পাথর প্রস্তুত, রামমন্দির নির্মাণ শুধু সময়ের অপেক্ষায়


এখন থেকে ৩ বছর আগে ২০১৭ সালের ১৭ আগস্ট উত্তর প্রদেশের নবনির্বাচিত বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী যােগী আদিত্যনাথ বুক চিতিয়ে বলেছিলেন, “হিন্দু সমাজ জেগে উঠেছে। এখন আর রামমন্দির ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। অযােধ্যায় রামজন্মভূমি মন্দির নির্মাণের সেই কাজ বস্তুত শুরু হয়ে গেছে। গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদীর হাতে ভূমি পুজো এবং ৪০ কিলােগ্রাম রুপাের ইটে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের দু’সপ্তাহের মধ্যেই মাটি পরীক্ষার কাজ আরম্ভ হয়েছে। ২০ আগস্ট রামজন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ন্যাস (অছি পরিষদ) জানিয়েছে যে এবার ভিত তৈরি হবে মাটির ৬০ ফুট গভীরে। পাথরে নকশা কাটার কাজ প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে এসেছিল। কিন্তু ভূমিপুজোর প্রাক্কালে প্রস্তাবিত মন্দিরের আকার-আয়তনে কিছু পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করা হয়েছে। সে কারণে আরও কিছু পাথর খােদাই করা দরকার। সবমিলিয়ে ১ লক্ষ ৭৫ হাজার থেকে ২ লক্ষ ঘনফুটের মতাে পাথর লাগবে। তার মধ্যে প্রায় ১ লক্ষ ৫০ হাজার ঘনফুটের খােদাই সম্পন্ন। ২০২৩ সালের মধ্যেই মন্দির নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়ে যাবে।
সােমনাথ মন্দিরের মতাে এইরামমন্দিরও নির্মাণ করা হবে সম্পূর্ণ ভারতীয় স্থাপত্যকলা অনুযায়ী এবং প্রায় সােমনাথ মন্দিরের আদলে। তবে এই মন্দির নির্মাণের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলাে, কোনােদিন মরচে ধরে ভেতর থেকে মন্দিরের যাতে ক্ষতি না হয় সেজন্য এতে কোনও লােহা ব্যবহার করা হবে না। বদলে ধাতু হিসেবে ব্যবহার করা হবে ২০ হাজেরর বেশি তামার পাত৷ সেইসব তামার পাত শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে যাঁরা দান করবেন তারা পাতগুলােতে নিজেদের নাম খােদাই করে দিতে পারবেন। তামার পাতগুলাে বসানাে হবে কালাে রঙের গ্রানাইট পাথরের অভ্যন্তরে।
রামজন্মভূমি মন্দিরের প্রধান স্থপতি হলেন বাস্তবিদ চন্দ্রকান্তভাই সােমপুরা। বর্তমান সােমনাথ মন্দিরও তিনিই নির্মাণ করেছিলেন। এখন তার দুই বাস্তুবিদ পুত্র অনুভাই ও নিখিল সােমপুরা রামজন্মভূমি। মন্দির নির্মাণের দায়িত্বে রয়েছেন। দুজনেই জানিয়েছেন, ‘তামার পাতে নির্মিত একটা আধারের মধ্যে খােদিত থাকবে রামজন্মভূমি মন্দিরের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। সেই আধার রাখা হবে মাটির তলায়, ভিতের ঠিক পাশেই। রামজন্মভূমি মন্দির ধ্বংস করে বাবরি মসজিদ বানানাে এবং প্রায় ৫৩ বছর যাবৎ পরিত্যক্ত সেই মসজিদ ধূলিসাৎ এবং রামমন্দির পুনরুদ্ধারকে কেন্দ্র করে দীর্ঘ প্রায় ৫০০ বছর ধরে যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির যে নােংরা খেলা চলে এসেছে। ভবিষ্যতে কোনােদিন আর যাতে তার পুনরাবৃত্তি না হতে পারে সেজন্যই এই ইতিহাস বিধৃত করে রাখা হবে বলে জানিয়েছেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের আন্তর্জাতিক সাধারণ সম্পাদক চম্পত রাই।
তাছাড়া প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে যাতে রামমন্দিরের অবস্থিতি সম্পর্কে সবাই একবাক্যে স্থিরনিশ্চয় হতে পারেন সেজন্য মাটির এত গভীরে গিয়ে প্রাথমিক ভিত বা বেসমেন্ট তৈরি করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে মন্দিরের দীর্ঘ স্থায়িত্বের ব্যাপারটা তাে আছেই। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এই প্রাথমিক ভিতের পাথরেও খােদিত থাকবে হিন্দু দেবদেবী এবং মঙ্গলঘট জাতীয় হিন্দুত্বের বিভিন্ন প্রতীকচিহ্ন। অনুভাইয়ের বক্তব্য। অনুযায়ী নির্দেশ পাওয়ার ২৫ ঘণ্টার মধ্যে নকশা খচিত পাথর বসানাের যাবতীয় ব্যবস্থা প্রস্তুত। এখনাে পাথর খােদাইয়ের যেটুকু কাজ বাকি রয়েছে, মন্দির নির্মাণের কাজ চলতে চলতে তা সম্পূর্ণ হয়ে যাবে।
ইতিমধ্যে ভিত ও দোতলা পর্যন্ত কাজের জন্য প্রয়ােজনীয় পাথর কাটার কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে। নকশাকাটা ২১২টা স্তম্ভ এবং অন্যান্য পাথর সযত্নে তুলে রাখা হয়েছে করসেবকপুরমের বিশাল ভাণ্ডারে বানানাে ১৮৫টা বিমের তাকে। এখন সেগুলাে পরিষ্কার ও পুলিশের কাজ চলছে। রাজস্থানের লাকিরামের মতাে ১৬ জন দক্ষ কারুশিল্পী এখন নিরন্তর নকশা খােদাই করে চলেছেন। পাথরে নকশা কাটা শুরুর সময় ৬ জন কাজ করতেন। একটা সময় প্রায় ১০০ জন কাজ করছিলেন। কিন্তু এখন কেবলমাত্র সুদক্ষ (স্কিলড) নকশাকাররাই বহাল রয়েছেন।
রামজন্মভূমি মন্দির নিয়ে যত বিতর্ক, বিবাদ-বিসংবাদ চলতে থাকুক, ১৯৯০ সালের ১৭ মার্চ থেকে পাথরে নকশা কাটার যে কাজ শুরু হয়েছে এখনও তা চলছে। মাঝে দু’বার সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হয়েছিল কংগ্রেস এবং সমাজবাদী পার্টি (এম পি)-র রামমন্দির- বিরােধী রাজনীতির কারণে। প্রথমবার বন্ধ ছিল ২০০৮ থেকে ২০১১ সালে। রাজস্থানে গেহলট সরকার খনি আইনের অছিলায় সেখানকার মাটির নীচে থেকে পাথর তােলার ওপর বিষেধাজ্ঞা জারি করায়। দ্বিতীয়বার স্থগিত রাখতে হয় ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত। তখন উত্তরপ্রদেশে ছিল সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদবের সরকার। রামমন্দিরের জন্য ট্রাক ভর্তি হয়ে পাথর আসছে দেখে তার সরকার তা বন্ধ করার জন্য ‘রামজন্মভূমি-বাবরি