শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ের ব্যস্ত রাস্তা। এখান থেকে টালা ব্রিজ দিয়ে দু’পা হাঁটলেই বাঁ দিকে পড়বে টালা পোস্ট অফিস বাসস্টপ। তার ঠিক নিচ দিয়ে চলে গিয়েছে একটা রাস্তা। এই রাস্তায় নেমে একটু এগোলেই বাঁ হাতে পড়বে টালা ফ্রেন্ডস অ্যাসোসিয়েশন ক্লাব। ক্লাবের গাঁ ঘেঁষে আবার বেঁকে গিয়েছে সরু গলি। সেই গলিপথের শেষ যেখানে সেখানেই পড়বে টিনের চালওয়ালা একটা লাল বাড়ি।
এই বাড়িটাই কারগিল যুদ্ধে শহিদ কলকাতার লেফটেন্যান্ট কণাদ ভট্টাচার্যের। কণাদের স্মৃতি বুকে আগলে একইভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাড়িটি। এই বাড়িতেই কণাদের শোবার ঘরটিকে কণাদের স্মৃতি বিজড়িত সংগ্রহশালা করে গড়ে তুলতে চান বাড়ির বর্তমান মালিক কল্যান চৌধুরী। ২০১৯-এ শহিদ কণাদের মৃত্যু ২০ বছরে পা দিল।
১৯৯৯ সালে ২১ মে কারগিল যুদ্ধে শহিদ হন শিখ রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন কণাদ ভট্টাচার্য। বয়স তখন মাত্র পঁচিশ। এ রাজ্য থেকে কার্গিল যুদ্ধে প্রথম শহিদ তিনিই। টালার এই বাড়িটি কণাদের মামার বাড়ি। কণাদের বাবা ছিলেন আয়কর বিভাগের বড় আধিকারিক। তাই চাকুরিসূত্রে মাঝেমধ্যেই বদলি হতে হত তাঁকে।
তাই ছেলেমেয়েদের নিয়ে টালার এই বাড়িতেই বসবাস করতেন কণাদের মা পূর্ণিমা দেবী। ছেলে মারা যাওয়ার পরও এই বাড়িতেই থাকতেন তিনি। এই বাড়িতেই থাকতেন কণাদের মামা বিভাস চক্রবর্তীও। বর্তমানে ব্যঙ্গালোরে থাকেন কণাদের মামা বিভাসবাবু।
মা পূর্ণিমা দেবী থাকেন দিল্লিতে মেয়ের কাছে। ২০১৩ সালে এই বাড়ি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন মামা বিভাস চক্রবর্তী। তখনই এই বাড়ি বিক্রির খবর শুনে বিভাসবাবুর কাছে বাড়ি কেনার ইচ্ছে প্রকাশ করেন টালারই বাসিন্দা কল্যানবাবু।
পাশের পাড়ায় থাকলেও কণাদের সঙ্গে কোনোদিনও সামনাসামনি পরিচয় হয়নি কল্যানবাবুর। কিন্তু শহীদ স্মৃতি আগলে রাখার লোভ সামলে রাখতে পারেননি তিনি। তাই তড়িঘড়ি বিভাসবাবুকে প্রস্তাব দিয়ে বসেন এই বাড়ি তিনিই কিনবেন। সেইমত ২০১৩ সালে টালার এই বাড়ি কিনে নেন পেশায় ব্যবসায়ী কল্যানবাবু। তিন কাটা তিন ছটাক জমির উপর এই বাড়ির দাম পরেছিল ৭৫ লক্ষ টাকার মত। সেই মুহূর্তে এত টাকা কল্যানবাবুর কাছে না থাকায় পরিচিতদের কাছে ধার করেই বাড়ি কেনার অর্থ জোগাড় করতে হয়েছিল তাঁকে।
বাড়ি কেনার পর এই বাড়ির কিছু অংশে সংস্কার করেছেন কল্যানবাবু। তবে কণাদের শোবার ঘর এখনও আগের মতই। এখন এই ঘরে পড়াশোনা চলে কল্যানবাবুর চার বছরের ছেলে বিবেকরাজের। ভবিষ্যতে ফের এই বাড়ি নতুন করে সংস্কার করতে চান কল্যাণবাবু। বাড়ির নাম দিতে চান কণাদের স্মৃতিবহ করেই। তবে কল্যানবাবুর ইচ্ছে কণাদের শোবার ঘরেই কণাদের স্মৃতি জড়িয়ে গড়ে তোলেন সংগ্রহশালা। যে সংগ্রহ বলবে কণাদের জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা সেই সঙ্গে শহিদ হওয়ার গল্প।
কল্যাণ চৌধুরীর কথায়, “এই বাড়ি আমাকে নতুন করে বানাতেই হবে। তবে আমি চাই কণাদের ঘরে ওঁর সমস্ত স্মৃতি সাজিয়ে একটা সংগ্রহশালা বানাই। আমি ৩৫৬ দিন গর্ব বোধ করি আমি এই বাড়িতে থাকি।”
কল্যান বাবু আরও বলেন, “আমি কণাদের স্মৃতিধন্য ক্লাবের সদস্য। সরকারি খাতে পাওয়া টাকা দিয়ে কণাদের স্মৃতি বিজরিত ক্লাব টালা ফ্রেন্ডস অ্যাসোসিয়েশনকে আমরা নতুনভাবে তৈরি করেছি। গড়ে তুলেছি ‘কণাদ ভবন’ নামে একটি নতুন ভবন। তাছাড়া গড়ে তুলেছি লাইব্রেরি, জিমও। অনেক ক্ষেত্রেই বলতে শোনা যায় সরকারি খাতে ক্লাবের জন্য বরাদ্দ টাকা নিয়ে ক্লাবের সদস্যরা নানানভাবে বাজে খরচ করেন। তাদের উদ্দেশ্যে বলব দেখে যান আমাদের এই ক্লাব! এই একই উদ্দেশ্যে আমরা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম, তিনি যেন একবার এসে দেখে যান। তাঁর দেওয়া অনুদান দিয়ে আমরা কেমন সাজিয়ে তুলেছি শহীদ স্মৃতি! সেই সঙ্গেই তিনি একবার এই বাড়িতেও আসুন। কিন্তু বারবার আমন্ত্রণ জানিয়েও তিনি সাড়া দেননি।”
কল্যান বাবুর কথায়, “ছেলে বেড়ে উঠছে দ্রুত। ওর মধ্যে কণাদের ছায়া দেখতে পাই। এই বয়স থেকেই ওর খেলনা শুধু বন্দুকের নেশা। পাড়া প্রতিবেশীরা বলছেন, এই বাড়িতে থাকার কারণেই হয় তো কণাদের ছায়া পড়ছে আমার ছেলের উপর।”