কেন্দ্র ও রাজ্যে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের সরকার থাকার খেসারত রাজ্যবাসীকে দিতে হচ্ছে

আপাত তুচ্ছ ঘটনা যা অনেকেরই নজর এড়িয়ে যেতে পারে ভবিষ্যতের জন্য তা বড়ােসড়াে অশনিসংকেত ডেকে আনার সম্ভাবনাময়। বিগত এক বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিভিন্ন কলেজগুলিতে আংশিক সময়ের জন্য নিযুক্ত ও অতিথি শিক্ষকদের সরকারের নির্ধারিত (State Aided College Teachers) কলেজগুলিতে পড়ানাে ও বেতন সংক্রান্ত নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই ব্যবস্থায় সরকার সমস্ত আংশিক সময়ের ও অতিথি শিক্ষকদের ইতিমধ্যেই কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা নিয়ােগকে নির্দিষ্ট অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে আইনানুগ ও নিয়মাধীন করেছে।

গবেষক ছাত্র ও শিক্ষা জগতের সঙ্গে জড়িত অনেকেই সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরােধিতা করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, বিগত কিছু বছর ধরে রাজনৈতিক দল হিসেবে তৃণমূলের যে সমস্ত ধামাধরা শিক্ষক কেবলমাত্র রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতেই ইউজিসি-র নিয়মকানুনের তােয়াক্কা না করে কেবলমাত্র অস্থায়ী প্রথায় নিযুক্ত হয়েছিলেন তাদের এইভাবে কেন্দ্রীয় নির্দেশাবলী উপেক্ষা করে স্থায়ীকরণ আদৌ কাম্য নয়। এর পরিণতিতে পশ্চিমবঙ্গের ইতিমধ্যেই ক্ষয়িষ্ণু শিক্ষা ব্যবস্থা একেবারে ধসে পড়বে। তাদের মতে এই এসএসিটি-র প্রথা বলবৎ থাকলে যে সমস্ত স্নাতকোত্তর গবেষকনিষ্ঠাভরে তাঁদের গবেষণার কাজ চালাচ্ছেন বা অনেকেই যাঁরা এম ফিল বা পিএইচডি করে ফেলেছেন, এমনকী যাঁরা কলেজ শিক্ষকদের জন্য নির্দিষ্ট Net বা Set পরীক্ষাতেও সফল হয়েছেন তাঁদের জন্যও বস্তুত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে।

পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সরকার হাল্কা সবুজ শার্ট পরিহিত মূল পুলিশবাহিনীর যে ‘সহকারী দল’সিভিক পুলিশ নিয়ােগের প্রথা চালু করেছে, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়েও তেমনি ‘সিভিক । লেকচারার’ তৈরির এই রাস্তা বের করেছে। আমার ধারণায় আগামী নির্বাচনের সময় এই লেকচারারদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করানাে হবে। তারা বিভিন্ন নির্বাচনী বুথে সরকারি তরফে ভােট পরিচালনার দায়িত্ব পাবেন। এখন অনুমান, ক’জন পােলিং অফিসার হিসেবে কাজ করার সময় তারা কি তাদের স্থায়ী চাকরি দেওয়া। নিয়ােগ কর্তার স্বার্থের কথা ভাববে না?

এই ক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্তগুলি শুধুমাত্র মর্জিমাফিক নেওয়া। অবশ্য এর চেয়েও রহস্যময় শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বোচচ কেন্দ্রীয় ক্ষমতাধারী ইউজিসি-র ভূমিকা। শিক্ষাক্ষেত্র থেকে প্রতিবাদপত্র দেওয়া, সংসদে এ বিষয়ে প্রশ্ন তােলা থেকে সােশ্যাল মিডিয়াতে প্রচার কোনাে কিছুই শিক্ষা নিয়ামক সংস্থাকে টলাতে পারেনি। তারা এ বিষয়ে কোনাে প্রতিক্রিয়া দেওয়া থেকে বিরত থেকেছেন। শুধু তাই নয়, এই মর্মে মামলা রুজু হলে কলকাতা হাইকোর্টে (মামলা এখনও চলছে) ইউজিসি কর্তৃপক্ষের তরফে এসএসিটি যে তাদের নিয়ম ও শর্তাবলী লঙ্ন করেছে এ বিষয়ে কোনাে বিরােধিতা না করে সম্পূর্ণ নীরবতা পালন করেছে। এর মাধ্যমে এমনটাই যেন প্রতীয়মান হচ্ছিল যে পশ্চিমবঙ্গের উচ্চশিক্ষার বিষয়টা তাদের বিচার্যের মধ্যে পড়ে না।।