মামলা সুপ্রিম কোর্টের এক্তিয়ারে রয়েছে এই বাহানা দেখিয়ে অযােধ্যায় পাথর নিয়ে আসার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। অবশ্য ২০১৭ সালের ১৯ মার্চ অখিলেশ সরকারকে উৎখাত করে মানুষ তার যথােপযুক্ত জবাব দিয়েছেন। যােগী আদিত্যনাথের সরকার বহাল হতেই সেই নিষেধাজ্ঞা বাতিল করা হয়। ফের পাথর আনানাে শুরু হয়ে যায়। একটা উল্লেখযােগ্য ঘটনা হলাে, পাথরেনকশা খােদাইকারীরা এত বছর ধরে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাচ্ছেন। প্রতিদিন সকাল ৮টায় শুরু হয় তাঁদের ছেনি-হাতুড়ি ঠোকার কাজ। শেষ হয় রাত ৮টায়। দুপুর ১টা থেকে ২টো পর্যন্ত ভােজন। ও বিশ্রামের জন্য অবসর। মােট ১২ ঘণ্টা কাজ করলেও মজুরি নিয়ে থাকেন ৮ ঘণ্টার। বাকি চার ঘণ্টা দিয়ে যাচ্ছেন স্বেচ্ছাশ্রম। যাকে তারা রামমন্দিরের জন্য শ্রদ্ধাশ্রম’ বলে থাকেন এবং এজন্য রােজ হাসিমুখে কাজ করেন।
পাথর কাটার কাজ প্রথম দিকে খুবই ধীর গতিতে কাজ চলত। তখন উত্তরপ্রদেশের মীর্জাপুর জেলার চুনার থেকে মাত্র কয়েক ট্রাক পাথরের চাই (স্ল্যাব) নিয়ে আসা হয়েছিল। প্রসঙ্গত, এই পাথরও গুণমানে। যথেষ্ট ভালাে। হালকা লালচে রঙের এই চুনার পাথরেই সম্রাট অশােক সারনাথে অশােকস্তম্ভ তৈরি করিয়েছিলেন। বর্তমানে রামজন্মভূমি ন্যাসের প্রধান তথা দিগম্বর আখড়ার প্রধান মহন্ত নৃত্যগােপাল দাস এবং শ্রীচম্পত রাই যখন অর্থদানের বদলে পাথর দানের আহ্বান জানান তখন থেকে রাজস্থানের ভরতপুর জেলার বায়ানায় বংশীপাহাড়পুর থেকে রামভক্তরা হালকা লালচে রঙের বেলেপাথর পাঠাতে শুরু করেন। রাজস্থানের সিরােহীতেও বেলেপাথর পাওয়া যায় “ঢােলপুর স্টোন’ নামে পরিচিত। তবে বংশীপাহাড়পুরের পাথর অনেক উৎকৃষ্ট মানের। এই পাথরের একটা বিশেষ গুণ হলাে, এর ওপর জল পড়লে ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি পায় এবং এই পাথর হাজার হাজার বছর টিকে থাকে।
১৯৯০ সালের ২ নভেম্বর মুলায়ম সিংহ যাদবের সরকারের বর্বরােচিত নৃশংসতায় যে সমস্ত নিরীহ করসেবকদের প্রাণ সংহার হয়েছিল তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে অযােধ্যায় একাংশের নামকরণ করা হয়েছে ‘করসেবকপুরম। সেখানেই স্থাপিত হয়েছে। ‘রামজন্মভূমি ন্যাস কার্যশালা। পাথর খােদাই এবং মজুত রাখা ছাড়াও সেখানে রক্ষিত আছে। প্রায় ২ লক্ষ ৭৫ হাজার ‘রামশিলা। ১৯৮৯ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের তত্ত্বাবধানে সমগ্র । ভারত এবং বিশ্বের অনেক দেশে নানা ভাষার অক্ষরে ‘শ্রীরাম’ খােদিত রামশিলা (ইট) পূজনের কর্মসূচি গৃহীত হয়েছিল। প্রশাসনিক বহু নির্যাতন সহ্য করে স্থানে স্থানে পূজিত সেই শিলা অযােধ্যায় নিয়ে এসেছিলেন। অদম্য মনােবলের করসেবকরা। এখন সেইসব শিলাও রামমন্দিরে ব্যবহার করা হবে।
