সাম্প্রতিক সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল, বিভিন্ন ওয়েবসাইট বা নিদেনপক্ষে সংবাদ বিতরণকারী যে কোনো মাধ্যমে চোখ রাখলে বা কান পাতলেই এক ধরনের তীব্র বিরক্তির উদ্রেক হচ্ছে নয়তো-বা তুমুল উত্তেজনার অনুভূতি ঘিরে ধরছে। এই ক্ষুরধার সংবাদপ্রবাহ কিন্তু একটা বিষয়ে সাহায্য করছে তা হলো অতীত অভিজ্ঞতাগুলিকে ঝালিয়ে নেওয়ার। প্রত্যেক প্রজন্মেরই সময়কে নতুনভাবে যাচাই করার প্রবণতা দেখা যায়, আবার অনেক সময়ই সে প্রচেষ্টায় অতীতের ভুলগুলিরই পুনরাবৃত্তি হয়। অবশ্যই মনুষ্য জীবনের এ-ও এক অভিজ্ঞতা যাকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না।
মাসখানেক বা তার কিছু আগে যখন থেকে দেশের এক শ্রেণীর লোক ভারতীয় নাগরিকত্বের মধ্যে অসাধারণ কিছু গুণাবলী হঠাই আবিষ্কার করল তারই সমান্তরালভাবে ছাত্রদের মধ্যেও আচমকা এনিয়ে তৎপরতা উৎসাহ দেখা দিল। যদিও এই পড়ুয়া-বিক্ষোভে বাড়তি ভূমিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে যাদের সন্দেহ করা গিয়েছিল ঠিক তারাই প্রথম দর্শন দেয়। যেমন জেএনইউ, যাদবপুর বা আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়। তারা বরাবরের মতো আবার প্রমাণ করেছে যে তারা প্রচণ্ড অশান্ত ও হিংস্র প্রতিবাদে বিশ্বাসী। কিন্তু কিছুটা অবাক হওয়ার ও উদ্বেগের কারণটা হলো, এই ধরনের বিক্ষোভের একটা ছোঁয়াচে চরিত্র আছে। এর হাতেনাতে প্রমাণ পেলাম যখন শুনলাম আমার শিক্ষা শুরুর দিনের দিল্লির St. Stephen’s College-এর ছাত্ররা ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা অংশটি ভালো করে পাঠ করার জন্য একদিনের ক্লাস বয়কট করেছে।
কলেজের AllnuttLawn-এ পৌঁছে সেখানে ‘আজাদি’র কী মহিমা তা তারস্বরে ঘোষণা করেছে। এ সম্পর্কে একটি শব্দই আমার মাথায় আসছে তা হলো উল্লেখযোগ্য। এই ঘটনা আমাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ১৯৭৫ সালের একটি অতীত প্রেক্ষিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ১৯৭৫ সালের প্রথম দিকে আমাদের মধ্যে কয়েকজন বেশ রাত্তির অবধি বিভিন্ন ক্লাসে ঘুরে ঘুরে জয়প্রকাশ নারায়ণকে দেওয়ার জন্য টাকা তুলছিলাম। কেননা জয়প্রকাশ নারায়ণের পরের দিন সকালেই মউরিস নগরে এক সভায় বক্তৃতা করার কথা ছিল।
কিছুটা অবাক করে দিয়েই বহু সংখ্যক ছাত্রই ১ টাকা বা ২ টাকা করে সেদিন দিয়েছিল। ভাবা যায় তখনকার দিনে সাকুল্যে ২০০ টাকার মতো এক রাজকীয় অঙ্কের টাকা সংগৃহীত হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে বিশেষ করে ১৯৭০ সাল নানা কারণেই ছিল বেশ উল্লেখযোগ্য। সে সময় চরমপন্থী কোনো ভাবধারা লালন করা ছিল যথেষ্ট fashionable। এই চিন্তার উৎসে ছিল একটি আন্তর্জাতিক স্রোত। সে সময় ভিয়েতনামে আমেরিকার জড়িয়ে পড়া নিয়ে পাশ্চাত্যের বহু বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্রদের