সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাধের “ধাত্রী দেবতা” বাঁচাতে “বিশু ডাক্তার” আজও ডাক্তারি করেন আর্ত জনের সেবায়। প্রতিদিন রোগী দেখার প্রথম পারিশ্রমিক দান করেন ধাত্রী দেবতার উন্নয়নে। এইভাবেই তাঁর প্রিয় সাহিত্যিকের স্মৃতি তর্পণকরেন তিনি।
‘জগন্নাথের রথ’ কিংবা ‘শুক সারি’ ছোট গল্পে তারাশঙ্কর যে ডাক্তার চরিত্রের অবতারণা করেছিলেন, ইনিই তিনি। তারাশঙ্করের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ–’আমার সাহিত্য জীবন’- এর পাতায় রয়েছে যে ‘বিশু ডাক্তার’-এর কথা, সেই তিনি আজ ৯০ বছর বয়সেও সেবাব্রতী–জীবন্ত কিংবদন্তী সুকুমার চন্দ্র ।
তবে শুধু ছোট গল্প, আত্মজীবনীতে নয়, ডাক্তার সুকুমার চন্দ্রকে তারাশঙ্কর ‘প্রিয় বিশু’ বলে সম্বোধন করছেন একাধিক চিঠিতেও। যে সব চিঠি আজ সম্পদ হিসাবে নিজের কাছে সযত্নে আগলে রেখেছেন তিনি অলঙ্কারের থেকেও মূল্যবান বিবেচনায়। যে চিঠিতে ফুটে উঠেছে সাহিত্যিক জীবনের বাস্তব দিক গুলি।
তারাশঙ্করের কাছারী বাড়ি ‘ধাত্রী দেবতা’–এই বাড়িতে বসেই ‘গণদেবতা’-মতো একাধিক অমূল্য সৃষ্টি উপহার দিয়েছেন তিনি। তাঁর প্রয়ানের পর একটা সময় পরিবারের লোকজন ‘ধাত্রী দেবতা’ রক্ষার ভার সরকারের হাতে তুলে দেয়। সঙ্গে
তাঁর সমস্ত রচনা, প্রাপ্ত বিভিন্ন উপহার, জ্ঞানপীঠ পুরস্কারের মতো সমস্ত সামগ্রী। ১৯৯৮ সালে কথাসাহিত্যিকের শতবর্ষে পরিবারের পক্ষ থেকে এসবই তুলে দেওয়া হয় তৎকালীন বাম সরকারের আমলে লাভপুর পঞ্চায়েত সমিতিকে।কিন্তু পরিবারের আক্ষেপ, ২০১১ সাল পর্যন্ত কার্যত অবরুদ্ধ ছিল ধাত্রী দেবতা। ফলে কবির ব্যবহৃত সামগ্রী অনাদরে অবহেলায় নষ্ট হতে বসেছিল। অগত্যা বাধ্য হযে পরিবারের পক্ষ থেকে তা ২০১২ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ ও বাংলা একাডেমীকে দান করে দেওয়া হয়। বাম আমলে ধাত্রী দেবতা-র সংস্কারের জন্য সরকারি অর্থ বরাদ্দ অবশ্য হয়েছিল, কিন্তু তা দিয়ে লাভপুরের তারা মা ডাঙার মাঠে এক পেল্লায় বাড়ি করান তৎকালীন কর্তাব্যক্তিরা। আর নম নম করে জোড়া তাপপি দেওযা হয ধাত্রী দেবতা-য়। নামে মাত্র সংস্কার, সংরক্ষণ করে তালা দিয়ে দেওয়া হয় ধাত্রী দেবতা-য়। বছরের পর বছর এমন অবস্থা চলতে থাকায় তারাশঙ্করের ‘বিশু ডাক্তার’ খুবই মর্মাহত ছিলেন।
