শিরোনাম দেখেই দয়া করে রে রে করে উঠবেন না। দয়া করে পথে নামবেন না বিষোদ্গার করতে অথবা আদালতে ছুটতে এই অভিযোগ নিয়ে যে সাংবাদিকদের অপমান করা হয়েছে।
না। বিশ্বাস করুন, এ প্রতিবেদনের লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গের গোটা সাংবাদিককুল নন। এ প্রতিবেদনের লক্ষ্য শুধুমাত্র সেই সাংবাদিকরাই যাঁরা যৎসামান্য ভিক্ষের দান দু-হাত পেতে নেবার জন্য একটি রাজনৈতিক দল এবং ওই দলের নেতা-নেত্রীদের কাছে নিজেদের মাথা এবং কলম বেচে দিয়েছেন। এ প্রতিবেদনের লক্ষ্য সেইসব গুটিকয় সাংবাদিক যাঁরা চিটফান্ডকে চিট করতে গিয়ে লক্ষ লক্ষ গরিব মেহনতি বাঙ্গালিকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিয়েছেন। এ প্রতিবেদনের লক্ষ্য সেইসব তৃতীয় শ্রেণীর সাংবাদিক যারা একটি রাজনৈতিক দলের নেত্রীর পিছন পিছন ল্যাং ল্যাং করে ঘোরেন বলে অন্য সাংবাদিকদের কাছে তাদের গর্বের পরিচয়— সারমেয় বাহিনী বা ডগ স্কোয়াড।
এ প্রতিবেদন লেখার আরও একটি উদ্দেশ্য আছে। তা হলো বাংলা সাংবাদিকতার সম্মান রক্ষার্থে চোখ কান মুখ গুঁজে বসে থাকা সাংবাদিকদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া—আপনাদের ‘দেখব না, শুনব না, বলব না’-মুখী হাবভাব বাংলা সাংবাদিকতাকেই অপমান করা। এটি সেই স্বসম্মানিত বাংলা সাংবাদিকতা যা সাংবাদিক রাজা রামমোহন রায়কে বলতে শিখিয়েছিল—‘হৃদয়ের শতশত ফোটা শোণিতের বিনিময়ে অর্জন করেছ যে অমূল্য সম্মান, প্রিয় মোর, তুচ্ছ দারোয়ানের অনুগ্রহ পাবার আশায় তাকে কোর না বিক্রয়।’
এ প্রতিবেদনের তৃতীয় উদ্দেশ্য—রাজ্যের সৎ সাংবাদিককুলকে আহ্বান জানানো— আত্মশ্লাঘার রোষে না জ্বলে জেগে উঠুন। ভয়কে জয় করে প্রতিবাদের ঝড় তুলুন। অন্তত একটু আওয়াজ তো উঠুক এই বলে যে, ভারতীয় সাংবাদিকতার আঁতুড়ঘর বাংলা সাংবাদিকতার মহান ঐতিহ্যকে কতকগুলি অবিমৃশ্যকারী সাংবাদিক পরিচয়ধারী সরকারের পোষা চাকরের হাতে লাঞ্ছিত হতে দেব না। তাদের হাতজোড় করে অন্তত বলি, “অনেক হয়েছে, এবার আসুন। আমাদের বাঁচতে দিন।”
হ্যাঁ। আমি নিজেও একজন সাংবাদিক। আমি বিশ্বাস করি, আমার বাঁচার অধিকার আছে সসম্মানে। আমি দাবি করি, সাংবাদিকতা পেশাটিকে যারা ভূলুণ্ঠিত করছে, প্রয়োজনে তাদের চাবুক মেরে বিদায় করা উচিত। ওদের দু-গালে চপেটাঘাত করে বলার সময় এসেছে— তুমি চোর হতে পারো, কিন্তু তোমার চুরির দায় আমি নেব কেন? কোনো মানুষ তাচ্ছিল্য করে বলবেন– ‘সাংবাদিক মানেই তো চোর। সবকটাকে জেলে পোরা উচিত।’
কারা ওঁরা? মাননীয় সাংবাদিকবৃন্দ, আপনারা এদের সবাইকে চেনেন। যিনি জেলে ছিলেন, যিনি জেলে গেলেন এবং আগামীদিনে যারা যাবেন তারা সবাই আপনাদের চেনা। আর চেনেন তাদেরও যাঁরা ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’ প্রবাদবাক্যটির প্রকাশ্য ফলাফল দেখেও ধীরে ধীরে পাপাশ্রয়ীই হয়ে পড়ছেন।
প্রত্যেককে আমি চিনি, জানি। প্রত্যেকের নাম করে লিখতে পারতাম এরা কারা? কী এদের পরিচয়? করছি না সৌজন্যের খাতিরে। কারণ কলকাতার বাংলা সাংবাদিকতার বাজারে এখন অনেক নতুন মুখ যারা ভালোবেসে সাংবাদিকতা করছেন। যারা সম্মান বজায় রেখে কাজ করছেন। তাদের মনোবল ভেঙে দিতে চাই না এবং চাই না পাপাশ্রয়ী সাংবাদিকদের মুখোশ ছিঁড়ে দিয়ে ওই কচিকাঁচা সাংবাদিকদের সামনে তাদের এখনই অপমানিত করতে। হয়তো একদিন তা করতেই হবে। তাই আপাতত শুধু ইঙ্গিতে বলি, বাংলা সাংবাদিকতার কুলাঙ্গারগুলির অধুনা পরিচয়। কুলাঙ্গারদের শিরোমণি এখন জেলে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি একটি চিটফান্ডের মালিকের ২২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তার ৩২টি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সন্ধান মিলেছে। কিছু তার নামে, কিছু তার স্ত্রীর বা আত্মীয়দের নামে। গোটা ভারতবর্ষে তার নাকি ১৩টি ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে। এবং বীজগণিতের নিয়মেই সম্ভবত তিনি যে সংবাদপত্রের কার্যকরী সম্পাদক ছিলেন, সেই সংবাদপত্র ওই চিটফান্ডের মালিককে বিদেশের মাটিতে সেরা বাঙ্গালির সম্মান জানিয়েছিলেন। এখানেই শেষ নয়, এই অতি ঝানু সাংবাদিক মহাশয়ের নাকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নানা চক্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে এবং তিনি কয়েকটি ভারতীয় রাজনৈতিক দলের নিয়মিত নগদ মাসোহারা প্রাপকও। তিনি রাজ্যের বাম নেতাদের অনুগ্রহে নিজেকে প্রায় দেউলিয়া ঘোষণা করে সমবায় পদ্ধতিতে লবণ হ্রদের অতি দামি অঞ্চলে দুখানি ফ্ল্যাট বাগিয়েছিলেন এবং পরে তা শ্বশুরমহাশয় এবং শ্যালিকার নামে ট্রান্সফার করেন যা বিক্রিরই নামান্তর এবং অবশ্যই চড়ামূল্যে। তার উত্থানের নেপথ্য নায়ক ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং প্রয়াত কংগ্রেস নেতা ও সাংসদ যিনি তাকে হাত ধরে রাজনীতির খুঁটিনাটি শিখিয়েছিলেন হয়তো না জেনেই যে ওই বীরপুঙ্গব সাংবাদিকটি দিল্লির মসনদ থেকে লাহোর-করাচীর মাটিতেও তার পক্ষ বিস্তার করবেন। আরও আছে, তার নামে। ইতিমধ্যেই কয়েকজন মহিলা ‘মি টু’ কলমে বলপূর্বক যৌনাচারের অভিযোগ এনেছেন, যাদের মধ্যে রয়েছেন তার বিদেশে পাঠরতা কন্যার বয়সি সহকর্মিণীও।
