১৯২৩নাগপুরদাঙ্গা : আদ্য সরসঙ্ঘচালক ডাক্তার হেডগেওয়ারজীর জীবনে তার প্রভাব ও সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা :

  তখন শ্রী মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ভারতে ব্রিটিশ শাসন উপড়ে ফেলতে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল - খিলাফত আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এবং খিলাফত আন্দোলনকে সমর্থন করে গান্ধীজি ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে এক কাল্পনিক জোট গঠন করতে উদ্যত হলেন। কিন্তু দুই সম্প্রদায়েরই উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ পৃথক।

হিন্দুসমাজ #পূর্ণ_স্বরাজের দাবিতে যখন সোচ্চার ছিল তখন মুসলমানরা অটোমান সাম্রাজ্যের #খলিফার সমর্থনকারী ছিল।

              এই জোটের ভাঙন একপ্রকার নিশ্চিত ছিল, কারণ এই জোটের শক্তি ছিল আন্তরিকতা শূণ্য কৃত্রিম এক বন্ধন। দক্ষিণ ভারতের মালাবার অঞ্চলে খিলাফত আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারীরা গুন্ডামি করে তথা স্থানীয় হিন্দুদের ওপর হামলা চালায়। উগ্রবাদে অন্ধ হয়ে বিক্ষোভকারী মোপলা মুসলিমরা স্থানীয় হিন্দুদের পিটিয়ে হত্যা, ধর্ষণ এবং ধর্ষিতাদের নির্বিচারে হত্যা করে। সেই ঘটনা পরবর্তী কয়েক বছর ধরে দেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে। এবং সারাদেশে সাম্প্রদায়িক হিংসার কারণে গান্ধীজী অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন। 

    অসহযোগ আন্দোলনের শুরুর আগে থেকেই সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠাতা ডাক্তার হেডগেওয়ারজী  কংগ্রেসের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তিনি বালগঙ্গাধর তিলক এবং বীর সাভারকারের লেখার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। হেডগেওয়ারজী অতীতে কলকাতায় পড়াশোনা করাকালীন অনুশীলন সমিতির আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, যারা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র  বিপ্লবী আন্দোলনে যুক্ত ছিল এবং এই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তিনি একাধিকবার গ্রেফতারও হয়েছিলেন। কিন্তু কংগ্রেসের এই #হিন্দু_মুসলিম_ঐক্যের ভ্রম ওনাকে কংগ্রেসের কার্যকলাপে উদাসীন করে তুলেছিল এবং তিনি পার্টি ত্যাগ করে নাগপুরে একটি #রাষ্ট্রবাদী_সংগঠন শুরু করতে প্রয়াসী হন । 

 ১৯২৩ সালে হিন্দু মহাসভার কিছু সদস্য শ্রীলক্ষ্মী পূজার দিন নাগপুরের রাস্তায় এক শোভাযাত্রা বের করেছিলেন। ঢোল , নাগারা ও সঙ্গীতসহ শোভাযাত্রা অগ্রসর হচ্ছিল এবং ঘটনাচক্রে তা এক মসজিদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল।

     ভজনে রুষ্ট হয়ে কিছু মুসলিম যুবক এই শোভাযাত্রার ওপর হামলা চালায়, সাম্প্রদায়িক এই আক্রমণে কিছু হিন্দু আহত হন এবং কিছু প্রাণ হারান। এই ঘটনার পর নাগপুরের মুসলিম বহুল অঞ্চলে হিন্দু নরসংহার শুরু হয়। এবং এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ডাক্তার হেডগেওয়ারজী তাঁর ভবিষ্যত কাজের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন।

ডাক্তার হেডগেওয়ারজীর মতে, দাঙ্গার সময় হিন্দুদের কষ্টের মুখ্য কারণ হলো তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা। মুসলিমরা ছিল ঐক্যবদ্ধ, কিন্তু হিন্দু সমাজ একাধিক সম্প্রদায়, বিশ্বাস, জাতি এবং বিচারধারায় বিভক্ত। এই কারণে সেই সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হিন্দুদের ক্ষতির পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশি।

            নাগপুরে সংখ্যায় প্রচুর হলেও মুসলিমদের দ্বারা হিন্দুরা ক্রমাগত পীড়িত হচ্ছিলেন। এবং তাদের ওপর নিরন্তর হামলা হচ্ছিল। দাঙ্গাবাজদের থেকে বাঁচবার জন্য হিন্দু সম্প্রদায়গুলির মধ্যে ঐক্য ছিল না। কিন্তু মুসলিমরা হিন্দুদের উপর হামলা করে নিজেদের ধন-সম্পত্তি সুরক্ষিত করেছিল । 

