বাংলা সিরিয়ালে নারীর ভূমিকাকে দজ্জাল ও হিংসুটে দেখানো হয় কেন? এই প্রশ্ন এখন সকলের। আমরা জানি আমাদের জীবনে ‘মা’ শব্দের অর্থ মায়া, মমতা, স্নেহ, শীতল, ধৈর্য, সহিষ্ণু, আঁচল, রক্ষাকবচ, অন্নপূর্ণা, লক্ষ্মী, চণ্ডী, নির্ভীক, আশ্রয়দাত্রী এইরকম অনেক সমার্থক শব্দ আছে, যা লিখলে শেষ হবে না। যিনি সন্তানের জন্ম দিয়ে কর্তব্য শেষ করেন না। সন্তানকে শিক্ষাদীক্ষায় আসলমান হুশ করে না তোলা পর্যন্ত মায়েদের কর্তব্য থেকে বিশ্রাম নেই! পাশাপাশি পিতার ভূমিকাও সমান। তিনি সংসার চালাতে অর্থ আয়ে ব্যস্ত বলে মায়ের মতো অত সময় দিতে পারেন না বলেই আজ পিতার ভূমিকা নিয়ে কোনো গল্প লেখা হয়। না। তবে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা বলতে মায়ের নাম প্রথমেই উঠে আসে, এটাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
সন্তানকে জন্ম দেওয়া থেকে বড়ো করা, তারপর বিয়ে দিয়ে মা থেকে শাশুড়ি হওয়া প্রতিটি নারীর স্বপ্ন। দেখা যায়, কিছু ক্ষেত্রে বউ মার উপরে ছড়ি ঘোরাতে গিয়ে অধিকাংশই বাড়িতে অশান্তির ছায়া নেমে আসে। অবশ্য সব শাশুড়ি সমান হন না। এরকম অশান্তির ঘটনা দেশের অধিকাংশ বাড়িতেই আকছার ঘটছে। এদিকে ছেলের বউ হওয়া চাই শিক্ষিত, ফুটফুটে সুন্দরী, বাপের একই মেয়ে, আবার বেয়ান বেয়ানি হবেন সাবেকি, খুব আধুনিকতা ছাপ থাকবে এটাও নয় ইত্যাদি চাহিদা। প্রত্যাশা মতো সব আশা পূর্ণ হবার পরেও কিছু অনিচ্ছাকৃত কারণে যখন বনিবনা তলানিতে গিয়ে ঠেকে তখন দোষের সমস্ত দায়ভার বর্তায় গিয়ে ছেলের ঘাড়ে। সংসারে অশান্তি, মা বউমার মুখ দেখাদেখি বন্ধ। ছেলের মাথায় বজ্রাঘাত, কী করবে সে? দেখা যায়, মাকে ডাকলে বউ রেগে আগুন, বউকে ডাকলে মা রেগে আগুন। বাবা নীরব দর্শকের ভূমিকায়, কারণ তিনি দুজনের ইগো বুঝে যান। তার কাছে দুজনেই সমান। আজকাল সমাজে এটাই চলছে। এই হলো সংসার আলাদা হবার কারণ। একমাত্র মেয়ে বাবা-মায়ের আদরের দুলালি কি এত কথা সহ্য করবে। হয় ডিভোর্স দাও, নয় তো সংসার আলাদা কর। এর মাঝে দ্বিতীয় পুত্র বা কন্যা থাকলে তারা ফয়দা নেন। এঁরা মায়ের পাশে দাঁড়াবেন এটাই স্বাভাবিক। কারণ, মা যে তাদের লালন পালন করে বড়ো করেছেন। ঝড়, জল, বজ্র, বৃষ্টি, নানান আঘাত, প্রতিটি প্রতিকূলতা থেকে আগলে রেখে মা সন্তানদের রক্ষা করেন। সেই বিচারের নিরিখে মা যে শ্রেষ্ঠ তা বলতে কোনো দ্বিধা নেই। কিন্তু বউদি তো কোনো ঘরের কন্যা। তার মা তাকে একইভাবে বড়ো করেছেন। তাহলে ওই মেয়েটি বউমা হয়ে পরের বাড়িতে বিয়ের পর এত লাঞ্ছিত হন। কেন? কেন তাকে মেয়ের মতো দেখা হয় না? তাহলে বুঝতে হবে যেহেতু মা তার তিলতিল করে গড়ে তোলা সংসার চট করে বউমার হাতে তুলে দিতে কষ্ট পান। যদি অধিকার কেড়ে নেয়? যদি তাকে আর কেউ পাত্তা না