পশ্চিমবঙ্গে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরবস্থা

‘পরিযায়ী শ্রমিক’ কথাটির মধ্যে পোঁ ধরা মিডিয়াকুলের দৌলতে আমাদের অনেকের ধারণা যে এরা রাজ্যের বাইরে কাজ করতে যাওয়া নিম্নবিত্ত পরিবারের শ্রমিক মাত্র। এই ধারণার বশবর্তী হয়েই জনৈকা সাংসদ সদম্ভ উক্তি করেছেন। তাঁর কথায় দম্ভের প্রকাশ তো হয়েছেই, সেইসঙ্গে উন্মোচিত হয়েছে তাঁর অশিক্ষাও।

সংজ্ঞা অনুযায়ী পরিযায়ী শ্রমিক বলতে আমরা শুধু যে স্কিল্ড ও আনস্কিল্ড লেবারদের বুঝিতা নয়; ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অ্যাকাউন্টেন্ট থেকে ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞরাও আছেন তালিকায়। যাঁরাই নিজভূমি থেকে বেরিয়ে অন্য জায়গায়, রাজ্যে, দেশে-বিদেশে গিয়ে কাজের বিনিময়ে উপার্জন করছেন এবং শিকড়ের টান বজায় রেখে নিজভূমিতে আবাস, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংসার রেখে গেছেন তারা সকলেই ‘পরিযায়ী শ্রমিক’ গোষ্ঠীভুক্ত। এরা এদের উপার্জনের একটা বড়ো অংশ এই রাজ্যে পাঠাচ্ছেন এবং তারাজ্যেই ব্যয়িত হচ্ছে। এদের সকলেরই এই রাজ্যে আস্তানা আছে। রাজ্যের প্রতি এদের দায়বদ্ধতা অন্তত ওই অর্ধশিক্ষিত এমপি-র থেকে অনেক বেশি। এমপি-র সদম্ভ উক্তি সবাইকে জামাই আদর দেওয়া সম্ভব নয়, শুধু দাম্ভিকতার বহিঃপ্রকাশই নয়। বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ’গোছের কথায় তার মালকিন আগেই সুর বেঁধে দিয়েছিলেন- পরিযায়ীদের ফেরার ট্রেনকে ‘করোনা এক্সপ্রেস’ নামকরণ করে। এমপি-র কথায় সেই মানসিকতা লক্ষ্য করা যায় মাত্র। | বিদেশে যেসব পরিযায়ী শ্রমিক গেছেন। তাদের রেকর্ড পাসপোর্ট থেকে পাওয়া গেলেও দেশের মধ্যে যে শ্রমিকরা পরিযায়ী তাদের কোনো রেকর্ড রাখার পদ্ধতির অবর্তমানে কারোর পক্ষে বলা সম্ভব নয় যে রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কত। বিভিন্ন অনুমান ভিত্তিক গবেষণায় যা উঠে আসছে তাতে সংখ্যাটা ষাট লক্ষের উপরে, আশি লক্ষও হতে পারে। এটা শুধু পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকের হিসেব। অনেক টালবাহানার পরে রাজ্য সরকার মাত্র একশো ট্রেনে করে এবং কিছু বাসে ও অন্যভাবে অতি অল্প সংখ্যক শ্রমিককেই রাজ্যে ফিরিয়ে এনেছেন। এদের ফেরার কারণ বহুবিধ। সকলেই কপর্দকশূন্য হয়ে ফিরছেন তা নয়। কিন্তু এদের সঙ্গে সরকারের ব্যবহার, প্রশাসনের উদাসীনতা ও শাসকের সদম্ভ উক্তিতে প্রশাসনিক পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে। জানা যাচ্ছে যে, কর্ণাটক সরকার পরিযায়ীদের কোয়ারান্টিনের মেয়াদ সাতদিন। করেছে এবং যারা পারবেন তাদের জন্য দৈনিক তিন হাজার টাকা ব্যয়ে হোটেলের (৫০ শতাংশের বেশি ভরতুকি) ব্যবস্থা রেখেছেন। তামিলনাড়ু সরকারও ৫০ শতাংশ ভরতুকি রেটে হোটেলের ব্যবস্থা করেছে। পশ্চিমবঙ্গে সবাইকে কোথাও বাথরুমে, কোথাও তাঁবু খাটিয়ে, কোথাও অচল ফ্যান-সহ স্কুলবাড়িতে পরিকল্পনাহীন ভাবে রাখা হচ্ছে। এতে প্রশাসনিক ব্যর্থতাই প্রমাণিত হয়। ডিসিশন মেকিং-এর কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাই এর কারণ বলে মনে হয়। যদিও খাবারের ব্যাপারে সব জায়গায় একই অভিযোগ মান নিয়ে। এটা এই রাজ্যের বৈশিষ্ট্য। সমস্ত স্তরে কাটমানির সগৌরব উপস্থিতিই এর প্রমাণ। দলের কাণ্ডারি নিজেই প্যানিক বোতাম টিপে দেওয়ার ফলে তলার লোকেদের দ্রুত গুছিয়ে নেওয়ার পালা শুরু হয়েছে। আজকের পশ্চিমবঙ্গে কলকারখানা প্রায় বন্ধ। কাটমানির চাপে ব্যবসা বাণিজ্য রুগ্ন। চাহিদার অভাবে প্রাইভেট শিক্ষা ব্যবস্থা শিল্পও এ রাজ্যে রুগ্ন। নতুন বাণিজ্যের বিকাশ স্তব্ধ। নতুন হাসপাতাল ও কলেজ খোলার নামে নীল-সাদা রঙের বাড়ি হয়েছে। না আছে infrastructure of logistic support | এখানে শাসক পরামর্শকে ধৃষ্টতা মনে করে, অভিজ্ঞতা মূল্যহীন, মূল্যবান চাটুকারিতা ও আনুগত্য। এর অবিসংবাদী ফল আজকের পশ্চিমবঙ্গ। সুতরাং অল্প কিছু স্থায়ী চাকুরে ও অন্য পেশার রোজগেরে ছাড়া সমাজের একটা বড়ো অংশই পরিযায়ী শ্রমিক। মাননীয়া, আপনি এদের কর্মসংস্থাপন করতে সাহায্য করেননি। এরা বাইরে উপার্জনের বড়ো অংশ এই রাজ্যে ব্যয় করেন, সর্বোপরি এরা আপনার রাজ্যের ভোটার। সাহায্য না করুন, এদের অন্তত সম্মান করুন।।

শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ডের কথা আমার মনে পড়ে গেল। বার্মাতে প্লেগের জন্য জাহাজে আগত সকল যাত্রীর কোয়ারেন্টাইন করার কথা সেখানে উল্লেখ করা আছে। কোয়ারেন্টাইন সেন্টারের সেই বর্ণনার ভয়াবহ চিত্রের সঙ্গে একশো বছর বাদে এই রাজ্যের কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে কী মিল! অন্য রাজ্য সরকারগুলি অনেক আগে থেকে তৈরি হয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের শ্রমিকদের ফিরিয়ে নিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সেই সময় অযথা কালহরণ করেছেন। তারপরেও আমরা যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় পরিচায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে অমানুষিক আচরণ করছি। এই কি তাদের প্রাপ্য? | আর একটা কথা গভীরভাবে প্রণিধানযোগ্য। সেটা হলো মহারাষ্ট্র, বিহার, উত্তরপ্রদেশ এরকম কয়েকটি রাজ্য সরকার। তাদের রাজ্যের ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য কর্মসংস্থান প্রকল্প তৈরি করেছে। আমাদের রাজ্যে কি তা সম্ভব ? যদি একশো দিন কর্মসংস্থানের কাজে এদের আনা হয় তবে এমনিতেই চাপে থাকা এই প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়বে। অতঃ কিম্ ? জবাব কি আছে?