      ১৯২৩ এর ঘটনা ডাক্তার হেডগেওয়ারজীকে নাগপুরে হিন্দুদের স্থিতি সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করেছিল। এবং হিন্দুদের মধ্যে একতা আনবার জন্য উনি নাগপুরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন।

১৯২৫ সালে নাগপুরে সঙ্ঘের স্থাপনার পর প্রতিটি এলাকাতেই শাখা শুরু করেন এবং হিন্দুদের একতাবদ্ধ করার কাজও শুরু করেন।

        সঙ্ঘে যুক্ত হওয়া এবং এর গতিবিধিতে অংশ নেওয়ার জন্য স্বতঃস্ফূর্ত হিন্দু যুবকদের যুক্ত করা হতো। প্রত্যেক জাতি আর ধর্মের হিন্দু একসাথে বিভিন্ন খেলা খেলতো এবং নিজেদের মতভেদের পরোয়া না করে এই শাখাগুলিতে আত্মরক্ষার অভ্যাস করতো। ১৯২৭ পর্যন্ত স্থাপনার দুই বছরের মধ্যেই নাগপুরে ১৬ টি শাখা চালু হয় যাতে একশোর অধিক সক্রিয় স্বয়ংসেবক ছিল।

        ১৯২৭ এ ডাক্তার হেডগেওয়ারজী ইসলামী গোলামীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ ১০০ স্বয়ংসেবকদের নিয়ে পথ সঞ্চলনের নেতৃত্ব দেন,  যা সেই মসজিদের গলি দিয়ে পরিক্রমা করেছিল এবং স্বয়ংসেবকরা ভগবান গণেশের বন্দনায় রত ছিলেন। কিন্তু নাগপুরের মহাল এলাকা দিয়ে যাবার সময় মুসলিম যুবকরা তাদের পথ রোধ করে। মসজিদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হিন্দু দেবদেবীর বন্দনায় ক্রোধিত হয়ে এলাকার মুসলিম যুবকরা হিন্দু গৃহে আক্রমণের চেষ্টা করে। কিন্তু তারা আশ্চর্য হয়ে যায় যখন স্বয়ংসেবকরা লাঠি নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং মুসলিমদের চেষ্টা বিফলে যায়। এর ফলে মুসলিম ভিড়কে যেমন প্রতিহত করা গিয়েছিল, তেমনই কিছু মুসলিম আত্মরক্ষার্থে শহর ছেড়ে পলায়ন করতেও বাধ্য হয়। 

      ইসলামী গোলামীর বিরুদ্ধে সঙ্ঘের এই প্রচেষ্টা নাগপুরবাসীর মনে এক সাহস প্রতিষ্ঠা করে এবং নাগপুরের হিন্দুদের ভাগ্য বদলাতে থাকে। হিন্দুসমাজ এই সময় অরাজক পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠে, এবং এক শৃঙ্খলাপরায়ন পরিস্থিতি অর্জন করে। এছাড়াও এই প্রতিরোধ ডাক্তার হেডগেওয়ারজীকে আত্মবিশ্বাসের ভাবনা যোগায় যা মহারাষ্ট্রের অন্যত্র তথা ধীরে ধীরে সমগ্র ভারতে সমান সংগঠনাত্মক রণনীতি হয়ে উঠতে শুরু করে। 

    ধীরে ধীরে সঙ্ঘের শাখা ভারতের প্রতি প্রান্তে ছড়িয়ে পরে,  যার মধ্যে সিন্ধ, উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং পূর্ববঙ্গের মতো মুসলিমবহুল এলাকাও ছিল। সঙ্ঘের প্রেরণায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায়( বন্যা,  খরা) সেবাকাজ শুরু করা হয়,  যার ফলে সঙ্ঘের কাজ ভারতীয় জনমনে গভীর প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে।

           ১৯৪০ এ ডাক্তার হেডগেওয়ারের মৃত্যুর পর পরমপূজনীয় শ্রীগুরু গোলওয়ালকারজী  সরসঙ্ঘচালক এর কার্যভার গ্রহণ করেন এবং সমগ্র ভারতে সঙ্ঘের কার্যবিস্তার জারি রাখেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.