২০১৫ সালে স্থানীয় প্রশাসন ধাত্রী দেবতা-র দরজা খুলে স্থায়ী প্রদর্শশালা করার পরিকল্পনা করে দায়িত্ব দেয় লাভপুরের সাংস্কৃতিক সংগঠন বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনী-কে। শুরু হয় ধাত্রী দেবতা সংগ্রহশালাকে সমৃদ্ধ করার কাজ। ইতিমধ্যেই পরিবারের সহায়তায় বহু মূল্যবান ছবি, ব্যবহৃত আসবাব,বই, চিঠি, চিতাভস্ম, তারাশঙ্করের পূজিতা দেবী সরস্বতীর মূর্তির মতো বহু অমূল্য সামগ্রীতে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে সংগ্রহশালা।
শেষমেষ ২০১৬ সালে বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনী প্রশাসনের সহযোগিতায় ধাত্রী দেবতা খুলে তারাশঙ্করের ব্যবহৃত সামগ্রী নিয়ে একটি প্রদর্শনীর সূচনা করেন। কিন্তু এই বাড়ি দেখভাল ও প্রতিদিনের খরচ চালানোর জন্য যে অর্থ প্রয়োজন তা যোগাড় করতে হিমশিম খেতে হয় সংস্কৃতি বাহিনীকে। ধাত্রী দেবতা খুলেছে এই খবর পেয়ে বৃদ্ধ ডাক্তারবাবু সেই দিন থেকেই প্রথম রোগী দেখার সাম্মানিক ধাত্রী দেবতা রক্ষায় দেওয়া শুরু করেন। তারপর একদিনের জন্যও তাতে ছেদ পড়েনি। দু টাকা দিয়ে শুরু করার পর এখন তাঁর রোগী দেখার সাম্মানিক দাঁড়িয়েছে ৫০ টাকা। রোগী এলে ডাক্তারবাবুর সাফ কথা, দিতে পারলে দাও। না দিতে পারলে আপত্তি নেই। এইভাবে আজও দুবেলা ডাক্তার দেখে আর্তজনের সেবায় নিয়োজিত বিশু ডাক্তার।
১৯৪৬ সালে ম্যাট্রিক পাশ করে ১৯৪৮ সালে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করেন। ১৯৫৭ থেকে ২০১৯ দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত।তবে নিজেকে বৃদ্ধ বলতে আপত্তি সুকুমারবাবুর। সময়ও যেন সত্যিই তাঁর কাছে থমকে দাঁড়িয়েছে। এখনও প্রতিদিন রাত বারোটা পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। চিকিৎসা শাস্ত্রে নতুন কী আবিস্কার হল, তার খোঁজ রাখেন। আবার নিয়ম করে ঠিক সকাল সাড়ে ছ’টা থেকে রোগী দেখতে বসে পড়েন। বিকাল বেলাতেও ৪টা থেকে প্রায় সাতটা পর্যন্ত চিকিৎসা করেন। গড়ে দৈনিক ৬০ – ৭০ জন রোগী দেখেন।
এই প্রসঙ্গে সুকুমার চন্দ্র বলেন, “আমি ডাক্তারি পাশ করার পর রেলে চাকরি পাই। চাকরি করতে বাইরে যাব বলে পোঁটলা বেডিং নিয়ে হাওড়া পৌঁছেছি। সব কিছু রেখে টালা পার্কে তারাশঙ্করবাবুর বাড়িতে গেলাম তাঁকে প্রণাম করতে। উনি বললেন, তোকে চাকরি করতে হবে না। লাভপুরে ফিরে যা, ডাক্তারি কর, এলাকার মানুষের উপকার হবে, দেশের উপকার হবে। তোরও ভালো হবে। সেই ১৯৫৭ সালে লাভপুর ফিরে এসে ডাক্তারি শুরু করেছি। আজও চলছে। ধাত্রী দেবতা বাঁচলে তারাশঙ্কর থাকবেন, তাই আমার এই সামান্য প্রয়াসটুকু চালিয়ে যেতে চাই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। ওনার চিঠিগুলোই আমাকে এই বয়সে প্রেরণা দেয়।”
