হাই কোর্টে আংশিক হলেও বিরোধীদের জয়! পঞ্চায়েত ভোটে সব ‘স্পর্শকাতর’ এলাকায় কেন্দ্রীয় বাহিনী

গোটা রাজ্যে না হলেও, সব স্পর্শকাতর এলাকায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দিল কলকাতা হাই কোর্ট। তবে মনোনয়নের সময়সীমা-সহ রাজ্য নির্বাচন কমিশনের জারি করা বিজ্ঞপ্তির উপর কোনও রকম হস্তক্ষেপ করল না হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি টি এস শিবজ্ঞানম এবং বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চ। ফলে পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে আইনি যুদ্ধে নেমে আংশিক হলেও জয় পেলেন রাজ্যের বিরোধীরা।

মঙ্গলবার পঞ্চায়েত মামলায় কলকাতা হাই কোর্টের রায় ঘোষণার পর তাকে ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা তথা অন্যতম মামলাকারী শুভেন্দু অধিকারীও। বিজেপি বিধায়ক শুভেন্দুর বক্তব্য, হাই কোর্ট হয়তো তাঁদের সমস্ত আর্জি খাতায় কলমে মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু ভোটে হিংসার বিষয়ে ডিভিশন বেঞ্চ যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে, তা তাঁদের দাবিকেই মান্যতা দেয়। তাই এই রায়কে তিনি স্বাগত জানাচ্ছেন। অর্থাৎ বিরোধী দলনেতার কথায়, আংশিক হলেও পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে মামলায় বিরোধীরাই জয়ী হয়েছে। যদিও রাজ্য তা মনে করছে না। মঙ্গলবার রায় ঘোষণার পর রাজ্যের আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, মামলাকারীদের বহু দাবিই খারিজ হয়েছে আদালতে। এমনকি, মনোনয়নের সময় বৃদ্ধি এবং সেই সংক্রান্ত ভোটের দিন পিছনোর বিষয়টিতেও আদালত হস্তক্ষেপ করতে চায়নি। যদিও মঙ্গলবার হাই কোর্ট যে ভাবে মনোনয়ন নির্বিঘ্নে করানো, ভোটারদের মনোবল বৃদ্ধি এবং ভয়মুক্ত পরিবেশ-এর উল্লেখ করে কমিশনকে কেন্দ্রীয়বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ ও পরামর্শ দিয়েছে, তা আদতে রাজ্য এবং কমিশনকে দেওয়া ‘সতর্কবার্তা’ বলেই মনে করছেন অনেকে।

গত শুক্রবার পঞ্চায়েত ভোটের বিজ্ঞপ্তি নিয়ে আদালতে জনস্বার্থ মামলা করেছিলেন শুভেন্দু, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরী-সহ আরও কয়েকজন। শুক্রবার এবং সোমবার মামলাটির শুনানি হয় কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম এবং বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্যের ডিভিশন বে়ঞ্চে। যার রায় সোমবার সংরক্ষিত ছিল। পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে সওয়াল জবাব চলাকালীন বিরোধীরা মূলত ৩টি বিষয়ে জোর দিয়েছিল— কেন্দ্রীয় বাহিনীর নজরদারিতে ভোট, মনোনয়ন জমা দেওয়ার জন্য আরও বেশি সময় এবং ভোটে যাতে সিভিক ভলান্টিয়ার বা চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের ব্যবহার না করা হয়, সে বিষয়ে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবিটি আংশিক মেনে নিয়েছে কলকাতা হাই কোর্ট। মনোনয়নের সময়সীমা বৃদ্ধির সিদ্ধান্তটি পুরোপুরি কমিশনের উপর ছেড়ে দিলেও সিভিক ভলান্টিয়ারদের দিয়ে ভোট করানোর প্রসঙ্গেও আদালত বলেছে, ভোটে সিভিক ভলান্টিয়ার না ব্যবহার করাই ভাল।

মঙ্গলবার ঠিক কী কী বলেছে কলকাতা হাই কোর্ট?