আর এক শিরোমণি এখন প্রকাশ্যেই পরিচিত যিনি অভিযুক্ত সারদা চিটফান্ড মামলায়। প্রায় তিন বছর জেলে পচার পরও তার গলাবাজি বন্ধ হয়নি এবং প্রায় গোটা পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা আদালতে হাজিরা দিতে থাকা এই কলমচি ছিলেন রাজ্যের শাসকদলের সাংসদ এবং দলসুপ্রিমো নেত্রীর সবচেয়ে কাছের এবং সবচেয়ে প্রিয় পাত্র। তিনি নাকি কোনরকমে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছিলেন এবং জনৈক প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতার প্রশ্রয়ে এবং আশ্রয়ে তিনি খবরের কাগজের জগতে পদার্পণ করেছিলেন। সামান্য হাতখরচের বিনিময়ে যিনি সাংবাদিকতা করতেন, সেই মহান সাংবাদিকটি চিটফান্ডে মামলায় অভিযুক্ত হলেন যখন জানা গেল, সারদা চিটফান্ড গোষ্ঠী তাকে বেতন দিত মাসে ১৬ লক্ষ টাকা। সেই সঙ্গে গাড়ি এবং অন্যান্য সুবিধা। উত্তর কলকাতার বনেদি পাড়ায় তার দুটি ফ্ল্যাট। বাকি বেনামা সম্পত্তির খবর এখনও প্রকাশিত হয়নি বা অগম্য হয়ে রয়েছে।
জেলের বা হাজতের মুখ এখনও দেখেননি, কিন্তু ইতিমধ্যেই দু’বার এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে তিনি হলেন পরবর্তী শিরোমণি। এক সময়ে তিনি একটি সংবাদপত্রের অধীনে চালু হওয়া সাপ্তাহিক টেলিভিশন প্রোগ্রামের ইলেকট্রিশিয়ান ছিলেন। তার কাজ ছিল ফ্ল্যাশ বাল্ব বয়ে বেড়ানো এবং ক্যামেরাম্যানকে সাহায্য করা। সেখান থেকেই তিনি হঠাৎ ‘সাংবাদিক’ হিসেবে গজিয়ে উঠলেন একটি বেসরকারি টেলিভিশন প্রোডাক্টে যেটির প্রযোজক সংস্থা ছিল ভারতবর্ষের অন্যতম এক কয়লা মাফিয়া। ওই গ্রুপের তিনজন (একজন মহিলা-সহ) সকলেই চিটফান্ড মামলায় অভিযুক্ত এবং জেলবাস করছেন। রাজ্যের বর্তমান শাসক দল ক্ষমতায় আসায় আগে থেকেই তিনি নেত্রীর সঙ্গে অশুভ গাঁটছড়া বাঁধেন এবং শাসকদল ক্ষমতায় আসার পর ওই বীরপুঙ্গব সাংবাদিক একটি বৃহৎ বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলের কর্তাব্যক্তি হয়ে ওঠেন কোনও এক যাদুমন্ত্রে। ওই সাংবাদিকটি একসময় একটি চ্যানেলে কাজ করার সময় শিল্পপতিদের ধরে বেড়াতেন অর্থ বিনিয়োগের জন্য। কারণ তখন তার মাসমাহিনাটাও অনিশ্চিত ছিল। কিন্তু গত ৭/৮ বছরের মধ্যে ওই সাংবাদিক রাজ্য সরকারের বেশ কয়েকটি কমিটির চেয়ারম্যান এবং সব কমিটি থেকেই তার জন্য বরাদ্দ একটি করে গাড়ি ও মাসিক ভাতা। নবান্নে তিনি নামে বেনামে ৪০টি গাড়ি ভাড়া খাটান। হাওড়ায় পড়শিদের