পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায়ের একাত্ম মানবদর্শন

কটি মানুষ সর্বাঙ্গ সুন্দর হয়ে ওঠেন যখন তার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কার্যকরী ও সুস্থ-সবল থাকে। একটি ফুল তখনই মনোরম যখন তার প্রতিটি দলের অস্তিত্ব সুন্দর ও নান্দনিক। তেমনই একটি সমাজ সার্থক, যখন তার প্রতিটি ব্যক্তিসত্ত্বা পূর্ণ, পবিত্র ও বিকশিত। আসলে ব্যক্তির সাধনা এবং সমষ্টির আরাধনা ভিন্ন নয়। ‘অহং’-এর মধ্যে ‘বয়ং’ সত্তাকে বিরাজিত করলেই সেই সমাজ প্রবল গতিতে এগিয়ে চলে। এককের মধ্যে সমষ্টির নিত্য অনুসন্ধান চালাতে হবে। কারণ ভারতীয় সংস্কৃতি একাত্মবাদী। আপাত প্রভেদের মধ্যেই তার অন্তর্নিবিষ্ট ঐক্য বিরাজিত। ধরতে হবে সেই সুর, সেই ঐক্যের বাণী। আমাদের নিত্যকালের সাধনা পারস্পরিক সহযোগিতা, পরিপূরকতা এবং অনুকূলতা। বিরোধ ও সংঘর্ষের মাঝে এই জীবনের একতারা খোঁজার নামই একাত্ম মানবতাবাদ। এক সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির চিরায়ত অনুসন্ধান। একাঙ্গী নয়, সর্বাঙ্গীণ; ‘ছোটো আমি’ নয় ‘বড় আমি’; ‘কাঁচা আমি’ নয় ‘পাকা আমি’, ‘অহম্’ নয় ‘ভূমা’; সকল আমির সমষ্টিগত আমি নিয়েই ‘চরৈবেতি’ যাত্রা। Integral Humanism কে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক দর্শনের বাণী করে তুলেছিলেন পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায়।

আজকের বিজেপি সরকার তার বাণীকে আদর্শ করেই এগিয়ে চলেছে। ‘সব কা সবকা বিকাশ’ — একতারাতে বেঁধে দেওয়া তারই সুর। মোদীজির উন্নয়নের মন্ত্রে গ্রাম-শহর মেলবন্ধন তারই মানবতার পরত।

পণ্ডিত দীনদয়াল ছিলেন ভারতীয় জনসঙ্ঘ তথা বর্তমান ভারতীয় জনতা পার্টির অন্যতম কারিগর। ড. শ্যামাপ্রসাদের পরশে যার নির্মিতি, তাকেই ফুলে-ফলে পল্লবিত করার পশ্চাতে তার অসামান্য অবদান। শ্যামাপ্রসাদের বলিদানের পর অনাথ শিশু দলটিকে প্রতিপালিত করার মহান চ্যালেঞ্জ এসে পড়লো তার কাঁধে। সর্ব ভারতীয় সম্পাদনা সুসম্পন্ন করে তিনি বলরাজ মাধকের পর জনসঙ্ঘের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। আমৃত্যু সেই পদে ছিলেন, তার পর এই দায়িত্ব আসে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর কাছে।

চিন্তাবিদ, বহুমুখী প্রতিভা সম্পন্ন এই রাজনৈতিক দার্শনিকের জন্ম মথুরা জেলায় ১৯১৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর এক গরীব পরিবারে। অকালে পিতাকে হারিয়ে ছোটোবেলায় মানুষ হয়েছেন মাতুলালয়ে। কিন্তু দারিদ্র্য তার মেধা, সামাজিক দৃষ্টিপথে দীনতা আনতে পারে নি। ১৯৩৭ সালে কানপুরের সনাতন ধর্ম কলেজে পড়াকালীন তিনি রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের প্রাণপুরুষ শ্রী কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের সাক্ষাৎ লাভ করেন। ১৯৪২ সালে তিনি আরএসএস-র সর্বক্ষণের কর্মী হন। চল্লিশের দশকের প্রথমে তিনি ‘রাষ্ট্রধর্ম’ নামে হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদের ভাবধারায় একটি পত্রিকা প্রকাশে উদ্যোগী হন। এরপর তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ‘পাঞ্চজন্য’ এবং দৈনিক পত্রিকা ‘স্বদেশ’। ১৯৫১ সালে ভারতীয় জনসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা হলে তাতে যোগদান করেন।

প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী, পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায়কে ‘নিঃস্বার্থ সেবার এক দীপবর্তিকা’ বলে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, তিনি আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস ও পথ প্রদর্শক। সম্প্রতি বারানসীর কাছে দেশের অন্যতম ব্যস্ত রেল জংশন ‘মুগলসরায়’-র নাম দীনদয়ালের নামে উৎসর্গীত হয়েছে। এখানেই ট্রেনযাত্রা পথে তাঁর রহস্য মৃত্যু হয়। তিনি আজও আমাদের মধ্যে বেঁচে আছেন; তার দর্শনে, তার মহানুভবতায়।

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.