করোনার পর শহরে ভারী বৃষ্টির মুখে আরও এক দফা বিপদের নয়া ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছে শহরের সাড়ে তিন হাজার বিপজ্জনক বাড়ি। এই তালিকার অতি বিপজ্জনক প্রায় ৩৫০ বাড়ি যে কোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়ে বড়মাপের প্রাণহানি ঘটাতে পারে বলে আশঙ্কা পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের শীর্ষ ইঞ্জিনিয়ারদের। এর মধ্যে শতাব্দী প্রাচীন একাধিক হেরিটেজ বাড়ি আমফানে ঝড়ে এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে কোনওদিন তাসের ঘরের মত ভেঙে বড় দুর্ঘটনা হতে পারে বলে মনে করছে পুলিশও। কিন্তু শরিকী বিবাদ ও ভাড়াটিয়াদের ‘বাস্তুচ্যূত’ হওয়ার ভীতি দুর্ঘটনার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িগুলিকে ভেঙে ফেলার কাজে প্রধান অন্তরায় হয়ে উঠেছে। বেশ কয়েকটি চরম বিপজ্জনক বাড়ি ভাঙতে গিয়ে দখলদার বাসিন্দাদের বাধার মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছেন ইঞ্জিনিয়াররা। ভারী বৃষ্টি শুরু হলে মহানগরে এই নয়া বিপদের সম্ভাবনার কথা স্বীকার করেছেন পুরসভার মুখ্য প্রশাসক ও পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম।
আমফান ঘূর্ণিঝড় কলকাতার বিপজ্জনক বাড়ির ভয়াবহতা আরও অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে বলে শুক্রবার জানিয়েছেন পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের শীর্ষ ইঞ্জিনিয়ার। বলেছেন, “বিপজ্জনক বাড়ির কয়েকটির দেওয়াল ও পিলার জুড়ে আঁকড়ে ধরে রয়েছে বড় বড় গাছ। ১৩৩ কিমি বেগে শহরের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাওয়ার সময় ওই গাছগুলি প্রচণ্ড হারে দুলেছিল। গাছের সঙ্গে বাড়ির অংশও তখন অনেকখানি নড়ে গিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পুরনো বাড়ির কড়ি-বরগা এবং ইটের গাঁথুনিও। ভারী বৃষ্টির জেরে আমফানে নড়ে যাওয়া ভগ্নদশা বাড়িগুলি যে কোনও মুহুর্তে ভেঙে পড়ে ভিতরের বাসিন্দাদের প্রাণহানি ঘটাতে পারে।” চেতলায় তিনদিন আগে ভেঙে পড়া বাড়ির ভিতরে ঝড়ে উপড়ে পড়া গাছের মোটা শিকড় আষ্টে-পৃষ্টে আঁকড়ে ধরেছিল। যেই গাছ কেটে শিকড় সরানো হয়েছে সেই গোটা বাড়িটি তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়েছে। উত্তর কলকাতার কাশীপুর, পাইকপাড়া, চিৎপুর, কলেজ স্ট্রিট, বউবাজার, তালতলা, ইলিয়ট রোড এবং দক্ষিণের বালীগঞ্জ, খিদিরপুর এবং ভবানীপুরেই এই অতি বিপজ্জনক বাড়িগুলি এখনও ভগ্ন চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পুরসভার তথ্য, প্রতিটি বাড়িতেই দুই থেকে ১৭টি পরিবার পর্যন্ত বসবাস করছে। এর মধ্যে আর্থিকভাবে সচ্ছল বনেদি পরিবারও কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির বিভিন্ন ফ্লোরে ঝুঁকি নিয়ে সংসার করছেন। পূর্ব পুরুষের ১০ টাকা মাসিক ভাড়ায় ঘরে নতুন ভাড়াটিয়া বসিয়েছে উত্তরপুরুষরা।
প্রতি বছর বর্ষায় বিপজ্জনক বাড়ি ভাঙতেই নতুন করে আলোচনা শুরু হয়। বৃষ্টি থামলেই ফের অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন বিল্ডিং বিভাগের ইঞ্জিনিয়াররা। পুরসভার মুখ্য প্রশাসক ফিরহাদের আক্ষেপ, “একাধিক বিপজ্জনক বাড়ির বাসিন্দাদের সরিয়ে দিতে নিজে চেষ্টা করেছি। মিটিংয়ে বসেছি। কিন্তু শরিকী বিবাদের জেরে এক পক্ষ মানলেও অন্য পক্ষ মানতে রাজি হয়নি।” ভাড়াটিয়াদের পুরসভা গ্যারান্টি দিলেও বাস্তুচ্যূত হওয়ার ভয়ে কেউ ‘বাপ-ঠাকুর্দার স্মৃতি’ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছেন না বলেও অনুযোগ পুরমন্ত্রীর। উত্তর কলকাতার ১, ২ ও ৪ নম্বর বরোর তিন ইঞ্জিনিয়ার অবশ্য জানিয়েছেন, বিপজ্জনক বাড়ির বাসিন্দারা সরকারি প্রস্তাবে সাড়া দিচ্ছেন না। কিন্তু একাংশের বাসিন্দা আবার প্রোমোটারের ফাঁদে পা দিয়ে গোপনে মোটা টাকা নিয়ে শহর ছেড়ে শহরতলিতে সরে যাচ্ছেন। অবশ্য বৃষ্টি শুরু হতেই শহরের হেরিটেজ ও বিপজ্জনক বাড়িগুলিতে সতর্ক নজর রাখছে পুরসভা। বাড়িগুলি অধিকাংশ ভবানীপুরের বকুলবাগান, শরৎবোস রোড, আহিরীটোলা, কাশিপুর, বড়বাজার এবং পোস্তা এলাকায়। আদালতে আইনি ঝামেলা এড়াতে পুরসভা বিপজ্জনক বাড়িতে নতুন করে আরও একদফা নোটিস পাঠাতে শুরু করছে।