চমকে তিনি জলের দরে তার বাড়ির কাছাকাছি অনেকগুলি জমি কিনেছেন এবং নামে অথবা বেনামে বানিয়েছেন রেস্তোরাঁ ও বার। তিনি ইংরেজি বলতে পারেন না। হিন্দি বলতে পারেন না। এমনকী ভালো প্রশ্নও করতে জানেন। না। কারণ তার পড়াশোনা নেহাতই অল্প। অতএব ধান্দাবাজির চিন্তাভাবনা করতে করতে চাণক্যের মতোই মাথায় টাক পড়লেও সুযোগসন্ধানী চরিত্রটির অপনোদন ঘটেনি। তাই টেলিভেশনের পর্দায় না দেখা গেলেও তাকে দেখতে পাবেন ইউটিউবে যিনি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে গানে গলা মেলাচ্ছেন মধ্যরাতে কোনো হোটেলের লবিতে। দেশের অন্যত্র বা দেশের বাইরে গেলে সাংবাদিকদের প্রায় সবাই অন্য হোটেলে উঠলেও তিনি এবং আরও একজন থাকেন মুখ্যমন্ত্রীর হোটেলেই। এমনকী ভারতবর্ষের বিখ্যাত এক ব্যবসায়ী সংস্থার মালিকের মেয়ের বিয়েতেই তাকে একঝলক দেখা গেছে মুখ্যমন্ত্রীর ‘বেয়ারা’র ভূমিকায়।
কুলাঙ্গারদের দলে রয়েছেন আরও এক প্রবীণ সাংবাদিক যিনি বরাবরই নেত্রীর কোলঘেঁসা। এক সময়ে দিল্লিতে পোস্টিং পাবার পর মাথার ছাদ না থাকায় থাকতেন এক নেত্রীর কোয়ার্টারে। সেখান থেকেই তার গাড়ি বাড়ি সবকিছু। এখন তিনি বিধায়ক। সরাসরি দুর্নীতির অভিযোগ এখনও শোনা যায়নি। কারণ উনি গভীর জলের মাছ। তাই নেত্রীর মতোই সততার প্রতিমূর্তি সেজে থাকলেও এ প্রশ্নের জবাব তো তাকেই দিতে হবে যে কেন একজন সাংবাদিক হয়ে বিনা পয়সায় থাকার জন্য তিনি একজন রাজনৈতিক নেত্রীর কোয়ার্টারে থাকতেন? যা মাইনে পেতেন, তাতে গাড়ি চড়ার সঙ্গতি তার ছিল না। কিন্তু কলকাতায় ফেরার পরই কোথা থেকে পেলেন গাড়ি? আর কেনই বা একজন সাংবাদিক বিধায়ক হবার পুরস্কার পেলেন শাসক দলের কাছ থেকে?
এখানেই শেষ নয়। আরও আছে। কলকাতার একদা বামপন্থী একটি সংবাদপত্রের এক সাংবাদিক মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে লন্ডন ভ্রমণে গিয়ে রুপোর চামচ চুরি করে ধরা পড়লেন। তিনি আবার বিখ্যাত এক বামপন্থী লেখকের পুত্র এবং একজন ডব্লিউ বি সি এস অফিসারের স্বামী এবং বিদেশে গবেষণারত অত্যন্ত মেধাবী এক ছাত্রের পিতা। কিন্তু অবাক কাণ্ড, ধরা পড়ার পরও তিনি বহাল তবিয়তে ৬৫ বছর বয়সেও চাকরিতে বহাল রয়েছে। কারণ বামপন্থী সংবাদপত্রটি এখন ঘাসফুলের আবর্জনায় পরিণত হয়েছে নতুন মালিকানায় যে মালিকটি সাহিত্যের ‘স’ না বুঝেও ‘সাহিত্যিক’ হয়েছে। এবং নেত্রীর বিদেশযাত্রার সঙ্গী হন সম্ভবত স্পনসর হিসেবে। আর সংবাদপত্রটিকে যিনি সংবাদপত্র করে রেখেছিলেন দীর্ঘ তিন দশক, সেই অতিবাম সম্পাদক মহাশয় এখন সংবাদপত্রে ঘাসফুলের বীজ রোপণ করছেন একটি শর্তেই ২৫ লক্ষ টাকার মাসিক বেতনটি বন্ধ করা যাবে না।
