শাক্ত ভূমিতে যেমন বৈষ্ণব চেতনার আবির্ভাব চৈতন্য মহাপ্রভুর কৃষ্ণ ভক্তি তে দেখা যায় তেমনি এই বঙ্গ ভুমি তে শ্রী রামের ভক্তির উৎস রামের শক্তি পুজো কে কেন্দ্র করে মান্য করা হয়। সারা ভারতে এই শক্তি পুজো মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামকে স্মরন করে পালন করা হয়। তাহলে বাংলার শাক্ত ভূমি
কি করে পিছিয়ে থাকে?
এখানেও বাসন্তি নবরাত্রি ও শারদীয়া নবরাত্রি তে শ্রী রাম কে স্মরণ করে ক্রমশঃ চৈত্র শুক্ল পক্ষ্ নবমিতে রাম জন্মোৎসব এবং আশ্বিন শুক্লপক্ষের বিজয়া দশমিতে শ্রী রামের পুরুষার্থের বিজয়োৎসব পালন করা হয়ে থাকে কিন্তু দুই এরই মূল স্রোত অধিষ্ঠাত্রী মা দুর্গার পুজা। পূজা চৈত্রমাসের শুক্ল পক্ষের প্রথম তিথি থেকে শুরু হয়। এই পুজা শেষ হয় বাসন্তি নবরাত্রে রামনবমীর প্রেম মিলনের পর্ব দিয়ে ও শারদীয়া নবরাত্রি পুরুষার্থ পরিচয় স্বরুপ শস্ত্র পুজো দিয়ে বিজয়োৎসব পালন করা হয়। পশ্চিমবঙ্গে রাম ভক্তি, রাম জন্মভূমি, রাম মহোৎসব কিভাবে কোথায় ও কেন শুরু হয় এই ধরনের নানাবিধ প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা আসতে থাকে মানুষের কাছ থেকে, যেখানে এটা মনে করা হয়ে যে সমস্ত ভারতের সাংস্কৃতিক পরিচয় দেশের সমগ্রতার মধ্যে রয়েছে।
শুধু দেশের মধ্যম ভাগেই নয়, দেশের কোনায় কোনায় নানা দেব দেবির পুজোর প্রচলন হিন্দু ধর্মের উত্থান কাল থেকে হয়ে এসেছে। কিন্তু ঐতিহাসিক উথালপাথাল এর জন্যে সাংস্কৃতিক বৈশিষ্টটতায় আসা বিছিন্নতার পরিমার্জন গুনি মহাপুরুষের প্রয়াসের মাধ্যমে চিরকাল হয়ে এসেছে। বাংলার পুন্যভুমিতে বাসন্তি নবরাত্রি বা রামভক্তি, রাম জন্মোৎসব রাম নবমি ভারতীয় সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে এটা জানানো খুবই প্রয়োজন যে ইসলামিক আক্রমনের দরুণ মূর্তি প্রতিমা চূর্ণ বিচূর্ণ করায় ব্যাথিত হয় সনাতন সমাজের কবিবৃন্দরা কলাকৌশলী কৃষ্ণ ও মর্যাদাপুরুষোত্তম রামের চরিত্র বর্ণনের দ্বারা সমাজের পৌরুষ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। বিশেষ করে রাম কাব্য লেখনে অযোধ্যায় বাবরের কব্জা এবং শ্রী রামের জন্মস্থানের মন্দিরকে মসজিদ বানানোর ওপরে একটি লম্বা প্রয়াস দেখতে পাওয়া যায়।
এতে বাংলাও পিছনে ছিল না, এবং সেই চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম ও কর্মস্থান নদীয়া জেলার শান্তিপুরে মহাকবি কৃত্তিবাস ওঝা ১৫০০ শতাব্দিতে বাংলায় রামায়ণ গ্রন্থ লেখেন (যদিও কিছু লোকের ধারণায় এটা বাল্মিকির রামায়নের অনুকরণ)। যা প্রমাণ করে যে বাংলায় তাঁর পূর্বেও রামভক্ত মানুষেরা ছিলেন, যারা রাম নবমি এবং রাম জন্মোৎসব ও বিজয়োৎসব পালন করতেন। যার জন্য কৃত্তিবাসের বাংলা রামায়ন এসেছিলো। যার ২২১ টি হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি পুরো বাংলায় মানে পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশের প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ও বিভিন্ন সংস্থানে আজ সুরক্ষিত রাখা আছে। যা ১৮০২ শতাব্দে ইংরেজদের মুদ্রণালয় স্থাপনার পরে উইলিয়াম কেরির প্রয়াসে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে পাঁচ খণ্ডে বই এর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ১৮৩০ থেকে ৩৪ সালের মধ্যে পণ্ডিত জয়গোপাল তরকালঙ্কারের সম্পাদনায় দুই খণ্ডে কৃত্তিবাসি রামায়ণ এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। কৃত্তিবাস ওঝা রচিত রামায়ন এর রচনাকাল চতুর্দশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী। কৃত্তিবাসি রামায়ণে রাম চন্দ্র দ্বারা দুর্গা পূজা বা অকালবোধনের উল্লেখ পাওয়া যায় যা বাল্মিকি রামায়ণে নেই। এই কারনে কৃত্তিবাস ভক্তেরা এই রামায়ন কে বাল্মিকির রামায়ণের অনুবাদ না বলে মূল রামায়ণ বলারই পক্ষপাতী।
১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে পুস্তক আকারে রামায়ণ প্রকাশিত হবার পর পশ্চিম বাংলার দুর্গা পুজার বহুল প্রচলন ঘটে এবং দশমীর দিনটিকে রামের লঙ্কা বিজয় হিসেবে পালন করা হয়। বাসন্তি দুর্গা পুজোয় সমস্ত দেশে মা দুর্গার পুজার বহুল প্রচলনের সাথে সাথে রাম নবমির উৎসব পালিত হয়। শাক্ত বৈষ্ণব শৈব সকলেই এতে আংশ গ্রহন করেন। এই অনুষ্ঠানের পেছনে রয়েছে, রামেশ্বরে রামের শিব এবং শক্তির যুগল মূর্তির পুজা। এই বিষয়ে আলোকপাত করলে দেখা যায় মার্কণ্ডেয় পুরাণের উদ্ধারন অংশের থেকে শুরু করে আকবরের সময় এমনকি রাজা কৃষ্ণ নারায়ন এর সময়েও পশ্চিমবাংলায় বাসন্তি দুর্গা পুজা এবং রাম নবমি পালিত হয়েছে।
ঐতিহাসিক তথ্য আনুসারে বাদশা আকবর কৃষ্ণ নারায়নকে বাংলা এবং বিহারের দিওয়ান নিযুক্ত করেন। কিন্তু রাজা কৃষ্ণ নারায়ন বানপ্রস্থ গ্রহন করে দেওয়ানি ছেড়ে দেন এবং রাজসাহি জেলার তাহিরপুরে এসে ধর্ম ও সামাজিক কাজকর্মে নিজেকে সমর্পণ করেন। কিছুদিন পরে নিজের জমিদারিতে বসবাসকারী ব্রাহ্মন এবং পণ্ডিতদের মহাযজ্ঞতে আহবান জানান। সেই সময় নাটোরের বাসুদেবপুরের ভট্টাচার্য পরিবার বংশানুক্রমে তাহিরপুরের রাজপুরোহিত ছিলেন। এইরকমই একজন বিখ্যাত বিদ্বান পণ্ডিত ছিলেন রমেশ শাস্ত্রী। কৃষ্ণ নারায়ন যে যজ্ঞের আয়োজন করেন সেখানে রমেশ শাস্ত্রী বলেন শাস্ত্রমতে মহাযজ্ঞ চার প্রকারের। যথা, রাজসূয় অশ্বমেধ বিশ্বজিৎ গোমেধ ইত্যাদি। এর মধ্যে বিশ্বজিৎ ও রাজসূয় মহাযজ্ঞ কেবলমাত্র সম্রাটই করতে পারেন। অশ্বমেধ এবং গোমেধ যজ্ঞও সাধারন মানুষের জন্যে নিষিদ্ধ। কেবলমাত্র দুর্গোৎসব সকলেই করতে পারেন। রাজা রামচন্দ্রের মত ভক্তি সহকারে দুর্গা পূজা করলেই সকল যজ্ঞের ফললাভ হয়। পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রীর এই কথায় সভায় উপস্থিত সকলেই সহমত হন