সংবিধানসম্মত নাগরিকত্ব আইন বিরোধীদের ছলনায় অবরুদ্ধ

দেশব্যাপী ব্যাপৃত বিরোধী দলগুলির কপট বিক্ষোভগুলি বাদ দিলে সাম্প্রতিক নাগরিকত্ব সংশোধন আইন দীর্ঘদিন ধরে কাঙ্ক্ষিত এক বিরাট সংখ্যক শরণার্থীদের একটি দেশের নাগরিক হওয়ার মর্যাদা দিয়েছে। একই সঙ্গে আইনটি তৈরির সময় যাবতীয় সাংবিধানিক নৈতিকতার প্রশ্নকেও মাথায় রাখা হয়েছে। বাজারে এই আইনের বিরুদ্ধে প্রধানত দুটি কুৎসা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

প্রথমত, এটি বিভেদমূলক কেননা আইনটি ৬টি বিশেষ ধর্মের লোকেদের জন্য ভারতীয় নাগরিকত্বের দরজা খুলে দিলেও হয়তো একই ধরনের সমস্যায় পড়া মুসলমানদের বাদ দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, এটি খেয়ালখুশিমতো করা হয়েছে, কেননা ধর্মীয় নীপিড়নের কারণে মাত্র বিশেষ তিনটি দেশের শরণার্থীদেরই আওতাধীন করা হলেও অন্য প্রতিবেশী মায়নামার বা শ্রীলঙ্কার কথা ভাবা হয়নি।

এই বৈষম্যের অপবাদ দেওয়ার হেতু ইসলামি দেশগুলি কেবলমাত্র অমুসলমানদের ওপরই অত্যাচার চালায় না তারা নিজ ধর্মেরই আহমেদিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায়কেও ছাড়ে না। কিন্তু এ প্রসঙ্গে ঘোরতর অপরাধী পাকিস্তানের ওপরই জোর দিতে হবে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রথম বিধান পরিষদে জিন্নাহ তার বক্তৃতায় পাকিস্তানকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান উপহার দেওয়ার ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর লিয়াকত আলি খান মার্চ ১৯৪৯ সালের পাকিস্তান অ্যাসেম্বলিতেobjective resolution’অনুমোদনের মাধ্যমে অচিরে পাকিস্তানে ইসলামীয় ধাঁচার ধর্মীয় সংবিধান তৈরির ব্যবস্থা করেন। তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে এই প্রাথমিক প্রস্তাব’কে সে সময় আহমেদিয়া ও শিয়া উভয় বিশ্বাসের অনুগামীরাও সমর্থন করেছিল।

এই প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর থেকেই অমুসলমানদের ওপর নেমে আসে জঘন্য অত্যাচার কিন্তু সে সময় শিয়া ও সুন্নিরা ছিল অলস-দর্শক। চলতেই থাকে সংখ্যালঘু নিকেশ, পলায়ন ইত্যাদির যার পরিণতিতে বর্তমান পাকিস্তানে (বাংলাদেশ নয়) সংখ্যালঘুর সংখ্যা ১.৫ শতাংশে নেমেছে। বোঝাই যাচ্ছে বিধর্মীদের নিয়ম করে ধ্বংস সম্পূর্ণ করার পর একটি সংখ্যাগুরুত্বের ভিত্তিতে গৃহীত ধর্মীয় সংবিধান অনুযায়ী এবার আরও কড়া হয়ে শাসক নিজ ধর্মেরই তুলনামূলক কম কট্টরপন্থী অংশের দিকে নজর ঘোরায়। পরিণতিতে সম্প্রদায় দুটি প্রায় ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার শিকার হয়।

