বর্তমানে কোভিডের আবহে পশ্চিমবঙ্গের কোনো হাসপাতালে রুগী রাখার জায়গা নেই। অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত হলেও কোনো হাসপাতাল এখন রুগী ভর্তি করছে না, পরিস্থিতি এমনই ভয়াবহ। অর্থাৎ এই মুহূর্তটি এমনই যখন অসুস্থ হওয়াই যেন বারণ। রাজ্যের মানুষের ওপর মানসিক চাপও তাই প্রবল, আশঙ্কায় প্রহর গুনছেন তাঁরা। সেইজন্যই বোধ করি পশ্চিমবঙ্গের (West Bengal) মুখ্যমন্ত্রী কিছুটা অধৈর্য্য হয়েই গতকাল তড়িঘড়ি বলে দিয়েছিলেন যে কোভিড পজিটিভ লোকেরা এবং তার বাড়ির লোকেরা হোম কোয়ারান্টাইনে থাকুন, লক্ষ লক্ষ লোকের কোয়ারান্টাইনের ব্যবস্থা করা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। মুখ্যমন্ত্রীর এমত মন্তব্যে সমালোচনার ঝড় ওঠে সোশ্যাল মিডিয়ায়। প্রশ্ন ওঠে তবে কি পশ্চিমবঙ্গে লক্ষ লক্ষ লোক কোভিড পজিটিভ? মুখ্যমন্ত্রীর এমন মন্তব্যের কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য রাজ্যের এক প্রিন্সিপাল সেক্রেটারির কাছ থেকে আসে স্পষ্টীকরণ যে, কোভিড পরীক্ষার ফলাফল পজিটিভ হলে সেই সব রুগীদের গন্তব্য হাসপাতালই।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে গতকাল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের পরই এই কথা বলেন পশ্চিমবঙ্গের (West Bengal) মুখ্যমন্ত্রী। গতসন্ধ্যায় তাঁর এমত মন্তব্যের পর, আজ, কেন্দ্রও নোটিফিকেশন বের করেছে যাতে বলা হয়েছে যে কোভিড পজিটিভ অ্যাসিম্পটোম্যাটিক বা মাইল্ডলি সিম্পটোম্যাটিক রুগীরা অর্থাৎ যাঁদের দেহে কোভিড ভাইরাসের উপস্থিতি আছে, কিন্তু রোগের লক্ষণসমূহ অনুপস্থিত বা অতিস্বল্পমাত্রায় উপস্থিত, তাঁরা ও তাঁদের বাড়ির লোকেরা চাইলে হোম কোয়ারান্টাইনে থাকতে পারবেন। তাঁদেরকে জোর করে সরকারি কোয়ারান্টাইনে নিয়ে যাওয়া হবে না। কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্ত স্পষ্টতঃই গতকাল মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে মিটিং এর পরবর্তী সিদ্ধান্ত বলে প্রতীত হয়। এই প্রসঙ্গে বলা যায় যে, পশ্চিমবঙ্গের হাসপাতালগুলোর এমনিতেই যা পরিস্থিতি, উপরন্তু বর্তমানে সেগুলির যা অবস্থা, তাতে কোভিড পজিটিভ পেশেন্টদের হোম কোয়ারান্টাইনে রাখতে চাওয়ার প্রস্তাব পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে নিঃসন্দেহে অতিমাত্রায় লোভনীয়। ফলতঃ এমত প্রস্তাব তাঁর দিক থেকেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়েছিল কিনা, তেমন প্রশ্ন বা সন্দেহ অমূলক নয়।
হোম কোয়ারান্টাইনের ব্যবস্থা ডাক্তার ও প্রশাসন, উভয়ের পক্ষেই সুবিধেজনক। যে প্রশ্নটি ভাবাচ্ছে তা হল, মুখ্যমন্ত্রীরা হয়ত প্রশাসনিক সুবিধার কথা বিবেচনা করে এবং প্রধানমন্ত্রী হয়ত মুখ্যমন্ত্রীদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে হোম কোয়ারান্টাইন ব্যবস্থার প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছেন। কিন্তু এতে রুগীদের কথা যথেষ্ট চিন্তা করা হয়েছে কিনা তা স্পষ্ট হচ্ছে না। যে ব্যাধি ইতিমধ্যেই মারণব্যাধি বলে প্রমাণিত, তাতে আক্রান্ত জানা সত্ত্বেও হোম কোয়ারান্টাইনে থাকার মত মানসিক জোর যদি রুগীর না থাকে, সেক্ষেত্রে প্রশাসনিক সুবিধার্থে সেই রুগীকে হোম কোয়ারান্টাইনে ঠেলে দেওয়ার প্রয়াস রাজ্য সরকারগুলির তরফ থেকে জোর করে যে করা হবে না, তার নিশ্চয়তা কিভাবে পাওয়া যাবে, তা স্পষ্ট নয়। পশ্চিমবঙ্গের মত রাজ্য, যে রাজ্য তথ্য লুকোয়, মৃত্যুসংখ্যা এবং মৃত্যুর কারণ গোপন করে, তা যে জোর করে মডারেটলি সিম্পটোম্যাটিক বা সিভিয়ারলি সিম্পটোম্যাটিক রুগীকেও খাতায় কলমে অ্যাসিম্পটোম্যাটিক দেখিয়ে হোম কোয়ারান্টাইনে ঠেলে দেবে না, তার নিশ্চয়তা নেই। এ রাজ্যের পূর্ববর্তী কার্যপ্রণালী থেকে তা আন্দাজ করা শক্ত নয়, সন্দেহ করাও অন্যায্য নয়।