নিরাপত্তা ও কেন্দ্রীয় বাহিনী

পঞ্চায়েত ভোটের নিরাপত্তা নিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে কিছু নির্দেশ এবং কিছু পরামর্শ দিয়েছে কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ। পঞ্চায়েত ভোটে অশান্তির আশঙ্কা করে মামলাকারী বিরোধীরা কেন্দ্রীয়বাহিনীর নজরদারিতে ভোট করানোর আর্জি জানিয়েছিলেন। মঙ্গলবার সেই দাবির কিছুটা মেনে নিয়ে নির্দেশে হাই কোর্ট বলেছে, রাজ্যের স্পর্শকাতর এলাকাগুলিতে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করতে হবে। কারণ আদালতের মত, ভয়মুক্ত পরিবেশে ভোট করানোর ব্যবস্থা করা উচিত কমিশনের। আর কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকলে ভোটারদের মনোবল বৃদ্ধি পাবে। প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ বলেছে, ভোট যাতে শান্তিপূর্ণ হয়, তার জন্যই কমিশনের উচিত কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা। বেঞ্চ বলে, ‘‘রাজ্যে যত বুথ আছে সেই অনুপাতে পুলিশ নেই।’’ এ ব্যাপারে আদালতে সওয়াল চলাকালীন রাজ্য বলেছিল, তারা ঘাটতি পূরণে অন্য রাজ্য থেকে পুলিশ নিয়ে আসবে। মঙ্গলবার আদালত বলেছে, অন্য রাজ্য থেকে পুলিশ আনার বদলে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সাহায্য নিক রাজ্য। এমনকি, কেন্দ্রীয় বাহিনীর আনানোর খরচও রাজ্যকে কেন্দ্রই জোগাবে বলেও নির্দেশ দিয়েছে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ। আদালত বলেছে, কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত রাজ্য যা বাহিনী চাইবে, তা দেওয়া।

পঞ্চায়েত ভোটে নিরাপত্তার জন্য সমস্ত বুথে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানোর আর্জি জানিয়েছিলেন কংগ্রেসের আবু হাসেম খান চৌধুরী (ডালু)। তাঁর আর্জি প্রসঙ্গে হাই কোর্ট বলেছে, কমিশনও নির্বাচনী বুথে সিসিটিভি লাগানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা বহাল থাকবে। বুথের ভিতরে এবং বাইরেও সিসি ক্যামেরা ইনস্টল করতে পারবে কমিশন।

বিজ্ঞপ্তি ও মনোনয়নের সময়

মনোনয়নের জন্য যথেষ্ট সময় দেওয়া হয়নি, এই অভিযোগ ছিল বিরোধীদের। আদালতকে বিজেপি, কংগ্রেস, সিপিএমের মামলাকারীরা জানিয়েছিলেন, মনোনয়ন জমা দেওয়ার জন্য যে সময় দেওয়া হয়েছে, তা হিসাব করলে ৭৩ হাজার আসনে প্রার্থী পিছু বড়জোর ৪০ সেকেন্ড করে সময় পাওয়া যায়। সওয়াল জবাব চলাকালীন প্রধান বিচারপতির বেঞ্চও এই অভিযোগের সারবত্তা রয়েছে বলেই মত দিয়েছিল। আদালত বলেছিল, বিজ্ঞপ্তির দিন বাদ দিলে, মনোনয়ন জমা দেওয়ার জন্য সময় মাত্র ৫ দিন। অথচ গত বার মনোনয়ন জমা দেওয়ার জন্য ৭ দিন সময় দেওয়া হয়েছিল। আদালতের এই যুক্তির জবাবে কমিশনের আইনজীবী বলেছিলেন, তাঁরা বড়জোর আর ১ দিন সময়সীমা বৃদ্ধি করতে পারেন। যদিও মঙ্গলবার রায় ঘোষণার সময় মনোনয়নের সময়সীমা বৃদ্ধির কোনও উল্লেখ করেনি আদালত। তারা মনোনয়নের সময়সীমা সংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্ত ছেড়েছে কমিশনের উপরেই। তবে একই সঙ্গে আদালত কমিশনকে বলেছে, মনোনয়নের প্রক্রিয়া নির্বিঘ্নে করানোর দায়িত্ব কমিশনেরই। মঙ্গলবারই পঞ্চায়েতের মনোনয়ন জমা দেওয়া নিয়ে অশান্তির জেরে রণক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছে ভাঙড়। বিক্ষিপ্ত অশান্তির ঘটনাও ঘটেছে কিছু কিছু জেলায়। সোমবার এই মামলার শুনানিতে প্রধান বিচারপতিও অশান্তির বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মনোনয়ন জমা দেওয়া নিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে অশান্তির খবর সংবাদমাধ্যম মারফত জানতে পারছেন তিনি। মঙ্গলবারের রায়েও কমিশনকে সে বিষয়ে সতর্ক করেছে আদালত। একইসঙ্গে মনোনয়ন জমা দেওয়া নিয়ে অশান্তিতে রাশ টানার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সিভিক ভলান্টিয়ার