এদিকে ভারতে সংশোধিত আইনের বিরোধীরা দেশ ও জাতিকে তারা যে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানে বাস করে একথা স্মরণ করিয়ে দিতে কখনও ক্লান্ত হচ্ছে না। এ থেকে একটা প্রশ্ন উঠে আসে যে, এই নিপীড়িত (আহমেদিয়া)-রা যেহেতু তাদের দেশের ধর্মীয় সংবিধানের ওপরই নিঃশর্ত আনুগত্য প্রদর্শন করত ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি তাদের কোনো দায়বদ্ধতা ছিল না ও চোখের সামনে অমুসলমান সংখ্যালঘুদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে দেখেও তারা কোনো প্রতিবাদ করেনি। সুতরাং যদি বলা হয় তাদের ভারতের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকার করে সংসদ সংবিধানের সঙ্গে কোনো অন্তর্ঘাত করেনি, সেটা কি ভুল?

দ্বিতীয়ত, ২০১১ সালের জনগণনায় ভারত সরকার এই আহমেদিয়া সম্প্রদাভুক্তদের মুসলমান ধর্মাবলম্বীদেরই একটা অংশ বলে নথিভুক্ত করেছে। অন্য মুসলমানরা কিন্তু এদের মুসলমান বলে মনে করে না। সেই সঙ্গে এদের ওপর অকথ্য নির্যাতন ও সব ধরনের হিংসাত্মক আক্রমণ চালায়। জামিয়া মিলিয়া ও আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভরত ছাত্ররা কিন্তু একবারও প্রকাশ্যে ঘোষণা করেনি যে তারা আহমেদিয়াদের মুসলমান ধর্মাবলম্বী বলেই মনে করে।

একথা অস্বীকার করা যায় না ভারতে সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় সর্বক্ষেত্রেই মুসলমান নেতৃত্বের একটা বড়ো অংশ আহমেদিয়াদের কেবলমাত্র ধর্মচ্যুতই মনে করে না, তারা ভারতে এদের বসবাসটাই বন্ধ করে দিতে চায়। এ উদ্দেশ্যে সফল হতে তারা এদের বিরুদ্ধে সবরকম নির্যাতনমূলক ও চরম হিংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে যায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে আহমেদিয়াদের নতুন করে এদেশে নাগরিকত্ব দিয়ে ডেকে আনা দেশের পক্ষে একধরনের সম্প্রদায় গত গৃহযুদ্ধ আহ্বান করারই শামিল। ভারত সরকারের দেশে নিরাপত্তা বিঘ্নকারী এমন কোনো কাজে হাত দেওয়াই হবে বিপজ্জনক। তাই এ প্রসঙ্গে আলোচনা অযৌক্তিক। পার্শ্ববর্তী দেশ মায়নামারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর অত্যাচার ও শ্রীলঙ্কায় তামিলদের হত্যাকে আমল না দিয়ে তাদের এই আইনের পরিধি থেকে বাদ দিয়ে সংবিধান নিয়ে তামাশা করা হয়েছে, এটা অভিযোগ।

মায়নামার তাদের দেশেই রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকার করেছে। তার কারণ তারা মনে করে রোহিঙ্গাদের আদি বাসভূমি বাংলাদেশ। ১৮২৪ সালে ইংরেজের শ্রম আইনের বলে তারা সাময়িক কাজকর্মের জন্য তৎকালীন বার্মায় এসেছিল। মায়নামারে অন্য বহু মুসলমান। রয়েছেন যারা মায়নামারের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসী যার মধ্যে রাখাইন রাজ্যটিও আছে। এই মুসলমানরা কিন্তু জাতিগতভাবে রোহিঙ্গাদের থেকে আলাদা। এঁরা বার্মিজ ভাষাতেই কথা বলেন ও কোনো ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার নন। তাই রোহিঙ্গা সমস্যার উৎস কোনো বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও মুসলমানদের সংঘর্যের কারণে নয়। তাই বিষয়টি নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের আওতায়ই পড়ে না। নতুন আইনটি কেবলই মাত্র ধর্মীয় নির্যাতনের কারণে প্রাণ বাঁচাতে। পালিয়ে আসা তিনটি দেশের নির্দিষ্ট সংখ্যালঘু মানুষদের লক্ষ্যে।