দেয় এই দুশ্চিন্তায় তিনি নিজের ক্ষমতা ছাড়তে চান না। এদিকে বউমাকে শাশুড়ির মন পেতে শাশুড়ির মতো সংসারের সমস্ত দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। ঘরদোর আঙ্গিনা পরিষ্কার করা থেকে কাপড় কঁচা, বাসন মাজা, এমনকী রান্না সমস্ত কিছু করে বিকেলে স্নান সেরে ঠাকুরের পুজোপাঠ করে সকলকে খেতে দিয়ে তারপর বউমা যা পড়ে থাকে তা খান। তাহলেই শান্তি বিরাজ সম্ভব এই ধারণা বউমার মনে হয়। এর মধ্যে পান থেকে চুন খসলে বউমার তো নিস্তার নেই! তাঁকে মা যে কিছু শেখাননি এই কথাও শুনতে হয়। একে সদ্য বিয়ে আসা অন্য ঘরের মেয়ে, সবই অজানা, শ্বশুরবাড়ির হাল হকিকত বুঝতেই বছর গড়াবে, সংসারের ভালো-মন্দ, চাওয়া-পাওয়া, তাঁদের আশা-প্রত্যাশা কার কী রকম ইত্যাদি। কিন্তু দেখা যায় বেশিরভাগ বাড়িতে নতুন বউকে বোঝার সময়ই দেয় না। ফলে সুন্দর ফুটফুটে নতুন বউটির জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। গরিব পরিবারের মেয়ে হলে আত্মহত্যা আর মধ্যবিত্ত ও উচচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে হলে ডির্ভোস। শহর ও গ্রাম বলে কোনো ফারাক নেই। হিন্দু মুসলমান উভয় ক্ষেত্রেই একই।
মহিলারা সব সমাজের মধ্যে নির্যাতিত, লাঞ্ছিত, অপমানিত। আদালতে এরকম কেসের সংখ্যা ভুরিভুরি। সুরাহা সুদূরপ্রসারি। মামলা লড়তে লড়তেমক্কেলের অবস্থা শেষ। মেয়ে পক্ষের ভরণপোষণের দাবি।মুসলমান মহিলাদের অবস্থা তো আরও সঙ্গিন। বিশেষ করে গরিব ঘরের মেয়েদের তালাকের ঘটনা শুনলে চোখে জল আসবেই। একে তো কমবয়সে বিবি, ওই বয়সে তিন চার সন্তানের আম্মী, ওই অবস্থায় তালাক। আদালতের শরণাপন্ন যাতে তাকে বিবির স্থান দেওয়া হয়। কী নিদারুণ পরিহাস? সংসারের ইতিবৃত্ত নিয়ে অনেক গল্প লেখা হয়েছে, নামকরা লেখকের গল্পকে অবলম্বন করে নানা সিরিয়াল, সিনেমা, টেলিফিল্ম তৈরি হয়েছে। এখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মা, ননদ, কাকিমার দজ্জাল ও হিংসুটের চরিত্র রেখে সিনেমা ও সিরিয়ালকে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা করে পরিচালক। এভাবে বাস্তব জীবনের সংসারে অশান্তির বাতাবরণ তৈরি। হয়। পরিবারের সদস্যদের মন বিষাক্ত হয়ে যায়।
মা হওয়া যেমন মুখের কথা নয়, ঠিক তেমনি আদর্শ শাশুড়ি হওয়াও মুখের কথা নয়। আজকাল বাংলা ধারাবাহিকেমা, বউমা, ননদ, পিসিমা, দিদিমার চরিত্রে কাউকে না কাউকে দজ্জাল, হিংসুটে দেখানো হয়। তাই, সংসারে ও সমাজে নেমে আসে ধারাবাহিকের (দজ্জাল ও হিংসুটেপনা) ব্যাধি। সেই সূত্র ধরে চলে মা বউমার দ্বন্দ্ব। পরিচালকরা যদি আজগুলি সিরিয়ালের পরিবর্তেমা বউমাদের মধুর সম্পর্ক সংবলিত সিরিয়াল ও চলচ্চিত্র উপস্থাপন করেন, তা সার্বিকভাবে সমাজকে সুস্থতার পথে নিয়ে যাবে।
রাজু সরখেল
2020-02-13