নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় স্কুল সার্ভিস কমিশনের ২৬ হাজার (আদতে ২৫,৭৩৫) চাকরি বাতিলের রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। ২০১৬ সালের নিয়োগপ্রক্রিয়ার পুরো প্যানেল খারিজ নিয়ে কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে হস্তক্ষেপ করেনি শীর্ষ আদালত। অযোগ্যদের পাশাপশি অনেক যোগ্য শিক্ষকেরও চাকরি বাতিল হয়েছে। এমতাবস্থায় সুপ্রিম কোর্টের ওই চাকরি বাতিল সংক্রান্ত রায়ের পুনর্বিবেচনা (রিভিউ পিটিশন) চাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। যোগ্য প্রার্থীদের একটি অংশও রিভিউ পিটিশন করতে চান। রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন কি কোনও সুরাহা দিতে পারে? অতীত বলছে, রায় পুনর্বিবেচনার আর্জি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খারিজ হয়ে গিয়েছে। অনেক মামলায় বিচারপতির বেঞ্চ পরিবর্তন হলেও রায় একই থেকে গিয়েছে। রিভিউ পিটিশনে আগেও সুপ্রিম কোর্টে ধাক্কা খেয়েছে রাজ্য। খুবই কম মামলা এমন রয়েছে যেখানে রিভিউ পিটিশনে রায়ের কিছু অংশ পরিবর্তিত হয়েছে।
নির্বাচনী বন্ডে অনুদান সংক্রান্ত মামলায় নির্দেশের কিছু অংশ পরিবর্তন চেয়ে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে রিভিউ পিটিশন করা হয়। সেই আবেদন খারিজ করে দেয় আদালত। গত বছর নিট পরীক্ষার রায়ে একগুচ্ছ নির্দেশ দেয় শীর্ষ আদালত। তার কিছু অংশ পরিবর্তন চেয়ে মামলা দায়ের হয়। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চ ওই আবেদন খারিজ করে দেয়। আদালত জানায়, রায়ে তথ্যগত ভাবে কোনও ত্রুটি নেই। ফলে রায় নিয়ে পুনরায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। একই ভাবে বিলকিস বানো গণধর্ষণ মামলায় রায় পরিবর্তন করেনি সুপ্রিম কোর্ট। ঘুষ নিয়ে সরকারি চাকরি দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার হন তামিলনাড়ুর মন্ত্রী ভি সেন্থিল বালাজি। জামিন চেয়ে তিনি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। শীর্ষ আদালত তাঁর জামিনের আবেদন খারিজ করে দেয়। খারিজ হয়ে যায় ওই মন্ত্রীর রায় পুনর্বিবেচনার আর্জিও। সমলিঙ্গ বিবাহ মামলার রায় পুনরায় বিবেচনার আর্জি করেছিল কেন্দ্র। ওই আবেদনও খারিজ করে দেয় তৎকালীন প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ। ধোপে টেকেনি আদানি-হিন্ডেনবুর্গ মামলার রায় পুনর্বিবেচনার আর্জিও। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি মামলায় রায় পরিবর্তনের আর্জি খারিজ করে দেয় আদালত। টিসিজি ফার্ম নামে একটি সংস্থাকে প্রায় ২০০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল কলকাতা হাই কোর্ট। সুপ্রিম কোর্ট ওই রায় বহাল রাখে। পরে পুনর্বিবেচনার আর্জি খারিজ হয়ে যায়। এ ছাড়া চলতি বছর ১০০টির বেশি মামলায় রায় পরিবর্তনের আবেদন খারিজ করে দিয়েছে আদালত। স্পষ্ট ভাষায় শীর্ষ আদালত জানায়, রায়ে কোনও পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।
২৬ হাজার চাকরি বাতিল মামলায় অনেক যোগ্য প্রার্থী রিভিউ পিটিশন দাখিল করার পরিকল্পনা করছেন। তাঁদের আশা, সঠিক তথ্য তুলে ধরতে পারলে আদালত হয়তো রায় পরিবর্তন করতে পারে। শীর্ষ আদালতে রায়ের পুনর্বিবেচনা চাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন নদিয়ার পলাশির শিক্ষক সাজাদ হোসেন। চরসরাটী কেন্দ্রীয় উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম-দশম শ্রেণিতে তিনি ইতিহাস পড়াতেন। ওই শিক্ষকের বক্তব্য, ‘‘আদালত যোগ্য বলেছিল, আদালতই চাকরি দিয়েছিল। আবার আদালতই চাকরি কেড়ে নিল। সুপ্রিম কোর্টের রায় খুবই হতাশ করেছে।’’ তিনি জানান, প্রথমে এক নম্বরের জন্য চাকরি হয়নি। মেধাতালিকায় কারচুপির ফলে বঞ্চিত হয়েছিলেন। গান্ধীমূর্তির পাদদেশে দীর্ঘ দিন অবস্থান বিক্ষোভে যোগ দেন। পরে হাই কোর্টের নির্দেশে চাকরি পান। এখন সেই চাকরিই বাতিল হয়ে গিয়েছে। রায় বদল চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছেন। চাকরি বাতিল মামলায় রায় বদল হতে পারে বলে মনে করছেন আইনজীবী আশিসকুমার চৌধুরী। সুপ্রিম কোর্টে তিনি যোগ্যদের হয়ে সওয়াল করেছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘রায় পরিবর্তনের সুযোগ খুবই কম রয়েছে। রায়কে মান্যতা রেখেই বলছি, দাগি বা চিহ্নিত অযোগ্যদের বেতন ফেরত দিতে বলেছে সুপ্রিম কোর্ট। ফলে বাকিদের মধ্যে যোগ্যদের বাছাই করা অসম্ভব নয়। এসএসসি সহযোগিতা করলে সম্ভব। সেই তথ্য কোর্টের সামনে তুলে ধরলে রায় বদল হলেও হতে পারে।’’ মূল মামলাকারীদের আইনজীবী ফিরদৌস শামিমের বক্তব্য, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের এই রায় পরিবর্তন হওয়ার সম্ভবনা খুবই ক্ষীণ। রায়ের প্রতিলিপি থেকে স্পষ্ট, সব দিক খতিয়ে দেখেই পুরো প্যানেল বাতিলের রায় দিয়েছে আদালত। অতীতে এই সংক্রান্ত মামলার রেকর্ড বলছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এই রায়।’’
গত বছর ২২ এপ্রিল রাজ্যের প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক এবং অশিক্ষক কর্মীর চাকরি বাতিলের রায় দেয় কলকাতা হাই কোর্ট। বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি মহম্মদ শব্বর রশিদির ডিভিশন বেঞ্চ দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৬ সালের পুরো প্যানেল বাতিল করে দেয়। গত বৃহস্পতিবার হাই কোর্টের ওই রায় বহাল রাখে সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্না এবং বিচারপতি সঞ্জয় কুমারের বেঞ্চ জানায়, হাই কোর্টের নির্দেশ মেনে চিহ্নিত অযোগ্যদের বেতন ফেরত দিতে হবে। বাকিদের চাকরি গেলেও বেতন ফেরত দিতে হবে না। নতুন করে নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।