প্রথমে এক বার নাম-পরিচয় দেখে নেওয়া যাক।
রেখা গুপ্ত: দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী। আরএসএসের ছাত্র সংগঠন এবিভিপির প্রার্থী হিসেবে ১৯৯৬ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ সভাপতি পদে জিতেছিলেন। ছাত্রজীবন পেরিয়ে বিজেপিতে যোগদান। দিল্লির পুর নির্বাচনে উত্তর পীতমপুরা এলাকা থেকে জয়। দিল্লি বিজেপির সাধারণ সম্পাদক পদপ্রাপ্তি। বিজেপি মহিলা মোর্চার সর্বভারতীয় সহ-সভানেত্রী পদে উত্থান। ২০২৫-এর নির্বাচনে শালিমার বাগ আসন থেকে বিধানসভা নির্বাচনে জয়। প্রথম বার বিধায়ক হয়েই মুখ্যমন্ত্রী।
মোহনচরণ মাঝি: ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী। ছাত্রজীবন শেষ করে আরএসএস পরিচালিত স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। ১৯৯৭ সালে নিজের এলাকার ‘সরপঞ্চ’। ২০০০ সালে কেওনঝড়ের বিধায়ক। ২০০৪ সালে আবার জয়। ২০০৫ সালে বিধানসভায় শাসকজোটের মুখ্য সচেতক। ২০০৯ এবং ২০১৪ সালে পর পর হার নিজের আসনেই। ২০১৯ সালে আবার জয়। এ বার বিরোধী দলের মুখ্য সচেতক। ২০২৪ সালের নির্বাচনে চতুর্থ বারের জন্য বিধায়ক হয়ে ওড়িশার প্রথম বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী।
মোহন যাদব: মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। আরএসএসের ছত্রছায়ায় ছাত্র রাজনীতিতে এসেছিলেন। ১৯৮২ সালে প্রথম বার ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জয়। ১৯৯০ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত এবিভিপির সর্বভারতীয় সম্পাদক। পরে আরএসএসের উজ্জয়িনী খণ্ডের সহ-কার্যবাহ। তার পরে বিজেপি যুব মোর্চার রাজ্য সভাপতি। ২০১৩ সালে উজ্জয়িনী দক্ষিণ আসন থেকে বিজেপি বিধায়ক। ২০১৮ সালে দ্বিতীয় বার জয়। ২০২০ সালে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী। ২০২৩ সালে মুখ্যমন্ত্রিত্বে উত্থান।
ভজনলাল শর্মা: রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী। স্কুলে পড়াকালীন এবিভিপিতে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৯০ সালে এবিভিপির ‘কাশ্মীর বাঁচাও কর্মসূচি’তে যোগদান করে শ্রীনগরের উদ্দেশে যাত্রা করে উধমপুরে গ্রেফতার হন। ১৯৯২ সালে রাম জন্মভূমি আন্দোলনে শামিল হয়ে আবার গ্রেফতার। ছাত্র রাজনীতি ছাড়ার পরে কিছু দিন ছিলেন যুব মোর্চায়। ২৭ বছর বয়সে নিজের পঞ্চায়েতের ‘সরপঞ্চ’। তার পরে রাজস্থানের ভরতপুর জেলা বিজেপি সভাপতি। ২০১৪-’১৬ পর্যন্ত রাজ্য বিজেপির সহ-সভাপতি। ২০১৬-’২৩ পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক। প্রথম বার বিধানসভা নির্বাচনে জয় ২০২৩ সালে। জিতেই মুখ্যমন্ত্রী।
বিষ্ণুদেও সাই: ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রী। স্কুলজীবন শেষ করেই আরএসএসের হয়ে জনজাতিদের মধ্যে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৮৯ সালে নিজের গ্রামে পঞ্চায়েত সদস্য হন। এক বছরের মধ্যে ‘সরপঞ্চ’। সে বছরই তপকারা বিধানসভা আসন থেকে বিজেপির টিকিটে জিতে অবিভক্ত মধ্যপ্রদেশ বিধানসভার সদস্য। ১৯৯৮ পর্যন্ত বিধায়ক। ১৯৯৯ সালে রায়গঢ় লোকসভা আসন থেকে জয়। ২০১৯ পর্যন্ত টানা লোকসভায়। তার মধ্যেই দু’বার রাজ্য বিজেপির সভাপতি। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। পরে ২০২০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত ফের রাজ্য সভাপতি। ২০২২ সালে বিজেপির রাষ্ট্রীয় কার্যকারিণীর আমন্ত্রিত সদস্য। ২০২৩ সালে পূর্ণাঙ্গ সদস্য। রাজ্য রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা থেকে অনেক দূরে। কিন্তু সে বছরেরই ডিসেম্বরে অনেককে চমকে দিয়ে তাঁর নাম ঘোষিত হয়েছিল ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রিত্বের জন্য।