অবশ্য, জাতীয় প্রেক্ষাপটে এই এসএসিটি এবং তার কাজের পরিধি ও ধারা যদিও তেমন কোনাে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে না। সারা দেশের। উচ্চশিক্ষার ওপর এর প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হলেও এই ক্ষুদ্র বীজাণুর অন্য ক্ষমতা রয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে এটাই বােঝা যায়। দেশব্যাপী কেন্দ্র তার প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিজস্ব নীতি ও কার্যপ্রণালী প্রয়ােগ করতে সক্ষম হচ্ছে না।

অন্যদিকে, দিল্লি ও অন্যান্য অঞ্চলের বেশ কিছু নেতা নরেন্দ্র মােদীর নিজস্ব যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণার সমালােচনায় মুখর হয়ে তার নীতিকেই বানচাল করে দিতে উঠে পড়ে লেগেছেন। অথচ নরেন্দ্র মােদীর গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা পর্যালােচনা করতে গেলে পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাপটটি প্রাসঙ্গিক হতে পারে। এই রাজ্যটির বৈশিষ্ট্য হলাে সেই ১৯৭৭ সাল থেকে আজ অবধি এখানে যে রাজ্যসরকারগুলি ক্ষমতাসীন থেকেছে রাজনীতিগতভাবে তারা সকলেই কেন্দ্রের বিপরীত মেরুর। এই অতি দীর্ঘকালীন রাজনৈতিক বিরুদ্ধ পরিবেশ যেখানে এই বিরুদ্ধাচরণ চরম কুশ্রীতায় পর্যবসিত হতেও দেখা গেছে। কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক স্তরে রাজ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ শিথিল হতে থাকে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত প্রহরার বিষয় থেকে নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের বিভিন্ন প্রকল্পগুলির রূপায়ণের মতাে ক্ষেত্রেও দিল্লি ও কলকাতা পূর্ণ সংহতি রেখে কাজ করেছে এমন উদাহরণ বিরল। উদাহরণস্বরূপ, দিল্লি থেকে রাজ্যকে পাঠানাে প্রয়ােজনীয় নানা বিষয় সংক্রান্ত চিঠিগুলির উত্তর না দেওয়া নিয়মে পরিণত করা হয়েছে। কেন্দ্র থেকে জারি করা বিভিন্ন নির্দেশাবলীকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা আজ এমন স্তরে পৌঁছেছে যেখানে মনে হয় দিল্লিকে হয়তাে পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্র থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে।

ধরুন, ‘আয়ুষ্মন ভারত’, ‘এক দেশ এক রেশন কার্ড’ বা আলােচ্য ইউজিসি-র নিয়মাবলীর পালন সমস্ত ক্ষেত্রগুলিতেই কোনাে সাধারণ ঐকমত্যের সম্ভাবনাই দেখা যায়নি। এইগুলির অস্তিত্বই যেন উবে গেছে। অনেকেই হয়তাে জানেন বিগত ৪০ বছর ধরে রাজ্য থেকে ‘পদ্মশ্রী’ খেতাব পাওয়ার জন্য বিশিষ্ট কোনাে মানুষদের নাম মনােনীত করে পাঠানাে পর্যন্ত হয় না। অথচ মমতা ব্যানার্জি রাজ্যে বিশিষ্টদের সম্মানিত করার একটি সমান্তরাল ব্যবস্থা মােতায়েন করেছেন। যেখানে সীমান্ত প্রহরা নিয়েই বিতর্ক উঠতে পারে সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক সম্মান তাে তুচ্ছ।

