ডাকরা গণহত্যা

ছবিটি ডাকরা কালী মন্দিরের – মুক্তিযুদ্ধে যেখানে শত শত মানুষকে জবাই করে হত্যা করেছিলো রজ্জব আলী ফকিরের নেতৃত্বে রাজাকারেরা।

যে ভয়াবহ ও পৈশাচিকতার গণহত্যা ভুলে গেছে সবাই। প্রজন্মের জানা নেই আজ। রাজাকার ও শান্তি কমিটি দ্বারা সংগঠিত দেশের সর্ববৃহৎ গণহত্যা ছিলো ডাকরা গণহত্যা।

ডাকরা মূলত বাগেরহাটের রামপালের পেড়িখালি ইউনিয়নের একটি গ্রাম।

মে মাসের ১১ তারিখ থেকে ডাকরা ও পেড়িখালি ইউনিয়নের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা দেশত্যাগ করতে শুরু করলে ডাকরা গ্রামের কালীবাড়ির প্রধান সেবায়েত বাদলচন্দ্র চক্রবর্তী ভক্তদের এখনই যেতে নিষেধ করেন। এরপর সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেন ২২ মে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে ভারতে যাওয়ার। ডাকরা গ্রামের কালীবাড়ি ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে পরম পূজনীয় স্থান এবং সেবায়েত বাদলচন্দ্র চক্রবর্তীকে সবাই ভীষণ শ্রদ্ধা ও সম্মান করতেন।

আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২২ মের কয়েক দিন আগ থেকে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর অসংখ্য হিন্দু পরিবার ডাকরা কালীবাড়ির আশেপাশে মংলা নদী, মাদারতলা নদী ও কুমারখালী খালের তীরে শতাধিক নৌকায় অবস্থান নেয়। ২১ তারিখের মধ্যে ডাকরা কালীবাড়ি ও চারপাশে জায়গা হয়ে উঠে অনেকটা ছোট শরণার্থী শিবিরের মতো। ডাকরা গ্রামের ইনাম আলী শেখ, জোনাব আলী শেখ ও দেলোয়ার হোসেন উপস্থিত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূর্ণ নিরাপত্তার আশ্বাস দেন। বাঁশতলী গ্রামের শান্তি কমিটির সদস্য আফসার উদ্দিনও এ সময়ে পাকিস্তানি বাহিনী কোনো সমস্যা করবে না বলে আশ্বাস দিয়েছিলো।

এ দিকে তারাই হিন্দু ধর্মাবলম্বী এই মানুষদের হত্যার জন্য মেডিকেল ছাত্র লিয়াকত আলী গজনবীর মাধ্যমে বাগেরহাটের রাজাকার কমান্ডার রজ্জব আলী ফকিরের কাছে একটি চিঠি পাঠায়।

২১ মে দুপুর ১টার দিকে রাজাকার রজ্জব আলী ফকিরের নেতৃত্বে একেএম ইউসুফ, সিরাজ মাস্টার, আকিজ উদ্দিন, ইসহাকসহ রাজাকারের একটি দল বড় দুটি ছিপওয়ালা নৌকায় ডাকরায় পৌঁছে। প্রতিটি নৌকায় ছিল ১৫ থেকে ২০ জন রাজাকার। রাজাকারদের প্রথম নৌকাটি কালীগঞ্জ বাজার অতিক্রম করে মাদারতলী খালের দিকে অগ্রসর হয়। দ্বিতীয় নৌকা কুমারখালী খাল বরাবর অগ্রসর হয় এবং তারপর মাদারতলী বরাবর চলে আসে।

দ্বিতীয় নৌকা থেকে রাজাকাররা নেমেই ভিড়ের মধ্যে নির্বিচারে গুলি চালাতে শুরু করে। ইতোমধ্যে প্রথম নৌকা থেকেও রাজাকাররা নিচে নেমে কালী মন্দিরের দিকে এগিয়ে ভিড়ের মধ্যে নির্বিচারে গুলি চালায়। এ সময় বৃষ্টির মতো দুদিক থেকে গুলির শব্দ শুনে নৌকা ও তীরে অবস্থানরত নিরীহ মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েন। প্রাণ বাঁচাতে তারা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ছুটতে থাকেন। দুদিক থেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে বহু মানুষ মারা যান। যারা গুলিবিদ্ধ হয়ে বেঁচে ছিলেন, তাদেরকে জবাই করে হত্যা করে রাজাকারেরা।

অনেকে কালীবাড়িতে তাদের গুরুর কাছে হাজির হন। এ সময়ে রাজাকারেরাও দুদিক থেকে গুলি চালাতে চালতে কালীবাড়িতে এসে হাজির হয়। এ সময় সেখানে উপস্থিত নারী ও পুরুষদের আলাদা করা হয়। এরপর আরও পুরুষ আছে কি না তা পরীক্ষা করার জন্য কয়েকজন রাজাকার ঘরের ভেতরে ঢুকে শাড়ি পরা অবস্থায় কয়েকজন পুরুষকে খুঁজে পায়। তাদের টেনে হিঁচড়ে বাইরে এনে মন্দির চত্বরে লাইন ধরে ব্রাশফায়ার ও জবাই করে হত্যা করে।

মাত্র দুই ঘন্টায় সংগঠিত এই গণহত্যায় শহীদ হয়েছিলেন প্রায় ৯০০ মানুষ। যদিও শহীদদের তালিকায় পাওয়া যায় ৬৪৬ জন নিরীহ ভক্ত ও গ্রামবাসীর নাম।

গণহত্যা শেষে কয়েকজন তরুণীকে অপহরণ করে রাজাকার কমান্ডার রজ্জব আলীর নৌকায় তুলে নেয় রাজাকারেরা। স্থানীয় রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে রজ্জব আলী ফকির বাগেরহাটে ফিরে যায়।

ছবিটি ডাকরা কালী মন্দিরের‌। এই মন্দির চত্বরেই শত শত নিরীহ ভক্ত ও গ্রামবাসীকে জবাই করেছিলো রজ্জব আলী ফকির ও রাজাকরেরা।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.