ওই সংবাদপত্রেই বাজারি বৃহৎ সংবাদপত্রের এক সাংবাদিককে চালান করেছেন নেত্রী। তিনি সবজান্তা বেঁটে সর্দার। যাঁরা এতদিন ধরে সংবাদপত্রটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে তাদের ওপরই ছড়ি ঘোরানোর কাজটি তিনি করে চলেছেন ‘লজ্জা ঘেন্না ভয়, তিন থাকতে নয়’ প্রবাদবাক্যটিকে আপ্তবাক্য হিসেবে স্মরণ করে। কারণ তিনি নেত্রীর পছন্দের মানুষ। তাই মালিকেরও পছন্দের সাংবাদিক। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে বর্তমান সম্পাদকের চেয়ারটিও বরাদ্দ হবে তারই জন্য যদি কোনো চিটফান্ড মামলায় অভিযুক্ত না হন।
শোনা যাচ্ছে, চিটফান্ড দুর্নীতিতে জড়িয়ে রয়েছেন মোট ২১ জন সাংবাদিক। এর মধ্যে একদা নকশাল নেতা বলে পরিচিত সাংবাদিকটি আছেন কিনা জানা নেই। কিন্তু যিনি একদা গর্ব করে বলে বেড়াতেন, লালবাজারে থার্ড ডিগ্রি প্রয়োগ করে দুর্ধর্ষ অফিসার রুণু গুহ নিয়োগী তার হাত পা সব ভেঙে দিয়েছিলেন, তিনিই হঠাৎ করে ২০১১ সালে ঘাসফুল নেত্রীকে ‘প্রকৃত বামপন্থী’ বলে প্রচার শুরু করে নেত্রীর সম্ভ্রম আদায় করে নিলেন এবং দলীয় পত্রিকা যার মুখও দেখা যায় না, তার সম্পাদক হয়ে উঠলেন মাসিক ৮৫ হাজার টাকা বেতনের বিনিময়ে। এই টাকাটা চিটফান্ডের টাকা কিনা জানা নেই। তবে এটা ঠিক, অর্থ আদায়ের মোক্ষম দাওয়াইটি হস্তগত করলেও কলকাতার সাংবাদিক মহলে বিশেষ মুখটুক দেখান না। বোধহয় লজ্জায়। নকশাল নেতা ছিলেন বলে কথা।
একজন ভারতবিখ্যাত প্রয়াত সাংবাদিকের কুলাঙ্গার তনয়টিও চিটফান্ড কাণ্ডে অভিযুক্ত কিনা জানা নেই। তবে তিনি যে সারমেয় বাহিনীর অন্যতম তা সব সাংবাদিকই জানেন। তিনিও সরকারের দয়ায় একটি বৃহৎ টেলিভিশন চ্যানেলের সম্পাদক। যোগ্যতা? সে না হয় শিকেয় তোলা থাক।
ঠিক এইভাবেই শাসককর্ত্রীর বাহিনীতে রয়েছেন ‘অতিবিখ্যাত’ এক কেন্দ্রীয় টেলিভিশনের সাংবাদিক, বর্তমানে বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি বামপন্থী সংবাদপত্রের এক প্রাক্তন সাংবাদিক, একটি ইংরেজি দৈনিকের অতি চালবাজ এক সাংবাদিক, একটি বাংলা দৈনিকের এক মহিলা সাংবাদিক যিনি নেত্রীকে দেবীরূপেই গুণ গান এবং এই জাতীয় আরও কিছু সাংবাদিক যারা এক বা একাধিক সরকারি কমিটির কর্তাব্যক্তি বা সদস্য, নিয়মিত ভাতা পান এবং সামান্য প্রসাদের অপেক্ষায় ভিক্ষের হাত পেতে বাংলা সাংবাদিকতাকে লাঞ্ছনা করছেন প্রতিদিন অহোরাত্র। এরা ভুলে গেছেন রাজা