প্রথমে গ্রামে এসে সুকুমার বাবু ২ টাকার বিনিময়ে ডাক্তার দেখা শুরু করেন। পরে পার্শ্ববর্তী ময়ূরেশ্বর, বোলপুর, বর্ধমান, কেতুগ্রামের মতো অনেক জায়গায় যেতেন। গ্রামের পর গ্রাম সাইকেল নিয়ে ঘুরে আর্ত মানুষের সেবা করেছেন।
ডাক্তারবাবুর কথায়,” তিনি আমাকে ছোট থেকেই বিশু বলে ডাকতেন। আমি তখন কলকাতা আর জি করে ডাক্তার পড়ছি। শ্যামবাজারের কাছে একটা হোস্টেলে থাকতাম। ১৯৪৬ সাল। কলকাতা জুড়ে তখন দাঙ্গা চলছে । উনি তখন কলকাতার আনন্দ চ্যাটার্জি লেনে থাকতেন। ওই পরিস্থিতির মধ্যেই অনেক দিন সকাল বেলায় চলে এসেছেন আমার খবর নিতে। কখনও কখনও নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আগলে রেখেছেন। ওনার অপার স্নেহ পেযেছি। সারা জীবনে এই ঋণ শোধ হবে না।”
বিশু ডাক্তার এখনও সযত্নে আগলে রেখেছেন তাঁকে লেখা তারাশঙ্করের বহু ব্যক্তিগত চিঠি। যাতে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে তৎকালীন বাস্তব চিত্র। এমনই একটি চিঠিতে ‘প্রিয় বিশু’ সম্বোধন করে তারাশঙ্কর লিখছেন – “মা এর হঠাৎ কিছু ঘটলে ১০০/১৫০ যা লাগে তুমি দিয়ো। বাবাকে উদ্বারণপুর ঘাটে দাহ করা হয়েছিল। মা র ইচ্ছা সেই চিতাতেই দাহ হবার। আমি এসে তোমাকে দেব।”
এখানেই শেষ নয় আদরের বিশুকে আরও লিখছেন- “চাষের সময ৫ বিশ ধান প্রয়োজন হবে। তুমি দাও তো ভালো হয়। পরে নেবে। “
শুধু ব্যক্তিগত প্রযোজনেই নয়, গরীব মানুষের চিকিৎসার জন্যও বিশু ডাক্তারের কাছে টাকা ধার করছেন সাহিত্যিক, সেই তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে তারাশঙ্করের চিঠি থেকেই। একটি চিঠিতে লিখছেন,” এই মেয়েটির তুমি দুটি ইনজেকশন লাগবে লিখেছো। যদি লাগে দিয়ো। আমি তো দেনাদার রয়েছিই তোমার কাছে। দেনার অঙ্ক বাডিয়ে নিও। “
নিজের ব্যক্তিগত জীবনের অনুভূতিও কখনও কখনও বিশু ডাক্তারের কাছে ব্যক্ত করেছেন তিনি একাধিক চিঠিতে। এক চিঠিতে তারাশঙ্কর লিখছেন, “একটা কিছু ওষুধ আমার জন্য ব্যবস্থা করে দাও। যাতে ঘুমিয়ে যাই শেষদিন পর্যন্ত। নইলে পাগল হয়ে পরমানন্দে ঘুরে বেড়াতে পারি। “
বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনীর সম্পাদক উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায় বললেন,” ২০১৫ সালে রুগ্ন অবরুদ্ধ ধাত্রী দেবতাকে মিউজিয়াম করার জন্য দায়িত্ব পাই। আমরা বহু চেয়ে চিন্তে একটা পুরোদস্তুর প্রদর্শশালা তৈরি করতে নামি। কিন্ত অর্থাভাব দেখা দেয়। তখন থেকেই তারাশঙ্করের স্মৃতি রক্ষায় প্রতিদিন প্রথম রোগীর সাম্মানিক দিয়ে ধাত্রী দেবতা বাঁচাতে সৈনিক হিসেবে দাঁড়িয়েছেন নবতিপর বিশু ডাক্তার।”
হেমাভ সেনগুপ্ত