এছাড়া রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের মধ্যে Arakan Rohingiya salvation Army নামে জঙ্গি গোষ্ঠী মায়নামারের সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালাতেও দেরি করেনি। এই ধরনের অতি আগ্রাসী প্রতিক্রিয়া দেখানোর কারণে সরকার ARSA-কে সন্ত্রাসবাদী সংস্থা হিসেবে ঘোষণা করেছে। International Crisis Group (ICG) G711A16376597 ARSA জঙ্গিরা বিদেশে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। ভারতীয় তদন্ত সংস্থার অনুসন্ধান অনুযায়ী এই ARSA সংগঠন পাকিস্তানের আইএসআই, আন্তর্জাতিক জেহাদি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএসআইএস) ও আলকায়দা গোষ্ঠীর মদতপুষ্ট ও পরিচালিত। এই গুরুত্বপূর্ণ অন্ততদন্তে আরও প্রকাশ যে, লস্কর-এ-তৈবা’র মতো সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ভারতে জেহাদি কার্যকলাপ বাড়াতে রোহিঙ্গাদের মতো উগ্রপন্থীদের ভর্তি করতে চাইছে। ভারতের নাগরিকত্ব আইনে মায়নামারকে না রাখার এটাই অন্যতম কারণ। দেশের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি নিরাপত্তা রক্ষার পক্ষে আশঙ্কাজনক।

এবার শ্রীলঙ্কা থেকে ভারতে আগত তামিল উদ্বাস্তুদের প্রসঙ্গ। ২০০৯-এর পর থেকে শ্রীলঙ্কায় তামিল ও সিংহলীদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ জাতিগত দাঙ্গা সম্পূর্ণ মিটে গেছে। সরাসরি পরাজয় ও ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ায় শ্রীলঙ্কায় আজ Liberation of Tamil Tiger Elam (LTTE)-47 alicant অস্তিত্ব না থাকায় সেখানে এখন সুস্থির ও শান্তির বাতাবরণ বিরাজ করছে। এরই ফলশ্রুতিতে অধিকাংশ তামিলই শ্রীলঙ্কায় তাদের ‘হোমল্যান্ডে’ প্রত্যাবর্তন করেছেন। এই ক্ষেত্রে UNCHR(রাষ্ট্রসঙ্ঘের) সংগঠন সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে তাদের সব রকম ভয়মুক্ত করেছে। সুতরাং আলোচ্য আইন থেকে শ্রীলঙ্কাকে বাইরে রাখা একশো ভাগ সঠিক।

উপরিল্লেখিত বিশ্লেষণ থেকে বুঝতে অসুবিধে হবে না যে, নাগরিকত্ব বিল সম্পূর্ণ সংবিধান সম্মত। শুধু তাই নয়, এটি একটি মানবিকতার বোধে উদ্বুদ্ধ আইন। কেননা এটি আমাদেরই দেশে অন্যদেশ থেকে অত্যাচারিত হয়ে নিরুপায় অবস্থায় এসে দুর্দশার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দেশ-হীন পরিচয়ে বাস করা মানুষদের নাগরিকত্ব প্রদানের মানবিক অঙ্গীকার। আইনটিকে কেবলমাত্র নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা সংবিধানের প্রতি নৈতিক দায়বদ্ধতা রক্ষা ও সেই অনুযায়ী নাগরিক নীতি প্রণয়নেরই প্রত্যক্ষ প্রমাণ। প্রত্যেকের প্রতি পূর্ণ সম্মান ও দায়িত্ব নিয়ে জানিয়ে যাই যে, আইনটি আদৌ বিভেদাত্মক নয়, বিভেদাত্মক এর বিরোধীরা।

মহেশ জেঠমালানি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.