আগ্রাসনের দিন শেষ, গালওয়ান পর্বে চীনকে বুঝিয়ে দিল ভারত

১৯৬২ এখন অতীত। ফেলে আসা ৫৮টি বছরে গালওয়ান নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। তার সঙ্গেই গালওয়ান উপত্যকায় সমাধি হয়েছে ‘৬২-র ভারতের নেতৃত্বহীনতা, নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা, দুর্বল বিদেশনীতি ও কূটনৈতিক বিফলতা। তার সঙ্গেই দেশের জনমনাসে বিশ্বাস জাগ্রত হয়েছে ২০২০-র ভারতের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের প্রতি, সফল বিদেশনীতি ও কূটনীতির প্রতি, নেতৃত্বের দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার প্রতি। আধুনিক যুদ্ধসরঞ্জাম দেশের সেনাবাহিনীর মনােবল শতগুণ বৃদ্ধি করেছে। দেশ পেয়েছে বিপুল আন্তর্জাতিক সমর্থন। ১৯৬২-র ভারত ও ২০২০-র ভারতের মধ্যে যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য, চীন তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।

২০১৪ সালের পরবর্তী অধ্যায়ে ডােকালাম, গালওয়ান-সহ একাধিক স্থানে চীনা সৈন্যের চোখে চোখ রেখে তাদের অনুপ্রবেশের ছক বানচাল করে দিয়েছে আমাদের সাহসী ভারতীয় জওয়ানরা। ২০২০-র নবভারত বিশ্বশান্তি, সুস্থিতির পক্ষে। কিন্তু শান্তি ভঙ্গ করে কোনাে দেশ যদি ভারত ভূখণ্ডের দিকে হাত বাড়ায়, অনৈতিক অতিক্রম করে আমাদের ভূখণ্ডকে ছিনিয়ে নিতে চায়, তাহলে সেই কালাে হাত গুড়িতে দিতে সমর্থ ২০২০-র নবভারত।

২০১৪-তে মােদীজীর নেতৃত্বাধীন যে সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হয়েছে তারা দেশের অখণ্ডতার সঙ্গে আপােশ করে আর একটি ‘আকসাই চীন’ ও আর একটা পাক অধিকৃত কাশ্মীর’ হতে দেবে না— এই সত্যটা চীন ও পাকিস্তানের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে।

কিন্তু একটা প্রশ্ন অনিবার্য ভাবে অনেকের মনেই দেখা দিতে পারে যে, এই বিশ্ব মহামারীর সময় যখন পৃথিবী জুড়ে জীবন জীবিকা রক্ষায় তীব্র সংগ্রাম দেখা দিয়েছে, পৃথিবীর অন্য দেশগুলাে যখন স্বাস্থ্যপরিষেবার মানােন্নয়ন-সহ মহামারী সংক্রান্ত নানা কর্মপন্থা রূপায়ণে ব্যস্ত, তখন চীন হঠাৎ দেশের ভৌগােলিক ভূখণ্ড নিয়ে এত আগ্রাসী হয়ে উঠল কেন? আপাতদৃষ্টিতে নিয়ে আগ্রাসন মনে হলেও এর পিছনে চীনের গভীর ষড়যন্ত্রের তত্ত্বকেও অস্বীকার করা যায় না। এই প্রশ্নের উত্তর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

প্রথম কারণটি অবশ্যই কূটনৈতিক। বিশ্ব মহামারী সংকট পর্বে চীন যখন সারাবিশ্বকে SARS-Cov-2 ভাইরাস উপহার দিয়েছে, ভারত তখন বিশ্বকে দিযেছে এই মহামারী থেকে বাঁচার ওষুধ হাইড্রক্সিক্লোরােকুইন। সংকটের সময়, করােনা ভাইরাস সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে চীনের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলি অত্যন্ত বিরক্ত। অন্যদিকে মহামারী মােকাবিলায় ভারতের দায়িত্বশীল ভূমিকা আন্তর্জাতিকমহলে প্রশংসিত হয়েছে। সংকটময় মুহূর্তে বিশ্ব দরবারে ভারতের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযােগ্যতায় কূটনৈতিক ভাবে কোণঠাসা হয়েছে চীন। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের জনপ্রিয়তা, গ্রহণযােগ্যতা ও প্রবল আন্তর্জাতিক সমর্থন যে ক্ষমতার বিন্যাস পূর্ব এশিয়ায় চীন থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের দিকে পরিবর্তিত হচ্ছে — তাও বিলক্ষণ জানে চীন। মােদী সরকারের সফল বিদেশনীতির ফলে পূর্ব এশিয়ায় জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ভারতের দৃঢ় কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। ওই অঞ্চলে যে চীন-বিরােধী অক্ষ স্থাপিত হয়েছে তাও শি জিনপিংয়ের কপালে ভঁজ ফেলার পক্ষে যথেষ্ট। ভারতের এই সাফল্যে ঈর্ষান্বিত ও ভীত হয়ে চীন আগ্রাসনের পুরানাে অস্ত্রে সান দিয়েছে।