রামমোহন রায়কে, হরিশ্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে, দাদাঠাকুরকে, কাঙাল হরিনাথকে, মহাত্মা শিশির ঘোষকে। এরা ভুলে গেছেন ঋষি অরবিন্দকে, বাণীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, অমিতাভ চৌধুরী, গৌরকিশোর ঘোষ, এমনকী বরুণ সেনগুপ্তকেও। এঁরা ভুলে গেছেন, এই বাংলা থেকেই শুরু হয়েছিল ভারতবর্ষের প্রথম সংবাদপত্র বেঙ্গল গেজেট অব দ্য অরিজিনাল ক্যালকাটা জেনারেল অ্যাডভার্টাইজার। বাংলাতেই জন্ম দ্বিতীয় সংবাদপত্র ইন্ডিয়া গেজেট, তৃতীয় সংবাদপত্র ক্যালকাটা গেজেট, প্রথম ভারতীয় ভাষায় (বাংলা) প্রকাশিত সংবাদপত্র সমাচার দর্পণ, ভারতীয় মালিকানায় প্রকাশিত প্রথম ভারতীয় ভাষা (বাংলা)-য় প্রকাশিত সংবাদপত্র বঙ্গাল গেজেটি, প্রথম দৈনিক সংবাদ প্রভাকর। প্রথম উর্দু পত্রিকা জান-ই-জাহাননুমা, প্রথম সান্ধ্য দৈনিক সন্ধ্যা, প্রথম হিন্দি সংবাদপত্র উদন্ত মার্তণ্ড। প্রথম বহু ভাষিক সংবাদপত্র বেঙ্গল হেরাল্ডেরও জন্ম হয়েছিল এই বাংলার মাটিতেই। বাংলার মাটিতেই প্রকাশ পেয়েছিল প্রথম সচিত্র বাংলা পত্রিকা বিবিধার্থ সংগ্রহ, প্রথম জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্র হিন্দু প্যাট্রিয়ট, প্রথম দ্বিভাষিক পত্রিকা (সমাচার সুধাবর্ষণ), প্রথম বাণিজ্যিক সংবাদপত্র মহাজন দর্পণ, প্রথম মহিলাদের জন্য মানসকপত্র সুগৃহিণী, মফস্স্বল থেকে প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র মুর্শিদাবাদ নিউজ, বামপন্থী সংবাদপত্র জনযুদ্ধ। এমনকী ভারতবর্ষে প্রথম ওয়ার্কিং জার্নালিস্ট হিসেবে স্বীকৃত যিনি, সেই মাইকেল মধুসূদন দত্তও বাঙ্গালির গর্বের মধুকবি।
অত্যন্ত সমৃদ্ধ সেই ইতিহাস। অনেক লড়াই, অনেক সংগ্রাম, অনেক অত্যাচার, অনেক চোখের জলে গড়ে ওঠা বাংলা সাংবাদিকতার ইতিহাস সম্বন্ধে অজ্ঞ না হলে এইসব গুটিকয় অর্বাচীন সাংবাদিক এমনভাবে মাথা বিকিয়ে দিতে পারতেন না। নিজেদের মাথা যাকে খুশি বিক্রি করার অধিকার তাদের আছে। কিন্তু এঁদেরই মদতে আজ রাজ্যের সরকার এবং শাসকদল অন্য সাংবাদিকদের পেশাগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে। বিভিন্ন সংবাদপত্রের সাংবাদিকদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে মিথ্যা অভিযোগে জেলবন্দি করার। লেখা তো দূরের কথা, স্পষ্টভাবে কথা বলার অধিকারও কেড়ে নিয়েছে রাজ্য সরকার। বিভিন্ন সংবাদপত্রের মালিক গোষ্ঠী শুধুমাত্র কিছু সরকারি বিজ্ঞাপনের লোভে (তাও টাকা মেলে মাসের পর মাস অপেক্ষা করে) আসল সংবাদগুলিকেই ছাপার অধিকার দেয় না। কারণ এ যুগের মালিকদের প্রথম দায় অর্থ, সংবাদ নয়। তাই আলু বা পটোল বেচার মতোই করেই বিক্রি করছেন সংবাদপত্র।