এই পাঁচ জনের মধ্যে প্রথম মিল— তাঁরা প্রত্যেকেই ভারতের এক একটি রাজ্যের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু তার চেয়েও বড় মিল— এঁরা প্রত্যেকেই যাকে বলে, বিজেপির রাজনীতিতে ‘ছায়ামানুষ’। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে পর্যন্ত যাঁদের তেমন কোনও সর্বভারতীয় পরিচিতি নয়ই, আঞ্চলিক পরিচিতিও ছিল না। আরও মিল যে, এঁরা প্রত্যেকেই ‘চমক’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে। জাদুকর তাঁর টুপির ভিতর থেকে যেমন খরগোশ বার করে দর্শকের চোখ ধাঁধিয়ে দেন, হুবহু সেই কায়দায় তাঁদের ঝুলি থেকে বার করেছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। সর্বশেষ উদাহরণ দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী রেখা। যাঁর পুরসভা ভাঙচুরের পুরনো ভিডিয়ো ‘ভাইরাল’ হল তিনি দিল্লির মসনদে বসার পরেই।
মুখ্যমন্ত্রী বাছাইয়ের প্রশ্নে বিজেপির এই ভেলকি-নীতির কারণ কী? গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীরা মুখ খুলতে নারাজ। তবে সম্ভাব্য ‘ফর্মুলা’ সম্পর্কে একটা ধারণা সর্বোচ্চ নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠ বৃত্ত সূত্রে মিলছেস যে আভাস মিলে যাচ্ছে প্রবীণ বিজেপি তাত্ত্বিকদের ব্যাখ্যার সঙ্গেও।
আরএসএসের ‘ফেভারিট’
গত কয়েক বছরে যে ক’জন ‘অপরিচিত’কে বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসিয়েছে, তাঁদের প্রত্যেকে আরএসএসের আশীর্বাদপুষ্ট। শুধু এই পাঁচ নন। গত কয়েক বছরের মধ্যে যাঁরা দ্বিতীয় বা তৃতীয় বার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন, মহারাষ্ট্রের দেবেন্দ্র ফডণবীস, উত্তরাখণ্ডের পুষ্কর সিংহ ধামী, হরিয়ানার নায়ব সিংহ সৈনী সঙ্ঘের ‘ঘরের ছেলে’ হিসেবে পরিচিত। অর্থাৎ, ব্যক্তিগত জনভিত্তি বা প্রতিপত্তি একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। আরএসএসের ‘আস্থাভাজন’ হওয়াও জরুরি।
অন্ত্যোদয় নীতি
পিছনের সারি থেকে নেতা তুলে আনতে হবে। প্রান্তিক শ্রেণির মধ্য থেকে যোগ্য ব্যক্তি খুঁজে বার করতে হবে। কাগজে-কলমে এই অন্ত্যোদয় নীতির কথা বহু দশক ধরেই বিজেপি বলে। এমনকি, বিজেপি প্রতিষ্ঠার আগে জনতা পার্টি জমানাতেও এই নীতির কথা শোনা গিয়েছে। কিন্তু ২০১৪ থেকে দলের ভোটবাক্সে ওবিসি ভোটের জোয়ার দেখে এই নীতির বাস্তবায়নে উৎসাহ বেড়েছে। তথাকথিত উচ্চবর্ণের ভোট বিজেপির বাইরে খুব একটা যাবে না বলে নেতৃত্বের ধারণা। অন্ত্যোদয় নীতির বাস্তবায়ন করা গেলে ওবিসি ভোটব্যাঙ্কও স্থায়িত্ব পেতে পারে বলে মোদী-শাহদের অভিমত। উপরন্তু দলিত এবং জনজাতির ভোটও বাড়তে পারে বলে সর্বোচ্চ নেতৃত্বের ধারণা।
ব্যক্তির চেয়ে দল বড়
জন্মলগ্ন থেকে বিজেপি এই আপ্তবাক্য আউড়ে আসছে। কিন্তু বিজেপির ইতিহাসেই বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তিকে দলের চেয়ে বড় হয়ে উঠতে দেখা গিয়েছে। তাঁরা যেমন দলের সবচেয়ে বড় সহায় হয়েছেন, তেমনই তাঁদের উপরে অতিরিক্ত নির্ভরতা ডুবিয়েও দিয়েছে। রাজস্থানে বসুন্ধরা রাজের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ২০২৩-এর বিধানসভা নির্বাচনেও বিজেপির সহায় হয়েছে। কিন্তু অতীতে অতিরিক্ত বসুন্ধরা-নির্ভরতা বিজেপির ভরাডুবির কারণও হয়েছিল। ‘মহারানি’র বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত দুর্নীতির অভিযোগে গোটা বিজেপি ধাক্কা খেয়েছিল। কর্নাটকে বিএস ইয়েদুরাপ্পা বা ছত্তীসগঢ়ে রমণ সিংহও একই গোত্রে। তাই ব্যক্তিনির্ভরতা কমিয়ে দলকে বড় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার নীতি।