দ্বিতীয়ত, ভারত, আমেরিকা, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে যে চতুর্দেশীয় সামরিক অক্ষ স্থাপিত হয়েছে, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের দাদাগিরির মােকাবিলায় তা ভীষণ কার্যকরী ভূমিকা নিচ্ছে। QSD বা কোয়াড গােষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির সম্মিলিত সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বিপুল। তাই কোয়াডের উপস্থিতি চীনের অন্যতম মাথাব্যথার কারণ। কোয়াডের আক্রমণ যদি চীনা ভূখণ্ডে নেমে আসে, তাহলে চীন ধূলিসাত হয়ে যাবে।

তৃতীয় কারণটি অর্থনৈতিক। মহামারী-পরবর্তী পৃথিবীতে শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে একটা বড়াে পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। পৃথিবী জুড়ে প্রায় একশােটি বৃহৎ শিল্প ও বাণিজ্যগােষ্ঠী তাদের চীন থেকে সরিয়ে নিতে চাইছে। তাদের অধিকাংশেরই নতুন গন্তব্য ভারত। জাপান। তাদের দেশীয় সংস্থাগুলােকে চীন থেকে বিনিয়ােগ অন্য দেশে সরানাের জন্য বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ দেবার কথা ঘােষণা করেছে। ভারতও ওইসব কোম্পানিগুলির সঙ্গে বিশেষ যােগাযােগ রক্ষা করছে এবং তাদের এদেশে বিনিয়ােগ করার জন্য রাজি করাচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি বিদেশি বিনিয়ােগকারীদের জন্য ‘সেভ কার্পেট’ পেতে দেওয়ার ঘােষণা করেছেন।

এছাড়াও নরেন্দ্র মােদী নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার যেভাবে ভারতীয়দের দেশীয় পণ্য ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছে এবং দেশীয় সংস্থান সম্প্রসারণে, পুনরুজ্জীবনে ও আধুনিকীকরণে বিশেষ আর্থিক প্যাকেজের ঘােষণা করেছে, তাতে চীন প্রমাদ গুনছে। শুধু ভারতই নয়, বিশ্বজুড়ে চীনা পণ্য বর্জনের পক্ষে জনমত তৈরি হচ্ছে। চীনের শিল্প-বাণিজ্য ক্ষেত্র প্রবল ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কা করে, সেদেশের চীনা কমিউনিস্ট পার্টি নেতৃত্বাধীন সরকার ভারতে অস্থিরতা তৈরি করে বিনিয়ােগের পরিবেশ নষ্ট করার অপচেষ্টা করেছে সীমান্ত আগ্রাসনের মধ্যে দিয়ে। চীনের চক্রান্ত ছিল, ভারতে অস্থিরতা তৈরি করতে পারলে বিনিয়ােগকারীরা ভারতে আসবেন না , ফলে ভারত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু ভারতীয় সেনার সাহসিকতা ও মনােবল চীনের চক্রান্তকে বানচাল করে তার আগ্রাসনের সমুচিত জবাব দিয়েছে।।

প্রবল আন্তর্জাতিক চাপ, ভারত সরকারের দৃঢ়তা ও ভারতীয় সেনার সাহসিকতার কাছে মাথা নােয়াতে বাধ্য হয়েছে চীন। এনএসি বা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা থেকে নিজেদের এলাকায় ফিরে গেছে চীনা সৈন্য। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সীমান্ত সংঘাত জিইয়ে রাখাইচীনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। আর তাদের এই ভূমিকার জন্যেই আন্তর্জাতিক মহলে তারা নিন্দিত, সাম্প্রতিক সময়ে যা আরও তীব্র হয়েছে। এই মুহূর্তে ভারত-সহ বিশ্বের অন্যান্য শক্তিধর দেশগুলাের চীন সম্পর্কে যা মনােভাব, তাতে চীনের এই অসভ্যতা তারা আর বেশিদিন সহ্য করবে বলে মনে হয় না। ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ডােকালাম, গালওয়ানের পর এই পদক্ষেপ চীন যতবার করবে, ভারত তার সমুচিত জবাব দেবে। গালওয়ানের সেই অভিশপ্ত রাতে ভারতীয় সেনার পরাক্রম, সরকারের দৃঢ়তা, দেশবাসীর সদর্থক মনাভাব এবং দেশের প্রতি প্রবল আন্তর্জাতিক সমর্থন প্রমাণ করে এই ভারত ১৯৬২-র ভারত নয়, এই ভারত ২০২০-র নতুন ভারত।

ড. সৌমিত্র চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.