এইসব সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকরা ইতিমধ্যেই চিহ্নিত। এদেরই মদতে রাজ্য সরকার প্রকারান্তরে দখল নিয়েছে কলকাতা প্রেস ক্লাবের। এদেরই মদতে সমস্ত সাংবাদিক ইউনিয়নগুলিকে প্রায় ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ইউনিয়নের নেতারাও বিকিয়ে গেছেন অর্থের প্রলোভনে। ফলে সামগ্রিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের সংবাদ আজ শুধুই শাসকের সংবাদ। শোষিতের কণ্ঠরোধ করে রাখা হয়েছে মাথার ওপর জল্লাদের খড়্গকে তুলে ধরে। কার ঘাড়ে কখন কোপ পড়বে কেউ জানে না।
এসব অন্যায় ও অবিচার কি আমরা মাথা পেতে মেনে নেব? কেউ কি নেই যে অন্তত একবার হাতটা তুলে বলতে পারে, দাঁড়াও বন্ধুরা। তোমরা চোর। চুরি কর। শান্তি দেবার দায় যাদের তারা দেবে। কিন্তু তার আগে তোমার গলা থেকে সাংবাদিক পরিচয়পত্রটা আমরা কেড়ে নেব। কারণ তুমি সাংবাদিক নও। তুমি শাসকের পদলেহনকারী। তুমি সাংবাদিক নও, তুমি ভাবের ঘরে চুরি করে বাংলা সাংবাদিকতাকে রাহুর মুখে ঠেলে দিচ্ছ। তুমি সাংবাদিক নও, অর্থগৃধু এক পাপী। তুমি বাংলা সাংবাদিকতার ইতিহাসে কলঙ্ক পেলন করছ। তুমি সাংবাদিক নও, তুমি দালাল, তুমি পাপী, তুমি নরকের কীট। যুগের পর যুগ ধরে বয়ে চলা ঐতিহ্যের শরীরে তুমি অগ্নিশলাকা গুঁজে দিয়েছে। মনে রেখো, সেই আগুনে তোমাকেই পুড়তে হবে একদিন।
সাংবাদিক বন্ধুরা, আজও যারা সততার পর্দা উড্ডীন রেখেছেন, যারা আজও সংবাদ কী তা বোঝেন, লেখেন (যদিও ছাপা হয় না), লিখতে চান, যারা মনে করেন, অন্যায়টা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে তারা এবার ভয়ের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসুন। জানবেন, আপনি অন্যায় করছেন না ওদের মুখোশ খুলে দিয়ে। জানবেন, আপনি পাপ করছেন না সৎ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়িয়ে। জানবেন গর্তে লুকোবে ওরাই যারা একদিন ধরা পড়বেই। জানবেন মানুষের মুখোমুখি ওরা হবেন না, কারণ ওদের গোটা শরীরে পাপের পাঁক। অনেক দেরি হয়ে গেছে। এবার আসুন, মশাল হাতে পথে নামি।
পশ্চিমবঙ্গ বাঁচুক। পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিকতা বাঁচুক। পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিকরা বাঁচুক। রাহুমুক্ত হোক পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিকতা।
সনাতন রায়