এই ধরনের অস্বীকার ও উপেক্ষার প্রবহমান প্রবণতার ফলে বহু ক্ষেত্রেই কেন্দ্রকে অসহায় ও নিরুপায় পরিস্থিতির সামনে পড়তে হচ্ছে। কেননা অজস্র কেন্দ্রীয় জনহিতকর প্রকল্পেরই সর্বশেষ কার্যকরী এজেন্ট তাে রাজ্যই। সেই তাে মাধ্যম যে পথে প্রকল্প রূপায়িত হবে। রাজ্যটিতাে দেশের বাইরে নয়। এই অসহযােগিতার ভয়াবহ পরিণতি দেখা গিয়েছে বহু পরিকাঠামাে উন্নয়নমূলক প্রকল্পের থমকে যাওয়াতে। বহু প্রকল্প দিনের আলাে দেখার আগেই অপমৃত্যুর মুখে পড়েছে। তবুও রাজ্যে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান সরাসরি কেন্দ্র পরিচালিত যেখানে উল্লেখিত প্রত্যক্ষ অবহেলা করার পথ না থাকলেও অসহযােগিতার কোনাে বিরাম নেই। সেই সমস্ত প্রতিষ্ঠানে একটা বিক্ষুব্ধ, মারমুখী পরিবেশ তৈরি করা হয়। কেন্দ্রের প্রথা প্রকরণগুলিকে বিবিধ বাধার সম্মুখীন করে এক ধরনের নীরব গুরুত্বহীনতার শিকার হতে হয়। প্রতিষ্ঠানের বাইরে বিশেষ করে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিরা যেখানে এক ধরনের হতাশাগ্রস্ত অস্বস্তিকর পরিবেশের মুখােমুখি হন। জাতীয় গ্রন্থাগার ও জাতীয় জাদুঘর (মিউজিয়াম) এই আচরণের বলি। প্রতিষ্ঠানগুলি জঙ্গি ট্রেড ইউনিয়ন সমস্যায় জর্জরিত। আর একটি বড়াে উদাহরণ কলকাতা বন্দর। এটির কাজকর্ম সম্পূর্ণভাবে স্থানীয় মস্তান দাদাদের নিয়ন্ত্রণাধীন। কলকাতা বিমানবন্দরের দীর্ঘদিন ধরে উন্নতির অপেক্ষায় থাকা রানওয়ের। মেরামতি আটকে রয়েছে। এর কারণ উড়ান পথের মধ্যে পড়েছে মুখ্যমন্ত্রীর অত্যন্ত কাছের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটি ছােটো প্রার্থনাস্থল।

ওই উপাসনাস্থলে হাত দিলে সংখ্যালঘু শ্রেণীর সংবেদনশীলতায় আঘাত লাগা ও তজ্জনিত কারণে তাদের ভােট সরে যাওয়ার ভয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের উপকারে লাগা বিমানবন্দরের উন্নয়নের কাজ ঝুলে আছে। এই সূত্রে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী একটি ব্যতিক্রম। সেখানে এই অন্যায্য দাপট নেই, কেননা সেখানকার আচার্য প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের এই প্রতিষ্ঠানও দীর্ঘদিন অন্তর্কলহ ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল। যার পরিণতিতে এক পূর্বতন উপাচার্যকে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর জেল পর্যন্ত খাটতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামােয় একটি পারস্পরিক সৌহার্দ্য সম্পন্ন ব্যবস্থা যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা করে। রাজনৈতিক সংহতি ও পারস্পরিক বিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হওয়া জরুরি। এর অন্যথায় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাে কথার কথাই থেকে যাবে। অকেজো হয়ে পড়বে। এই সূত্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সজীব রাখতে কী কী করা উচিত নয় তা অনুধাবন করতে পশ্চিমবঙ্গের উদাহরণ প্রকৃষ্ট।

স্বপন দাশগুপ্ত

(লেখক রাজ্যসভার সদস্য ও বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.