এক ধরনের উত্থান শুরু হয়। এই পটভূমিতে আসার St. Stephens-এ ঢোকার কয়েক বছর আগেই বেশকিছু নিঃসন্দেহে অতি উজ্জ্বল ছাত্র আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী নিয়ে এতটাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছিল বিশেষ করে চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা লোটাকম্বল নিয়ে ট্রেন ধরে বিহারে গিয়ে পৌঁছয়। সেখানে তারা সরাসরি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায়। সেখান থেকে কোনো অভিযান পরিচালনা করার পরিকল্পনা ছিল তাদের। দুর্ভাগ্যবশত যে গরিব কৃষকদের মঙ্গলার্থে তাদের এই যাত্রা তারাই ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান” এই স্লোগান শুনে হতিচকিত হয়ে তাদের উন্মাদ বা ভূতগ্রস্ত বলে তেড়ে যায়। এই বিপ্লবীরা হতোদ্যম হয়ে ফিরে আসে। অনেকে কেমন। একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে যায়। পড়াশোনায় মন বসানো দূরস্থান, অনেকে অবসাদে এক বছর ড্রপ পর্যন্ত করেছিল। এই St. Stephens-এর ‘নকশাল’রা যথেষ্ট ভাগ্যবান ছিল। এদের বেশিরভাগেরই অভিভাবকরা মোটামুটি কেষ্টবিষ্টু হওয়ায় যথোপযুক্ত যোগাযোগ ঘটিয়ে বড়ো কোনো গাড্ডায় পড়া থেকে বাঁচিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু যাদবপুর ও প্রেসিডেন্সির যে সমস্ত পড়ুয়া fascist রাজ্য-শক্তির বিরুদ্ধে মুক্তি যুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন তাঁরা অতটা ভাগ্যশালী ছিলেন না।
এঁদের মধ্যে অনেকে ‘এনকাউন্টার’-এ নিহত হয়। আবার অনেকেই বহু বছর জেলের ভয়ংকর পরিবেশের মধ্যে অতিবাহিত করতে বাধ্য হয়। এদের সকলেরই ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যায়। উলটো দিকে সাধারণ ছাত্রদের ওপরও এর রেশ পড়ে। অনির্দিষ্টকালের জন্য কলেজ বন্ধ থাকায় পড়াশোনার অপূরণীয় ক্ষতি হয়। বারবার পরীক্ষা পিছিয়ে যেতে থাকে। অনিচ্ছাকৃতভাবে তাদের শিক্ষা বিলম্বিত হয়ে পড়ে। বস্তুত পশ্চিমবঙ্গের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা সেই যে মুখ থুবড়ে পড়ে তারপর সেই অস্থিরতা থেকে আর সেভাবে বেরিয়ে আসতে পারেনি।
ছাত্রদের এই লাগামছাড়া অতি সক্রিয়তার মূলে রয়েছে পাশ্চাত্য থেকে আমদানি করা এক জটিল ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিশ্বাস। এই প্রসঙ্গে লেনিনের পর্যবেক্ষণ যে শ্রমিকশ্রেণীই হবে বিপ্লবের ধ্বজাধারী, তারাই হবে উদ্গাতা এই তত্ত্ব বর্তমান পাশ্চাত্য পণ্ডিতরা খারিজ করে দিয়েছেন। পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে তাদের উপলব্ধি যে প্রবল ‘ভোগবাদ’ শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লব করার আন্তরিক তাগিদটাই ধ্বংস করে দিয়েছে। উন্নত দেশগুলিতে তারা আর এসবে উৎসাহী নয়। তারা বর্তমানে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়। এই কারণে এখন বিপ্লবী পরিবর্তন আনার দায় বর্তেছে। ছাত্রদের ওপর। এই বিপ্লবী ছাত্ররা তথাকথিত অত্যাচারিত সংখ্যালঘুদের সঙ্গে নিয়ে বিপ্লব ত্বরান্বিত করবে।
