়েটির থেকে। তার মা আত্মহত্যা করেছিল, তার মামার উপহার দেওয়া পিস্তল দিয়ে!
স্ত্রী’র আত্মহত্যার পর একটিবারের জন্যও তার বাবা মায়ের সমাধি দেখতে যায় নি — আক্ষেপ মেয়েটির।
সারা পৃথিবীকে সুখী করতে যে সমাজতন্ত্র রচনা করতে চায় তার বাবা, সেই মানুষটির আশেপাশে কেউ শান্তিতে থাকে নি। সবসময়ই এক ভয়ার্ত পরিবেশ।কার কখন ডাক আসে মৃত্যুর, কে কখন বন্ধু থেকে শত্রুতে পরিণত হয়। কে কখন সমাজতন্ত্রের একনিষ্ঠ ভক্ত থেকে গণশত্রুতে অভিযুক্ত হয়। সে এক ভয়ের যুগ। সেই মৃত্যুপুরীর দরজা বন্ধ। বাইরে বেরোয় না কথা। কিন্তু দেওয়ালেরও কান আছে। তাতে কি, শুনতে পাওয়া সব কান , বলতে চাওয়া সব মুখ বলা-শোনার আগেই বন্ধ করে দিতে পারে তার পিতা , একটু সন্দেহ হলেই।
অবাকই করার বিষয় হলো , যে মানুষ টি তার নিজের দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে মেরে ফেলেছিল, লক্ষ লক্ষ কৃষককে অনাহারে থাকতে বাধ্য করেছিল, তার নিজের স্ত্রী-ছেলে-মেয়ের জীবনকে দুর্বিষহ করেছিল, আত্মীয়-পরিজন কে শুধুমাত্র মৃত্যু দিয়েছিল সেই মানুষটি আর তার মতাদর্শ কে সামনে রেখে নতুন সমাজ রচনা করতে চায় একটি দল।
সেই মানুষটি ; যার মেয়ে তার বাবার হত্যার কাহিনী বর্ণনা করেছে আর তার বাবার মতাদর্শ থেকে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে নিজেকে, সেই মানুষটি নাকি একটি দলের নায়ক !
শুধু মা’এর মৃত্যুই নয় , নিজের প্রেমিককেও নিরুদ্দেশ করে দেওয়ার কারিগর তার পিতা।
এতসবের প্রয়োজন নাকি সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণের জন্য।
গোটা পৃথিবীর কোনো শিশু-কিশোর-তরুণ কে তার মতো যন্ত্রণা যাতে না পেতে হয় , এই মতাদর্শের নামে হত্যালীলার কষ্টভোগ যাতে কোনো দেশের মানুষ কে না করতে হয় , তার জন্য বিশ্বের সামনে নিজের কাহিনী তুলে ধরেছিল মেয়েটি।
বাবাকে সে ভালোবাসে — এ কথা বলেও তার বাবার অপরাধ সে নিজেই বলে গেছে ভবিষ্যতের পৃথিবীকে সুখী করার জন্য।
ইংরেজি শেখার চেষ্টায় ইংলিশ ও আমেরিকান খবরের কাগজ পড়তো মেয়েটি। হঠাৎ করে আবিষ্কার করলো , ১৯৩২ সালের ৮ নভেম্বর তার মা আত্মহত্যা করেছিল। ছুটে গেল তার দিদিমার কাছে, জিজ্ঞাসা করলো কেনো এতদিন লুকিয়ে রাখা হয়েছিল এই মর্মান্তিক ঘটনা? মনে করার চেষ্টা করলো ছোটোবেলার ঝাপসা হয়ে যাওয়া স্মৃতিগুলো। বড়দের কাছে এই খবর পুরাতন কিন্তু মাত্র ৬ বছর বয়সে তার মা যেন তার সামনেই আত্মহত্যা করলো ! মাতৃহারা মেয়ে, বিধ্বস্ত হলো ভিতর থেকে।
তার ৩৬ বছরের ব্যথা শোনার মতো আত্মীয় আশেপাশে কেউ নেই। ইচ্ছা ছিল সাহিত্য নিয়ে পড়বে। পিতার অনিচ্ছায় হয় নি। ১৯৬৩ সাল। পিতা মৃত। সেই একনায়ক আর নেই , সেই গণহত্যার দিনগুলো আর নেই। কিন্তু তার মতাদর্শ আছে। কত কবি, লেখক, বিজ্ঞানী , অধ্যাপক নিজের আত্মকথা বলতে চেয়েও পারে নি , অনেকেই পালিয়েছেন। তার বাবাই এরকম কত লেখক, অধ্যাপক, বিজ্ঞানীকে গুলাগের ক্যাম্পে নির্বাসিত করেছে।
মেয়েটির স্মৃতিকথা উনিশশো তেষট্টির সোভিয়েত রাশিয়াতেও নিষিদ্ধ। ভারতীয় রাজদূত টি এন কৌলের মাধ্যমে তার আত্মাকথার পান্ডুলিপি ভারতে পৌঁছায়। সারা বিশ্বের মানুষের উদ্দেশ্যে লেখা চিঠিগুলো ‘Twenty letters to my friend’ নামে প্রকাশিত হয়। বিশ্বের সবথেকে বড় গণহত্যাকারীর মেয়ে হিসেবে নিজের বাবার কুকীর্তি বলার ব্যথা কম নয়। অনেক সমালোচক এই স্মৃতিকথাকে স্তালিনের অপরাধ কে আড়াল করে NKVD চীফ বেরিয়ার ঘাড়ে দেওয়ার কৌশল বলে মনে করেন। কিন্তু স্তালিনের মেয়ে শ্বেতলানা আলিলুয়েভা’র এই বেদনাতুর জীবনের স্মৃতিচারণা বিশ্বশান্তির জন্য তার অনবদ্য প্রয়াসের জন্যই প্রশংসনীয় কারণ একদিকে এই স্মৃতিকথা যেমন তার ব্যথাকেই খুঁচিয়ে দিয়েছিল আবার অন্যদিকে তার গণহত্যাকারী পিতার সমর্থক সারা দুনিয়া জুড়ে অসংখ্য যারা বিশ্বাস করে যে সুখী সমাজ গড়ার পথ স্তালিনের দেখানো বিপ্লবের পথ , স্তালিন তাদের কাছে নায়ক , স্তালিন তাদের আরাধ্য !
গুলাগ থেকে ফেরত এসে আত্মকাহিনী লিখেছেন এরকম লেখক যেমন আছেন, সোভিয়েত রাশিয়া থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে যাওয়া নেতা, আধিকারিক প্রচুর যারা সোভিয়েত রাশিয়ায় মানব সভ্যতার চরমতম দুর্দিনের সাক্ষী কিন্তু তাদের মধ্যে শ্বেতলানা অনন্যা কারণ তিনি গণহত্যাকারী কে মেয়ে হিসেবে ভালোবেসেও অকপটেই সত্য তুলে ধরেছেন , স্তালিন কে খুব কাছ থেকে দেখেছেন , তার পরিবার কিভাবে তার বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বলি হয়েছিল তার একমাত্র সাক্ষী তিনি, শ্বেতলানাই সেই মৃত্যুপুরী থেকে সারা বিশ্ববাসীকে কমিউনিজমের বিষ থেকে রক্ষা করতে সঞ্জীবনী এনেছেন।
পিন্টু সান্যাল