কেন্দ্রের নোটিফিকেশন থেকে বেশ কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট নয়। GOI এর নোটিফিকেশন অনুযায়ী হোম কোয়ারান্টাইনে থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রুগীকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার ফলে রুগীর চিকিৎসা ও দেখভালের সব দায়িত্বও রুগীর ওপরেই চাপিয়ে দেওয়া হবে কিনা, GOI এর নোটিফিকেশনের অ্যানেক্সার অংশগুলি না দেখলে বোধ করি তা স্পষ্ট হবে না। হোম কোয়ারান্টাইনে থাকা রুগীদের সঠিক কেয়ারগিভারের বন্দোবস্ত করার অধিকার প্রাথমিকভাবে থাকা উচিত রুগীর নিজের। কিন্তু রুগী যদি স্বেচ্ছায় হোম কোয়ারান্টাইন বেছে নেওয়া সত্ত্বেও উপযুক্ত কেয়ারগিভারের বন্দোবস্ত নিজে করতে অপারগ হয়, তাহলে তাকে উপযুক্ত শংসাপত্র প্রাপ্ত কেয়ারগিভার বিনামূল্যে সরবরাহ করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের নেওয়া উচিত। কোনো রুগীকে স্বেচ্ছায় হোম কোয়ারান্টাইনে থাকার অনুমতি দেওয়ার আগে সেই রুগীর বাসস্থান হোম কোয়ারান্টাইনে পরিণত হতে পারে কি না, তার স্বাক্ষরিত শংসাপত্রও সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল বা ডিস্ট্রিক্ট সার্ভেইলেন্স অফিসারের তরফ থেকে ব্যক্তিগত পরিদর্শনের পরই রুগীর হাতে দিয়ে দেওয়া উচিত। অর্থাৎ দায়িত্ব যেন কোনো অবস্থাতেই হাসপাতাল বা ডিস্ট্রিক্ট সার্ভেইলেন্স অফিসার ঝেড়ে ফেলতে না পারেন, তা নিশ্চিত করা দরকার। রুগীর কোনো বিশেষ কষ্ট হলে সময় মত ডিস্ট্রিক্ট সার্ভেইলেন্স অফিসারকে ফোন করলেই যে তাঁকে ফোনে ধরা যাবে, তার নিশ্চয়তার বন্দোবস্তও হওয়া দরকার। তাঁকে ফোন করে পাওয়া যায় নি প্রমাণ করা গেলে কত টাকার অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ রাজ্য সরকার দিতে বাধ্য থাকবে তা নিশ্চিত করা কর্তব্য। ফোন করা ব্যতীত তাঁকে মেসেজ বা বার্তা পাঠানোর বন্দোবস্তও থাকা দরকার এবং বার্তা পাঠানোর কতক্ষণের মধ্যে অফিসার রুগীকে যোগাযোগ করবেন, সেটিরও স্পষ্ট সরকারি নির্দেশিকা থাকা প্রয়োজন। রুগীর কাছ থেকে বার্তা পাওয়ার পর সরকারি নির্দেশিকাবলে সেই পূর্বনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অফিসার যদি রুগীকে পাল্টা যোগাযোগ না করেন, তাহলে রুগী রাজ্য সরকারের কাছ থেকে সেই বাবদ কত ক্ষতিপূরণ অতিরিক্ত পেতে পারে তারও স্পষ্ট সরকারি নির্দেশিকা থাকা বাঞ্ছনীয়। ডিস্ট্রিক্ট সার্ভেইলেন্স অফিসারকে ফোন করে পাওয়া না গেলে বা অফিসার যোগাযোগ না করলে ভয়ে যদি রুগী বা তার বাড়ির লোকের মৃত্যু হয় বা তাঁ(দে)র অপরাপর কোনো স্বাস্থ্যবিভ্রাট ঘটে, যা কিনা ক্ষেত্রবিশেষে আদৌ অসম্ভব নয়, তবে ঘোষিত নর্ম্যাল কোভিড ইনস্যুরেন্স অ্যামাউন্টের বাইরে আরও কত টাকা সেই রুগী বা তাঁর বাড়ির লোককে অতিরিক্ত দিতে রাজ্য সরকার বাধ্য থাকবে, এই সব বিষয়গুলি স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত হোম কোয়ারান্টাইনের প্রস্তাব মানুষকে ভাবাচ্ছে। অধিকাংশ মানুষ আতঙ্কিত ও অসহায় বোধ করছেন। কোভিড মহামারী দেশ ও রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থার কঙ্কালসার চেহারাকে সহসা মানুষের সামনে নগ্ন করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
দেবযানী ভট্টাচার্য্য (Debjani Bhattacharyya)