বিরোধীরা অভিযোগ করেছিলেন, রাজ্যের হাতে পর্যাপ্ত পুলিশ বাহিনী না থাকায়, তারা সিভিক ভলান্টিয়ারদের দিয়ে ভোট করাতে পারে। মঙ্গলবারের রায়ে আদালত স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছে, আইন মোতাবেক সিভিক ভলান্টিয়ারদের যে কাজে ব্যবহার করার কথা, তাঁদের সেই কাজের জন্যই ব্যবহার করা উচিত কমিশনের। প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে জানিয়েছে, ভোটের কাজে সিভিক ভলান্টিয়ারদের ব্যবহার না করাই ভাল। সোমবার আদালতে এক জনস্বার্থ মামলাকারী প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘‘উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ছাড়া কী ভাবে ওই কর্মীরা ভোটের কাজে অংশ নিতে পারেন? এটা জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের পরিপন্থী। এর আগেও তাঁদের ব্যবহার করা হয়েছে।’’ পরে সিপিএমের আইনজীবীও জানিয়েছিলেন, সিভিক ভলান্টিয়ারদের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের কাজে ব্যবহার করা হয় না জানিয়ে আদালতে রিপোর্ট দিয়েছিলেন স্বয়ং ইনস্পেক্টর জেনারেল। প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছিল, সিভিক ভলান্টিয়াররা পুলিশ নয়। তাই রাজ্য যে পুলিশবাহিনী দিয়ে ভোট করানোর কথা বলছে, তার মধ্যে যেন সিভিক ভলান্টিয়ার বা তাঁদের মতো চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের না ধরা হয়। মঙ্গলবারের রায়ে আরও স্পষ্ট করে আদালত জানিয়েছে, চুক্তিভিত্তিক কর্মী এবং এনসিসি ক্যাডেটদের চতুর্থ পোলিং অফিসারের পরবর্তী কোনও পদে কাজে লাগাতে পারে রাজ্য।

এ ছাড়া যা যা নির্দেশ

বিজেপি চেয়েছিল, পঞ্চায়েত ভোটের নজরদারিতে কোনও বিশেষ পর্যবেক্ষক বা অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বা বিশেষ অফিসার নিয়োগ করা হোক। তাঁর নজরদারিতেই ভোট হবে। বিজেপির সেই আর্জি অবশ্য মঞ্জুর করেনি আদালত। প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ বলেছে, রাজ্য নির্বাচন কমিশন ভোটের জন্য পর্যবেক্ষক নিয়োগ করে। সেখানে ডব্লিউবিসিএস এবং আইএএস কর্তাদের নিয়োগ করা হয়। তাই এই আবেদন আলাদা ভাবে করার দরকার নেই।

গত ৮ জুন রাজ্য নির্বাচন কমিশন পঞ্চায়েত ভোট সংক্রান্ত যে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল, তার বিরোধিতা করেই আদালতে গিয়েছিল বিরোধীরা। একটি জনস্বার্থ মামলায় সেই বিজ্ঞপ্তি খারিজ করার আর্জিও জানানো হয়েছিল, মঙ্গলবার সেই আর্জি মঞ্জুর করেনি আদালত।

অন্য দিকে, সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের দাবি ছিল, সরকারি কর্মী, যাঁরা ভোটের কাজ করেন, তাঁদের হুমকি দেওয়া হয়েছে। এই মর্মে কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিরাপত্তা চেয়েছিল তারাও। মঙ্গলবার আদালত বলেছে, এই কর্মীরা তৃণমূল স্তরে থেকে ভোট পরিচালনা করেন। তাই এদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে কমিশনকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.