বাঙ্গলা সাহিত্যের সঙ্গে ধর্মসংস্কৃতি নিবিড়ভাবে যুক্ত। চর্যাগীতি থেকে শাক্তগীতি ধর্মসংস্কৃতি অস্বীকার করেনি। ভুল হলো, অঙ্গীকার করেছে। আধুনিকতার প্রথম অভিঘাতের দিনগুলোতে আমাদের পশ্চিমি শিক্ষাবিধি আর পাশ্চাত্যের প্রতি তীব্র আসক্তি চিরাচরিত ধর্মসংস্কৃতির প্রতি আপত্তি জানাতে থাকে। শ্রী মধুসূদনে এই অভিঘাত তীব্র। বিশেষত ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’। তাঁর রচনায় যুক্তি কিছুটা দুর্বল মনে হয়। একদিকে তিনি রামচন্দ্রকে আক্রমণকারী বলছেন, অন্যদিকে ‘জ্বলন্ত পাবক শিখারূপিণী’ সীতাহরণকে সমালোচনা করছেন। নিকুম্ভিলা যজ্ঞে ‘গঙ্গোদক’ ছাড়া মেঘনাদের চলছে না। রাবণকে চিত্রাঙ্গদা ‘নিজকর্মদোষে’ নিমজ্জিত হবার জন্য তিরস্কার করছেন। তাহলে, রামচন্দ্র সীতালাঞ্ছনার প্রতিশোধ নিতেই গেছেন— সেকথা মধুসূদন ভোলেননি।
রবীন্দ্রসাহিত্য নিরঙ্কুশভাবে উপনিষদকে একালের সাহিত্য পদবাচ্য করেছেন। তার শ্রেষ্ঠ রচনার মর্মে আছে ধর্ম ও সমাজে চিরাচরিত ভারতবর্ষকে আবিষ্কার করার প্রয়াস। ‘বিসর্জন’-‘মালিনী’- ‘অচলায়তন’-‘রক্তকরবী’ প্রভৃতি নাটকে ধর্মের কালোচিত পরিক্রমা, রক্ষণশীলতা আর পরিবর্তনের চাহিদা ও সমস্যা ধরা পড়েছে। হিন্দুধর্ম চিরকাল এইরকম বিতর্ককে পরিসর দিয়েছে। ক্রমে রবীন্দ্রনাথ মানবিক ধ্যানধারণা, আন্তর্জাতিক যুদ্ধ পরিস্থিতি বিষয়ে ভেবেছেন। গত পঞ্চাশ বছরের বঙ্গীয় সমালোচকদের একটি বড়ো অংশ এখানে আলো ফেলে রবীন্দ্রনাথের ধর্ম-ভিত্তি আলগা করার চেষ্টা করেছেন। এটি বিভ্রান্তিকর। এই সন্ধানের মধ্যে নীতির ভূমিকা প্রধান। নিখিলেশ নীতির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। সন্দীপ নীতিহীন, ফলে চরিত্রহীন।
বামপন্থী রাজনীতি সারা বিশ্বেই প্রচারধর্মী সাহিত্য রচনার মাধ্যমে মতলবি মত প্রকাশ করার চেষ্টা করে। বিপ্লবের আগে রুশ সাহিত্যের ধ্রুপদী উচ্চতা হ্রাস পায়। পুশকিন থেকে টলস্টয়ের সাহিত্যের অভিজাত্য, দস্তয়েভস্কির সাহিত্যের নৈতিক হাহাকার, চেখভের তির্যক হাস্যরস, ম্যাকসিম গোর্কির ‘মা’ বা নিকোলাই অস্ত্রভস্কির ‘হাউ দ্য স্টিল ইজ টেম্পার্ড’ সেই উচ্চতা, ধ্রুপদী আভিজাত্য বা বৈচিত্র্য রক্ষা করতে পারেনি। বিপ্লবোত্তর রুশ-সাহিত্য সরকারি প্রচার কিংবা সমান্তরাল প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদকে সমূলে নির্বাসিত করা হয়েছে! ফরাসি বিপ্লবের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম সহজেই নজরে আসে। ফরাসি বিপ্লবের আগেকার অভিজাত সাহিত্য নতুন নতুন মানবিক মূল্যবোধকে প্রকাশ করতে করতে অগ্রসর হয়। ফরাসি বিপ্লব সাহিত্যকে মুক্ত করেছে। রুশ বিপ্লব তাকে বদ্ধ বন্দি ও বিপন্ন করেছে।