এবং কৃষ্ণ নারায়ন এই বিধান মেনে নিয়ে দুর্গা পুজোর আয়োজন করেন। সেই সময় সাড়ে আট লাখ টাকা খরচ করে রাজা কৃষ্ণ নারায়ণ রাজকিয় পরিবেশে দুর্গোৎসবের সুচনা করেন। এই বিশাল পূজায় পৌরোহিত্য করেন পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রী। দশরথ নন্দন রাজা রাম চন্দ্রের বিধান অনুসারে রাম জন্মতিথিকে মাধ্যম করে চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষের প্রতিপদ তিথি থেকে শুরু করে রামনবমী পর্যন্ত ধুমধাম সহকারে পালিত হয়। রাজা কৃষ্ণ নারায়ণ কে আনুসরন করে অন্যান্য রাজা এবং জমিদারেরা বাসন্তি দুর্গোৎসব পালন করা শুরু করেন।
এরপর ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে কৃত্তিবাসি রামায়ন পুস্তক আকারে প্রকাশিত হওয়ার পর, বাসন্তি দুর্গা পুজোর পরিবর্তে শারদীয়া দুর্গা পুজার অধিক প্রচলন শুরু হয়। যদিও এখন পর্যন্ত বাংলা ও বিহারে ঘরে ঘরে বাসন্তি দুর্গার ব্রত এবং দুর্গা পূজার প্রচলন রয়েছে। শ্রীরাম জন্মতিথি রামনবমীর দিন ধুমধাম সহকারে পালিত হয়। আজও হাওড়া জেলার জগাছা থানা এলাকায় ৩০০ বছরের পুরানো রাম রাজা মন্দিরে চৈত্র শুক্ল নবমি তিথিতে বা রাম নবমিতে রাম জন্মোৎসব পালন করা হয়। এই পুজায় রামনবমী থেকে শুরু করে, চার মাস ধরে রাম পূজা করার পর শ্রাবন মাসের প্রথম রবিবার প্রতিমা বিসর্জন করা হয়।
ভগবান রামের অযোধ্যা দরবারের সমস্ত প্রতিমাই বিসর্জনের সময় দেখা যায়। রাম সিতা লক্ষন ভরত শত্রুঘ্নর সাথে সাথে ভক্ত হনুমান ও জাম্বুবান , গুরু বশিষ্ঠ , নারদ মুনি, সরস্বতি ও ব্রুহ্মা, মহাদেব পার্বতী, সাবিত্রি সত্যবান সকল প্রতিমাই বিসর্জনের শোভাযাত্রায় দেখা যায়। এর মধ্যে সবথেকে বড় হোল ২২ফুট উঁচু ভগবান রামের মূর্তি। এই মূর্তিটি ২২ ফুট উঁচু এবং ১৬ ফুট চওড়া হয়। এর সাথে আরও ২৬ টি প্রতিমা থাকে। এই পুজার ইতিহাস সম্পর্কে ট্রাস্টিরা বলেন স্থানীয় জমিদার অযোধ্যা রাম চৌধুরি ইষ্ট দেবতা হিসেবে রামের পূজা করতেন। একদিন স্বপ্নে মাতা সীতা ও প্রভু রাম কাতর স্বরে তাঁকে বলেন, তাঁরা সর্বসাধারনের ঈশ্বর হয়ে জনসমক্ষে প্রকাশিত হতে চান। এই স্বপাদেশ পেয়ে জমিদার অযোধ্যা রাম চৌধুরি ও তাঁর আন্যান্য বংশধরেরা মিলে রামের মান্দিরটি নির্মাণ করেন। নবরাত্রি চারটি যথা মাঘি বাসন্তি আষাঢী এবং শারদীয়া। এর মধ্যে বাসন্তি এবং শারদীয়া পুজার সঙ্গে যথাক্রমে রাম জন্মতিথি এবং রাম বিজয়োৎসব সমগ্র ভারতবর্ষে পালিত হয়। মাঘি এবং আষাঢ়ী নবরাত্রিতে গুপ্ত তান্ত্রিক মতে দেবী দুর্গার পূজা হয়। কিন্তু বর্তমানে শাক্তভুমি হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিম বাংলায় এই ধরনের পুজো খুব একটা দেখা যায় না। এর থেকেই প্রমানিত হয়, রাম প্রচলিত শক্তি পুজোই পশ্চিম বাংলা সহ ভারতবর্ষে নিজ প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে।