ঠনঠনিয়া । সোনার জিভ বের করে মা দাঁড়িয়ে আছেন শিবের বুকে। মন্দির বন্ধ। মায়ের এখন বিশ্রামের সময় হয়েছে।দুপুরে ছাগ বলি হয়েছে। ভক্তের মানত ছিল। মা মামলা জিতিয়ে দিয়েছেন। কারো সর্বনাশ কারো পৌষ মাস । একদল ভিখারি কাপড় বিছিয়ে শুয়ে আছে। মন্দিরে মায়ের ঘুম ভাংলে উঠে বসবে। কিছু পয়সা পরবে মায়ের কৃপায়।
একজনের গানের গলা আছে। ভক্তি ও আছে । তবে সে ভিখারি নয়, বৈরাগী। তিনি গাইছেন,
“তোমার কি মা বুঝবে লীলে
তুমি কি নিলে কি ফিরিয়ে দিলে ?
তুমি দিয়ে নিচ্ছ তুমি, রাখো না সাঁঝ সকালে।
তোমার অসীম কার্য অনিবার্য মাপাও যেমন যার কপালে।”
অল্প দূরে ছোট্ট একটি দোকান ।মধ্যবয়সী এক বিধবা মহিলা মুড়ি মুরকি বিক্রি করছেন। ঠাকুরদাস দোকানটির সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন। মুড়ি মুরকি ,কদমা, বাতাসা- মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ…
ঠাকুরদাসের পেটে আগুন জ্বলছে। দোকানের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছেন ঠাকুরদাস। ট্যাকে একটা আনা কড়ি নেই যে কিছু কিনে খাবেন।
তাকে ওই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দোকানের বিধবা মহিলা জিজ্ঞেস করলেন; ” বাবা ঠাকুর দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
ঠাকুর দাস বললেন , “খুব জল তেষ্টা পেয়েছে একটু জল দেবে মা?”
মহিলা সাদরে, সস্নেহে ঠাকুরদাস কে দোকানের ভেতর নিয়ে গেলেন বললেন , “বস বাবা, বস। আমি জল দিচ্ছি।”
ব্রাহ্মণের ছেলে কে তো শুধু জল দেওয়া যায় না ,প্রথমে তাই এক মুঠো মুরকি দিলেন । সামনে রাখলে এক ঘটি জল ।তিনি দেখছেন ব্রাহ্মণ সন্তান গোগ্রাসে মুরকি গুলো খেয়ে ফেললেন। যেন আরো থাকলে কিছু ভালো হতো।
মহিলা সস্নেহে জিজ্ঞেস করলেন , “বাবা ঠাকুর আজ বুঝি তোমার সারাদিন খাওয়া হয়নি?”
সেই স্নেহভরা, মমতাময়ী মহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন ঠাকুরদাস। বীরসিংহ গ্রামে মায়ের কি আজ আহার জুটেছে? ভাই বোনেরা খেতে পেয়েছে? মায়েরা কি সর্বত্রই মা হন ? তাই কি তিনি মন্দিরে বরাভয় ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছেন? মুড়ি, মুরকির দোকান সাজিয়ে বসে আছেন মা? মুখ দেখে বুঝতে পেরেছেন সন্তান অভুক্ত?
ঠাকুরদাসের চোখে জল এল। বিদেশ-বিভুঁইয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছেন করুনাময়ী মা।
” না মা আজ এখনো পর্যন্ত আমার আহার জোটে নেই , আজ কিছু খাইনি মা।”
মহিলা তীব্র গলায় আদেশ করলেন , “দারাও জল খেও না। একটু অপেক্ষা কর। আমি আসছি ।”
মা দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলেন দোকান ছেড়ে ।ঠাকুরদাস বসে আছেন ,সামনে এক ঘটি জল। কিছুক্ষণ পর মহিলা ফিরে এলেন । হাতে এক বড় ভাঁড়ে দই। কিছু দূরে ময়রার দোকান। তিনি ঠাকুরদাসের জন্য নগদ পয়সা দিয়ে কিনে এনেছেন সেই দই। পাত্রে দই ঢেলে তাতে দিলেন মুঠো মুঠো দই।
তারপর ঠাকুরদাসের সামনে ধরে বললেন, ” খাও বাবা খাও ।পেট ভরে খাও। আহা মুখটা শুকিয়ে গেছে।”
ঠাকুরদাস পেট ভরে ফলার করলেন। জল খেলে। আহঃ কি তৃপ্তি ?
খাওয়া শেষ হলে সেই মা প্রশ্ন করলেন ঠাকুরদাস কে , “তোমার ব্যাপারটা কি? আমি আমায় খুলে বল।”
ঠাকুরদাস সংক্ষেপে তার জীবন বৃত্তান্ত বললেন সেই মাকে। সব শুনে তিনি বললেন , “বাবাঠাকুর যেদিন তোমার এইরম হবে তুমি আমার কাছে চলে আসবে। আমিও তোমার মায়ের মত ।ফলার করে যাবে। জেনে রাখো এর শহরে তোমার কেউ না থাক একজন মা আছেন।”
ঈশ্বরচন্দ্র পরবর্তীকালে লিখেছিলেন,
” পিতৃদেবের মুখ হইতে এই হৃদয়বিদারক উপাখ্যান শুনিয়া আমার অন্তঃকরনে যেমন দুঃসহ দুঃখানল প্রজ্বলিত হইয়াছিল , তেমনি স্ত্রী জাতির উপর ভক্তি জন্মিয়াছিল। এই দোকানের মালিক পুরুষ হইলে ঠাকুর দাস এর উপর কখনোই এরূপ দয়া প্রদর্শন করিতেন না।” এরপর মাঝে মাঝেই ঠাকুরদাস নিঃসংকোচে চলে আসতেন ঠনঠনিয়ার মায়ের কাছে ।ফলার করে ফিরে যেতেন। ঈশ্বরচন্দ্র সেই মাকে তাই নাম দিয়েছিলেন দয়াময়ী।
দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ অনলপ্রভ বিদ্যাসাগর