শরৎচন্দ্র-সতীনাথ ভাদুড়ী-বিভূতিভূষণের সাহিত্যে সমাজ রাজনীতি-প্রকৃতি ও আধ্যাত্মিকতা এসেছে। নজরুলের রচনায় দেশ ও পুরাণ এসেছে তার লেখা আরবী-বেদুইনমনস্ক নয়। স্বাধীনতার পর বামপন্থীরা এই পরিস্থিতি আমূল বদলে দিয়েছেন। হাতেগরম বিপ্লবের বিচিত্রমনা চাহিদা ও জোগান তাদের চেষ্টা। প্রতিভা দীপ্ত সাহিত্যিকদের পক্ষে বামপন্থা আবর্জনা কুণ্ড ছাড়া কিছু না। এর প্রমাণ মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়-বিজন ভট্টাচার্য-দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়- তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। এঁদের প্রতিভা বাম-আবেষ্টনীতে অবক্ষয়িত হয়েছে। শেষ দুজন সরে এসেছেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায় একটি কবিতায় লিখেছেন : ‘লেখকের দল/দিয়ে দানাজল/। বসিয়ে খাঁচায়/ওরা লেখা চায়/খাঁচা ছেড়ে তাই মেলেছি ডানা। একই কথা সমরেশ বসুর ক্ষেত্রে। তিনিও পচে যাওয়ার আগে ওই হুকুমদার সাহিত্য-মুরুব্বিদের হাত ছেড়েছেন।
একালের সাহিত্য আর জনমনকে প্রভাবিত করছে না। এর সূচনা কখন থেকে? ঠিক মতো নির্ণয় করা কঠিন। কল্লোল-কালিকলমের অতি বাস্তবতাবাদ, প্রকৃতিবাদ ক্রমেই শিল্পের জন্য শিল্প (art for art’s sake) তত্ত্ব নিয়ে আসা অর্থহীন বিকল্পে রূপান্তরিত হলো। লেখা হয়ে উঠল বিকারের নরককুণ্ড। বামপন্থীদের দারিদ্র্য-ভিত্তিক শ্রেণী সংগ্রাম থেকে এল হাংরি জেনারেশনের মতো মদ্যপদ্য আন্দোলন। বঙ্গভঙ্গ বঙ্গসংস্কৃতিকে ভেঙেছিল। সেই ভাঙন ছিল স্বাভাবিক। মুসলমানরা সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘অলীক মানুষ’-এর মতোই বিচিত্র— মনস্তাত্ত্বিক রোগী বললেই ঠিক হয়।, তারা সাহিত্যের চৌকো বাক্সে ভরতে চায় ধর্মান্ধতার ষড়ভুজ। একসময় বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য কিছুমাত্র না বুঝে তারা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। হোসেন সিরাজির মতো বঙ্কিম উপন্যাসের প্যারডি শিখেই তাদের সাহিত্য সাধনার ইতি ঘটেছে। এসব অ-সাহিত্য নিয়ে এখানে আলোচনা করে সময় নষ্ট বা পাঠকের ধৈর্য পরীক্ষা করার বাসনা নেই।
বাংলা সাহিত্য এখন যা কিছু বিকৃতি তাকেই তুলে আনার চেষ্টা করছে। কেউ লিখছেন উন্নয়ন ত্রিশূল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ লিখছেন ত্রিশূলে জন্মনিয়ন্ত্রণের পলিমার মুড়তে। শ্রীজাতকে গুরুত্ব দেবার দরকার নেই। কিন্তু একসময়ের প্রধান কবি শঙ্খ ঘোষ যখন জেলাস্তরের গুন্ডাপ্রকৃতির নেতার প্রসঙ্গে ‘ত্রিশূল’ শব্দ ব্যবহার করেন তখন হতাশ হওয়া ছাড়া কী আর উপায় থাকে! যুগ যুগ ধরে জাতির মগ্নচৈতন্যে এক ধরনের রূপক-নির্মাণ হয়। তা অস্বীকার করলে সাহিত্য ধর্মভ্রষ্ট হয়।
ড. অচিন্ত্য বিশ্বাস