সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল জগদীপ ধনকরের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী ও শাসকদলের কিছু মন্ত্রী-নেতার সম্পর্ক বেশ তিক্ত হয়ে উঠেছে! রাজ্যপালের কিছু মন্তব্য ও কাজ তাদের পছন্দ হয়নি, সেই কারণে তারা তারস্বরে তার নিন্দা করে চলেছেন। ‘অতি সক্রিয়তা’, ‘সাংবিধানিক সীমা লঙ্ঘন, ‘সমান্তরাল শাসন চালু’ ইত্যাদির নানা অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
অভিযোগগুলো যুক্তিপূর্ণ কিনা, সেটা বোঝার জন্য আমাদের সাংবিধানিক ব্যবস্থাটা বুঝতে হবে। তার জন্য দরকার সংবিধান গ্রন্থের মলাট ওলটানো।
এটা লক্ষণীয় যে, রাজ্যপাল কোনো কোনো সময়ে রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে। কিছু বিরূপ মন্তব্য করেছেন। কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই যে, গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন থেকে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় শাসকদলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বিরোধী দলের বিশেষত বিজেপি কর্মীদের গণ্ডগোল চলছে। আজও সেটা বন্ধ করা যায়নি। রাজ্যের মুখ্য শাসক হিসেবে রাজ্যপাল এই নিয়ে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করতেই পারেন। সেটা স্পষ্টতই তার সাংবিধানিক অধিকার। সংবিধান তাকে মূক, বধির ও অন্ধ হয়ে থাকতে আদৌ বলেনি। সংবিধানের ১৫৪ (১) নং অনুচ্ছেদ জানিয়েছে—The executive power shall be vested in the Governor and shall be excercised by him either directly or through officers subordinate to him l’069 0717 ব্রিটেনের Westmsintar model গ্রহণ করায় সাধারণত মন্ত্রীসভাই রাজ্যের শাসন পরিচালনা করেন— রাজ্যপাল নেন উপদেষ্টার ভূমিকা।
তাবলে তিনি কথা বলতে পারবেন না ? তাঁকে ঠুটো জগনাথ হয়ে থাকতে হবে?
বিজেপি মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রিত হয়েই গিয়েছিলেন। সেখানে তাকে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা আটক করে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। রাজ্যপালকে তিনি সেটা জানালে রাজ্যপাল ঘণ্টাখানেক চেষ্টার পর তাকে উদ্ধার করেছেন।
তাতেও শাসকদলের অনেকে ক্ষুগ্ন হয়েছেন। তাদের বক্তব্য ছিল, রাজ্যপালের সেখানে যাওয়াটা উচিত কাজ হয়নি। তার। মানে এমন অরাজকতা চলাই উচিত ছিল ? রাজ্য প্রশাসন ও পুলিশের কাজ তাহলে কী ? রাজ্য পাল তাই প্রশ্ন তুলেছেন— রাজ্য-শাসকদের কাজটা সেক্ষেত্রে কি? ড. এস সি কাশ্যপ মন্তব্য করেছেন, ‘There are certain areas where the Governor may have to use his own wisdom’–(আওয়ার কস্টিটিউশান, পৃ. ২১৫)। মন্ত্রীসভার ভুল-ভ্রান্তি বা ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে তিনি অবশ্যই সেই বিষয়ে। কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করতে এবং পরামর্শ দিতে পারেন।
মনে রাখতে হবে— শপথ গ্রহণে তিনি ঈশ্বরের নামে (‘in the name of God’) অথবা বিবেকের কাছে (solemnly affirm’) জানান যে তিনি সংবিধানকে বা আইনকে রক্ষা করবেন এবং জনগণের কল্যাণের দিকটা (wellbeing) দেখবেন। অন্ধভাবে তিনি শাসকদের ক্রীতদাস হয়ে থাকবেন—এটা তিনি কখনও বলেন না।
সুতরাং তিনি যদি মনে করেন, কোনও ব্যাপারে সংবিধান, আইন বা জনকল্যাণের জন্য তার কিছু বলা বা করা উচিত, তাহলে তিনি তার পরামর্শ দিতেই পারেন—এটাকে অতি-সক্রিয়তা বা কেন্দ্রের হয়ে কাজ করা বলে না।
মাস দুয়েক আগে তিনি শিলিগুড়ি থেকে জেলা সফর শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেখানে শাসকদলের কোনও জনপ্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। তিনি উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় প্রশাসনিক বৈঠক ডেকেছিলেন— তাতে প্রশাসনিক আধিকারিকরাও আসেননি কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞার কারণে।
কিন্তু এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। মন্ত্রীরা তার অধীনস্থ কর্মী (শিবনাথ বনাম সম্রাট প্রিভি কাউন্সিল) অফিসার ও কর্মীরাও তাই। কর্ণধারদের বক্তব্য ছিল— রাজ্য পাল অনুমতি নেননি। আশ্চর্য যুক্তি একটা রাজ্য পাল তো ইচ্ছেমতো রাজ্যের যে-কোনও স্থানে যেতে পারেন। তিনি ইচ্ছেমতো কোনও অফিসারকে ডেকে তথ্য জানতে চাইতেও পারেন । তিনি বিশ্বভারতীর সমাবর্তনে যোগ দেওয়ার পর স্থানীয় বিডিও অফিসে গিয়েছিলেন। এতেও অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আচ্ছা, সংবিধানের দু-চারটে পৃষ্ঠা পড়ে দেখা কি অসম্ভব ব্যাপার?