এখানেই তাৎপর্যপূর্ণভাবে লক্ষণীয়, ৬০-এর দশকের শেষভাগের বামপন্থীদের কার্যকলাপ ও দৃষ্টিভঙ্গি কীভাবে আজকের ভারতে আবার মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে। বাম মহাপণ্ডিতরা আজ তাদের সেই বিপ্লবী নামধারী অধরা ঈশ্বরকেই যেন প্রত্যক্ষ করছেন এই বিক্ষোভরত ছাত্রদের মধ্যে। এদের মধ্যেই সঠিক বিরোধী রাজনৈতিক দলের অভাবে তাঁরা ‘fascist মোদী সরকারের উপযুক্ত লড়াকু বিপ্লবী অবতার আবিষ্কার করেছেন। দলিত ও মুসলমানদের মতো অত্যাচারিত সংখ্যালঘুদের নিয়ে এই ছাত্ররাই নাকি সংবিধানের সেই হৃত মর্যাদা পুনরুদ্ধার করবে। একই সঙ্গে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার ক্ষয়কেও তারাই আটকাবে। আশা বহুবিধ।
বলা বাহুল্য, এবারও এই কৌশল পশ্চিম থেকেই আমদানি হয়েছে। আমেরিকায় ডেমোক্রেটিক দলের বামপন্থার দিকে বাড়তি ঝোঁক, অন্যদিকে ব্রিটেনে লেবার পার্টির বামমুখীনতাই এখানকার বামনেতাদের ইন্ধন জুগিয়েছে। পড়ুয়ারা সব বিষয়েই তাৎক্ষণিক উত্তেজনা খোঁজে। চলতি ধারা থেকে সরে গিয়ে নিজেকে অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র হিসেবে তুলে ধরার মানসিকতা থেকেই বিকল্প জীবনযাপনের ধরন অনুসরণ তাদের আকর্ষণীয় মনে হয়। কেননা সাময়িকভাবে তা কিছুটা মাদকতাময়।
পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ চালানোর মধ্যে নিশ্চিত এক ধরনের বীরত্বের স্বাদ পাওয়া যায়। তাছাড়া আজকের আধুনিকতা-উত্তর (Post modern) বিশ্ব সংক্রান্ত কোনো জ্ঞান চলতি রাজনীতিকদের অতি ক্ষীণ। অনেক সময় তা নেই বললেই হয়। এমনটাই তারা মনে করে। শুধু তাই নয়, অনেক সময়ই ‘কবিতার মাধ্যমে পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যা মিটিয়ে দেওয়া যায় এমন এক আত্মম্ভরি বিলাসও তাদের মধ্যে ক্রিয়াশীল থাকে। যার ফলে তারা ভিন্নমত পোষণকারীদের পাক্কা গাড়ল ভাবতে ভালোবাসে।
প্রতিবাদের একটা নিজস্ব রোমান্স তো আছেই। তবে সমস্যাটা হচ্ছে এই তো প্রথম নয়, এই প্রকৃতির বিক্ষোভ অতীতেও চেষ্টা করে দেখা হয়েছে। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হয়েছিল মোহভঙ্গ শেষে তজ্জনিত আক্রোশ। লেনিন যা বলেছিলেন, বড়ো কোনো খেলায় নামতে গেলে এই ধরনের কিছু প্রয়োজনীয় গাড়লদের’ও (useful idiots) দরকার পড়ে। ধীরে হলেও এ বিষয়ে যতই আত্মোপলব্ধি হবে মানসিক তিক্ততা তত দ্রুত বাড়বে।
সমগ্র বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে এর একটা হিংসাত্মক প্রতিক্রিয়া হতে পারে। কে জানে, আমরা হয়তো সেই সংঘাতময় পরিস্থিতির অনভিপ্রেত সাক্ষী হতে চলেছি।
স্বপন দাশগুপ্ত
2020-01-17