এই রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকদের একটা বড়ো অংশ বিশেষ ভাবে শিক্ষণ প্রাপ্ত স্কিল্ড। এরা অন্য প্রদেশে আদৃত। এদের রোজগারের সমস্যা নেই। এই মুহূর্তে করোনা লকডাউনের সমস্যায় এরা একটু মানবিক ব্যবহার সরকারের কাছ থেকে আসা করতেই পারেন।

এবার একটা নতুন দিকের কথা বলব। লকডাউন পরবর্তী কাজকর্ম শুরুর প্রথম পর্যায়ের প্রস্তুতি সারা দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে। এই অবস্থায় কিছু কিছু রাজ্য যেমন তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র ইত্যাদি এর মধ্যেই স্কিল্ডপার্সেন। কিন্তু যাঁরা পরিযায়ী শ্রমিক পর্যায়ভুক্ত তাদের জন্য উচ্চতর ইনসেনটিভ ও বিমা পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। গুজরাট সরকারও একই পথে হাঁটতে চলেছে। এর ফলে লকডাউন প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর পরাবর্তক্রিয়া শুরু হবে। সেই পদ্ধতি শ্রমিক ও রাজ্য দুয়েরই মঙ্গল করবে। করোনা প্রকোপ যত স্তিমিত হবে এই পরাবর্ত ক্রিয়া তত গতি পাবে।ধীরে ধীরে দেশে অর্থনীতিও গতি পাবে।

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের এই বিপুলসংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিক, তাদের পরিবার ও সংবেদনশীল মানুষের একটা প্রশ্ন রাজ্য সরকারের কাছে রয়েই যাবে। যা সংক্ষেপে বললে দাঁড়ায়, খেতে দিতে পারে না, কিল মারার গোঁসাই। রাজ্য সরকারের অপরিণত চিন্তাপ্রসূত, ‘পরিযায়ী শ্রমিক সমস্যার হ্যান্ডিলিং-এর আরও উহাহরণ আছে। সেদিন টিভিতে দেখলাম, উত্তরবঙ্গের এক কোয়ারেন্টাইন সেন্টারের মানুষজনকে আঠারোদিন পরেও ছাড়া হচ্ছে না। সরকারি আধিকারিক বলছেন যে রিপোর্ট আসেনি। এ চরম অব্যবস্থা। এমনকী rt-PCR পদ্ধতিতেও অনেক কম সময়ে কোভিড-১৯-এর টেস্ট করা যায়। আবার কলকাতা কর্পোরেশনের বাথরুমে কোয়ারেন্টাইন করে রাখা লোকজন ও তাদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ টিভিতে দেখেছি। এর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া অবশ্যম্ভাবী। আমি তিনজন প্রবীণ নাগরিকদের কথা বলে এই লেখা শেষ করব। একজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও লেখক যিনি মুম্বাইতে আটকে গেছেন। দ্বিতীয়জনও মুম্বাইতে আটকে গেছেন, তিনি রাজ্যের এক বিরোধী দলের মিডিয়া মুখপাত্র। তৃতীয়জন চেন্নাইতে আটকে গেছেন যিনি বিশিষ্ট সাংবাদিক ও এক বাংলা দৈনিকের প্রাক্তন সম্পাদক। এরা সকলেই কলকাতায় ফিরতে খুবই আগ্রহী, কিন্তু কোয়ারেন্টাইন সেন্টারের ভয়ে ভীত। এখানে হোম-কোয়ারেন্টিনের কোনো নিয়ম নেই। প্রশাসনের ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে। মোটের উপর, রাজ্য সরকারের পরিযায়ী শ্রমিক সমস্যার দৃষ্টিভঙ্গি ও মোকাবিলা যথেষ্ট সমালোচনার দাবি রাখে।

ড. নারায়ণ চক্রবর্তী

(লেখক অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক; পশ্চিমবঙ্গ বায়োটেক ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের ভূতপূর্ব পরামর্শদাতা ও ডিরেক্টর)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.