১৬৩ (১) নং অনুচ্ছেদে কী আছে— সেটা কয়জনে জানে ? বলা হয়েছে— রাজ্যপাল যেসব ক্ষেত্রে তার ‘স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন না, সেইসব ক্ষেত্রেই মন্ত্রীসভা তাকে সাহায্য করবে ও পরামর্শ দেবে। তাহলে বলতেই হবে যে, রাজ্যপালের কিছু স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা আছে। কিন্তু কোনগুলো এই ‘discretionary power’, সেটা সংবিধান জানায়নি, বরং ১৬৩ (২) নং অনুচ্ছেদ অনুসারে সেটা নির্ধারণ করার ভার রাজ্যপালের ওপরেই দেওয়া হয়েছে। যার হাতে এই ধরনের। অনির্দিষ্ট স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা থাকে, তাকে ক্যাবিনেটের হাতের পুতুল বলা যায় কি?
তাছাড়া এটাও বলা যায় না যে, তিনি ক্যাবিনেটের সব পরামর্শ ও সাহায্য (aid and advice) মেনে নিতে বাধ্য। কেন্দ্রেও রাষ্ট্রপতি- মন্ত্রীসভার সম্পর্কটা এমনই ছিল ৭৪ (১) নং অনুচ্ছেদ অনুসারে। তিনি ১৯৭৬ সালে সংবিধানের ৪৬তম সংবিধানের সংশোধনের মাধ্যমে বাধ্যবাধকতা আনা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি তার ক্যাবিনেটের পরামর্শ শুনতে এখন বাধ্য— এখন তিনি অনেকটা rubber stamp
কিন্তু রাজ্যস্তরে তেমন কিছু হয়নি। তাহলে কে রাজভবনের ঘুমন্ত শাসক বলা যায় কী করে? এই জন্যই ড. বি.সি. রাউত লিখেছেন, ‘The Governor is not a mere figurehead’– (ডেমোক্র্যাটিক কনস্টিটিউশন অব ইন্ডিয়া, পৃ. ২২২)। আর এম.ভি. পাইলি মন্তব্য করেছেন, রাজ্য শাসনে রাজ্যপাল একটা vital role’নিতে পারেন— তিনি আদৌ এক নিষ্ক্রিয় শাসক নন— (অ্যান ইন্ট্রোডাকশান টু দ্য কনস্টিটিউশান, পৃ. ২০৪)।
এটা মনে রাখতে হবে যে, ১৯৫৯ সালে কেরলের রাজ্যপাল মন্ত্রীসভা আনিত ‘কেরল এডুকেশন বিল’-এর একটা অংশ নিয়ে আপত্তির কারণে সেটা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর সন্দেহ যুক্তিপূর্ণ বলেই সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল, ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ধর্মবীর মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জিকে বরখাস্ত করেছিলেন এবং কলকাতা হাইকোর্ট সেটাকে বৈধ বলেই রায় দিয়েছিল (শর্মা বনাম ঘোষ)। ১৯৬৯ সালে তিনি মন্ত্রীসভা লিখিত অভিভাষণের দুটো অনুচ্ছেদ বাদ দিয়ে পড়েছিলেন সঙ্গত কারণেই। কোনো দল বা গোষ্ঠী একক গরিষ্ঠতা না পেলে রাজ্যপাল মন্ত্রীসভা গঠনে সক্রিয় ভূমিকাও নিতে পারেন— (জি.এস. পাণ্ডে— কনস্টিটিউশানাল ল অব ইন্ডিয়া, পৃ. ২৪০)। একবার মধ্যপ্রদেশের রাজ্যপাল বিধানসভার ভাষণ দেওয়ার সময় জনৈক সদস্যকে বহিষ্কৃত করেছিলেন অভব্যতার কারণে। তাছাড়া মুখ্যমন্ত্রীর দলে বা কোয়ালিশন সরকারে ভাঙন দেখা দিলে রাজ্যপাল বিধানসভা ভেঙে মুখ্যমন্ত্রীকে আস্থা প্রমাণের জন্য নির্দেশ দিতে পারেন, কারণ তাকে দেখতে হবে—তাঁর সরকারের গরিষ্ঠতা আছে।