সকলেই জ্ঞাত আছেন যে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ১৯৮৮ সালেই রামজন্মভূমি মন্দিরের একটা সর্বসম্মত নকশা (মডেল) তৈরি করিয়েছিল স্থপতি শিরােমণি চন্দ্রকান্তভাই সােমপুরাকে দিয়ে। সেইমতাে মন্দির হওয়ার কথা ছিল ২৬০ ফুট দীর্ঘ, ২৩৫ ফুট প্রস্থ এবং গর্ভগৃহের চূড়ার উচ্চতা হওয়ার কথা ছিল ১৪১ ফুট। গর্ভমন্দির ছাড়াও আরও ২টো দোতলা মণ্ডপ নির্মাণের কথা ছিল সেই মডেল। ঠিক ছিল মােট ২১২টা স্তম্ভের ওপর নির্মিত হবে গােটা মন্দির। কিন্তু গত ৫ আগস্ট ভূমিপুজো এবং ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের প্রাক্কালে তার কিছু পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করা হয়েছে। এখন যেমন্দির হবে তার ক্ষেত্রফল হবে ১২০ একর। মন্দিরের দৈর্ঘ্য হবে ৩০০ ফুট, প্রস্থ ২৮০ ফুট এবং সঙ্গত কারণেই গর্ভমন্দিরের চূড়ার উচ্চতা ২০ ফুট বাড়িয়ে হবে ১৬১ ফুট।
গর্ভগৃহ ছাড়াও ধাপে ধাপে নির্মিত হবে আরও ৪টে মণ্ডপ। পুরাে মন্দির হবে ৩ তলা। দেবদেবী যক্ষ-যক্ষিণী এবং মঙ্গল কলস ইত্যাদি নানা কারুকার্য খচিত মােট ৩২০টা স্তম্ভের ওপর নির্মিত হবে নতুন রামজন্মভূমি মন্দির। প্রত্যেকটা স্তম্ভের উচ্চতা হবে ১৬ ফুট করে এবং তাদের বেড় হবে ৬ ফুটের। প্রধান তােরণ হবে শ্বেত পাথরের। তােরণদ্বার ব্যতিরেকে মন্দিরে মােট ৫টা প্রবেশ দ্বার থাকবে। তার দুটো থাকবে সরযূ নদীর দিকে। বিগ্রহ রামলালাকে প্রদক্ষিণ করার জন্য গর্ভগৃহের চারিদিকে ১০ ফুট চওড়া পরিক্রমা পরিসরও থাকবে। মন্দিরের চূড়ায় শােভা পাবে সােনার কলস এবং তার ওপর সােনার ধ্বজদণ্ডের মাথায় ঝলমল করতে থাকবে প্রভাত সূর্যরশ্মির মতাে সুবর্ণ-গৌরিক পতাকা। লাকিরামের মতাে কারুশিল্পীরা দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে অন্তর থেকে বিশ্বাস করে এসেছেন যে একদিন না একদিন রামজন্মভূমি মন্দির মাথা তুলে দাঁড়াবেই দাঁড়াবে। রামলালা যেখানে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন সেখানে সুরম্য মন্দিরে তার পুনরাধিষ্ঠান ঘটবেই ঘটবে। যত বাধাবিপত্তিই আসুক একদিন সেসব কপূরের মতাে উবে যাবে।রাতের অন্ধকার কেটে গিয়ে সূর্যের আলাের মতাে একদিন রামমন্দিরের আত্মপ্রকাশ ঘটবেই। ভগবান ভক্তাধীন। রামভক্ত লাকিরামদের সেই মনােবাঞ্ছার বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এখন আর হাতে বেশি সময় নেই। রামজন্মভূমি ন্যাস কার্যশালায় কে এল কে গেল, কে দেখল কে দেখল না এসব দিকে হৃক্ষেপ করারও অবসর নেই তাদের। মাথা নিচু করে, দিনরাত একমনে ছেনি-হাতুড়ি চালিয়ে নিপ্রাণ পাথরের বুকে প্রাণবন্ত নকশা খােদাই করে যাচ্ছেন।
দুর্গাপদ ঘােষ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.