প্রবীণ বিজেপি তাত্ত্বিক তথা প্রাক্তন রাজ্যপাল তথাগত রায়ের মতে, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী বাছার প্রশ্নে আরএসএসের মতামত গুরুত্বপূর্ণ। আরএসএস দুটো বিষয়ে বেশি জোর দেয়। এক, আদর্শের প্রতি আনুগত্য। দুই, অবিতর্কিত ভাবমূর্তি।’’ তবে একই সঙ্গে তথাগত জানাচ্ছেন, বিভিন্ন রাজ্যে যাঁরা মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন, তাঁদের নাম আরএসএস থেকে বেছে দেওয়া হচ্ছে তেমন নয়। তাঁর কথায়, ‘‘আরএসএস দৈনন্দিন রাজনীতির মধ্যে থাকে না। কিন্তু বিজেপির সর্বোচ্চ পদাধিকারীরা তো সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকও। তাই যে কোনও বড় সিদ্ধান্তের বিষয়ে সঙ্ঘের মত তাঁরা নিজেরাই জেনে নেন।’’ বিজেপি সূত্রের আরও ব্যাখ্যা, যাঁরা খুব ‘জনপ্রিয়’ নেতা, তাঁদের নিয়ে স্বাভাবিক কারণে বিতর্কও বেশি। তাঁদের সমর্থক যেমন বেশি, তেমন শত্রুও অনেক। তথাগতও বলছেন, ‘‘শত্রুরা সব সময়েই তাঁদের নাম বিতর্কে জড়িয়ে দিতে উদগ্র থাকেন। দলের মধ্যেও তাঁদের অনেক বিরোধী থাকেন। সঙ্ঘ চায়, এই ধরনের সমস্যার বাইরে থাকা কাউকে তুলে আনতে।’’
‘তুলে আনা’ নিয়ে তথাগতের বক্তব্যের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত নবীন এক মুখপাত্রের ব্যাখ্যার মিল রয়েছে। তাঁর ব্যাখ্যায় ‘অন্ত্যোদয়’ নীতিতে জোর দেওয়ার তত্ত্ব রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘বিজেপি একেবারে পিছনের সারি থেকে নেতৃত্ব তুলে আনতে চাইছে। কিন্তু যোগ্যতার সঙ্গে আপসের প্রশ্ন নেই। তাঁদেরই তুলে আনা হয়, যাঁদের যোগ্যতা রয়েছে।’’ নরেন্দ্র মোদীর উদাহরণ দিয়ে তিনি বলছেন, ‘‘যখন মোদীজিকে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী করা হয়েছিল, তখন তিনি গুজরাতে আদৌ সামনের সারির নেতা নন। কেশুভাই পটেল তখন তাঁর চেয়ে অনেক বেশি দাপুটে নেতা। সেই কেশুভাইকে সরিয়ে চা-ওয়ালার ছেলেকে মুখ্যমন্ত্রী করা হল। কিন্তু মোদীজির যোগ্যতা নিয়ে কখনও সন্দেহের অবকাশ তৈরি হয়নি।’’
বিজেপির এই ফর্মুলার ‘ব্যতিক্রম’ও অবশ্য মোদী-শাহের জমানাতেই দেখা গিয়েছে। তাঁর নাম যোগী আদিত্যনাথ। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীপদে রেকর্ড গড়ে পর পর দু’বার আসীন হয়েছেন আদিত্যনাথ। গোরক্ষপুর মঠের প্রধান মহন্ত আদিত্যনাথ রাজনীতিতে ছিলেন। তবে শুধু সাংসদ হয়ে। দেশের অন্য অনেক সাংসদের মতো। যাঁদের লোকসভার বাইরে বিশেষ কেউ চেনে-টেনে না। থাকতেন মঠেই। হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী হলেও আরএসএসের ‘ঘরের লোক’ হিসেবে কখনও পরিচিত ছিলেন না। সেই আদিত্যনাথকে গোরক্ষপুর মঠ থেকে তুলে এনে সরাসরি লখনউয়ের মসনদে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই ‘চমক’! কিন্তু যোগী ‘ছায়ামানুষ’ হয়ে থাকেননি। প্রভাব-প্রতিপত্তি এতই বাড়িয়েছেন যে, তিনি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেরও ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেতে বসেছেন।
তবে কিনা, একমাত্র ‘ব্যতিক্রম’ হয়ে আদিত্যনাথ প্রমাণ করেছেন ‘ভেলকি-নীতি’ই নিয়ম।