আরও বড়ো কথা হলো—- কেন্দ্রে রাষ্ট্রপতিকে সরানোর জন্য মন্ত্রীসভা সংসদে ‘ইমপিচমেন্ট’-প্রস্তাব আনতে পারে (৬১ নং অনুচ্ছেদ) তাতে অন্তত দুই তৃতীয়াংশের সমর্থন থাকলে রাষ্ট্রপতি পদচ্যুত হন। কিন্তু রাজ্যপালের ক্ষেত্রে এই ধরনের ব্যবস্থা নেই– রাষ্ট্রপতির হাতেই রয়েছে এই ক্ষমতা। কিন্তু রাজ্যপাল মন্ত্রীদের সরিয়ে দিতে পারেন, কারণ ১৬৪ (১) নং অনুচ্ছেদে আছে–‘Ministers shall hold office during the pleasure of the Governor। অবশ্য সংসদীয় ব্যবস্থায় মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া রাজ্যপাল কোনও মন্ত্রীকে বরখাস্ত করতে পারেন না। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীকে সরাতে গেলে তিনি সেটা সরাসরি করতে পারেন, কারণ মুখ্যমন্ত্রীও একজন Minister।
এই সব কারণে ড. হরিহর দাস মন্তব্য করেছেন, ‘The Governor is not a sipher’— (ইন্ডিয়া, ডেমোক্র্যাটিক গভর্নমেন্ট অ্যান্ড পলিটিক্স, পৃ. ২৭৪)।
একটা কথা মনে রাখতেই হবে, মুখ্য রচয়িতা ড. বি. আর. আম্বেদকর সংবিধানের শেষেInstrument of institutions’নামে একটা অধ্যায় রাখতে চেয়েছিলেন—তাতে ছিল রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপাল কোন পরিস্থিতিতে কী করবেন। সেটা থাকলে তাদের ক্ষমতা সুনির্দিষ্ট হয়ে যেত। কিন্তু সেটা পরে বাদ গেছে। এই সব কারণে এস. এল, সিক্রি লিখেছেন, পদটা আদৌ ‘decorative emblem’ নয়— (ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্ট অ্যান্ড পলিটিক্স, পৃ. ২৩৬)। ড. বিদ্যাধর মহাজনও এই বিষয়ে একমত। তার ভাষায়—রাজ্যপাল is an essential part of the constitutional machinery'(দ্য কস্টিটিউশন অব ইন্ডিয়া, পৃ. ২৮২)।
অবশ্য আমি যেমন সংবিধানের ব্যাখ্যাকর্তা নই, তেমনি মন্ত্রী-নেতারাও নন। কাজটা উচ্চ আদালতের। তবে আপাতত মনে হয়, ক্ষমতার মোহে তাদের অনেকেই মনে করেন, রাজ্যপাল তার অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করে চলেছেন। অবশ্যই পরিস্থিতি অনুসারে রাজ্যপাল তার নেপথ্য বাস ছেড়ে পাদপ্রদীপের আলোয় আসতে পারেন।
ড. নির্মলেন্দু বিকাশ রক্ষিত
2019-12-05