শ্যামনগরের মজদুর ভবনের দোতলার ঘর। কাঁটা চামচ দিয়ে শাঁখালু খাচ্ছেন ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের ‘স্ট্রংম্যান’ অর্জুন সিং। বুধবার সকাল তখন সাড়ে আটটা। ঠিক যেন আন্দ্রে রাসেলের স্টাইল। ধরে খেলার কোনও গল্প নেই। প্রথম প্রশ্নেই এক্কেবারে ওভার বাউন্ডারি। বলে দিলেন, “দলবদল করেছি বলেই জিতব। তৃণমূলকে সবাই হারানোর জন্য রেডি।”
শ্যামনগরের মেঘনা মোড়। এক বৃদ্ধকে অর্জুন সিং-এর অফিস কোথায় জিজ্ঞেস করতেই হিন্দি উচ্চারণে বাংলায় উত্তর দিলেন, “সিধা যান। যেখানে দেখবেন ওনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে, ওটাই অর্জুনভাইয়ের অফিস।” কিছুটা হেঁটেই চোখে পড়ল সেই জমায়েত। চারতলা পেল্লাই বাড়ি। গমগম করছে। তারপর সিঁড়ি দিয়ে দোতলার অফিস ঘর। কিন্তু ঢোকা গেল না। আটকে দিলেন নিরাপত্তারক্ষী। স্পষ্ট বলে দিলেন, “খুব ভিড়। কথা বলতে পারবেন না!” কিন্তু সময় তো দিয়েছেন স্বয়ং অর্জুন। দরজা ফাঁক করে দেখিয়ে বললেন, “ওই দেখুন!”
জনা পঞ্চাশ লোকের ভিড় ঘরের ভিতর। টেবিলের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা স্বল্প উচ্চতার অর্জুনকে প্রথমে খুঁজে পেতে কয়েক সেকেন্ড কসরৎ করতে হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পদযাত্রায় বেরোবেন। তাড়াহুড়ো রয়েছে। তার মধ্যেই এক মহিলার সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়ে গেল ভাটপাড়ার ‘দাবাং নেতা’র।
বীজপুর থেকে শ্যামনগরে অর্জুনের অফিসে দেখা করতে এসেছিলেন ওই মহিলা । অনুরোধ, “দাদা, একটিবার বীজপুরে চলুন।” অর্জুন ঠাণ্ডা গলাতেই বললেন, “আমি তো বীজপুরের অলিগলি ঘুরেছি। লোকসভায় কি বাড়িবাড়ি যাওয়া সম্ভব?” সবটা বুঝেও ওই মহিলাকর্মী নাছোড়। ফের বললেন, “দাদা, মণ্ডল সভাপতি কাজ করছেন না একদম। ভোট করতে পারব না। চলুন না দাদা!” এ বার রেগে গেলেন অর্জুন। রাগ বলে রাগ! চোখ বড় বড় করে ওই মহিলাকে বললেন, “যান গিয়ে বীজপুরের কথা মুকুলদাকে বলুন। মুকুলদা তো তিন বছর ধরে এই দল করছেন। আমি তো একমাস।” যেন আগুনের গোলা বয়ে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক বিজেপি কর্মীকে বললেন, “বল তো দেখি! এখন আমি বুথ ম্যানেজ করব, গুণ্ডা ম্যানেজ করব, পুলিশ ম্যানেজ করব, না বীজপুর যাব!”
তারপর ডেকে নিলেন সাক্ষাৎকারের জন্য। ততক্ষণে দাদার টেবিলে চলে এসেছে সকালের খাবার। প্লেট ভরা ফল। ছোট ছট পিস করা তরমুজ, কলা, শাঁখালু আর মুসাম্বি লেবু। কাঁটা চামচ দিয়ে একেকটা টুকরো মুখে দিতে দিতেই একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেলেন। কাটা কাটা ছোট ছোট বাক্যে। অনেকটা ফলের টুকরোগুলির মতোই।
দলত্যাগী অর্জুনের বিরুদ্ধে প্রাক্তন রেমলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী। যাঁর হয়ে একসময়ে ভোট করাতেন অর্জুন। চাপ হবে না? অর্জুনের জবাব, “আমার বিরুদ্ধে দীনেশ ত্রিবেদী নন। আমি দীনেশ ত্রিবেদীর বিরুদ্ধে।” ‘গদ্দার’ মন্তব্য নিয়ে পষ্টাপষ্টি বলে দিলেন, “আমি নই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গদ্দার।” এখানেই থামেননি। বললেন, “সবাই এখন ধরে নিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাষ্ট্রদ্রোহী। পাকিস্তানকে আক্রমণ করলে উনি দুঃখ পান।”
অর্জুন সিং। তাঁর অনুগামীরা বলেন নামটাই যথেষ্ট। সাদা প্যান্ট, সাদা আদ্দির জামা আর বুকে লাগানো পদ্মফুল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন করতেই খানিকটা মেজাজ চড়ালেন ভাটপাড়ার চারবারের বিধায়ক। বললেন, “এখানে বিয়াল্লিশটা জিতলেও প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। বাকি এমপিগুলো কি পাকিস্তান থেকে আসবে নাকি?”
মঙ্গলবার রাতেই তৃণমূল-বিজেপি সংঘর্ষ ঘিরে রণক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছিল ভাটপাড়া। পরিস্থিতি সামাল দিতে নামাতে হয় বিরাট পুলিশ বাহিনী ও র্যাফ। এমন পরিস্থিতি কেন? এর মধ্যেই ফলের থালার জায়গায় চলে এসেছে একবাটি ছানা। তার উপরে একটু চিনি ছড়ানো। ছানা মুখে দিতে দিতেই অর্জুন বললেন, “মদন মিত্র কামারহাটি থেকে গুন্ডা আনিয়েছিল। পাল্টা অ্যাকশন তো হবেই।” অর্জুনের ঘাড়ে এখন জোড়া ভোট। লোকসভার পাশাপাশি তাঁর ছেড়ে যাওয়া ভাটপাড়া বিধানসভার উপনির্বাচন। সেখানে আবার ছেলে পবনকে প্রার্থী করেছে বিজেপি। উল্টোদিকে মদন।
দিন তিনেক আগেই তাঁর হয়ে প্রচার করে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বিপুল জমায়েত দেখে মঞ্চে দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন তিনি। বৃহস্পতিবার ওই মাঠেই সভা করতে যাওয়ার কথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। অর্জুন বললেন, “কিচ্ছু হবে না। ওতে আরও আমার ভোট বাড়বে।” তৃণমূল নেতারা তো হামেশাই বলেন, দিদি টিকিট দেননি বলেই অর্জুন ডিগবাজি খেয়েছে। প্রশ্ন শুনেই অর্জুন ঠাণ্ডা গলায় জবাব দিলেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমাণ দিতে পারবেন, আমি টিকিট চেয়েছিলাম?”
ব্যারাকপুর, নোয়াপাড়া, কাঁকিনাড়া, ভাটপাড়া, জগদ্দল—লাইন দিয়ে জুট মিল। কোনওটা বন্ধ। কোনওটা ধুঁকছে। চট শিল্পের করুণ দশা এই অঞ্চলের অন্যতম ইস্যু। আগের দিন প্রধানমন্ত্রী এসেও চটশিল্পকে অক্সিজেন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ভোটে জেতার পর সেটাই হবে তাঁর প্রথম টার্গেট। তৃণমূলের বিরুদ্ধেই অভিযোগের আঙুল তুলে বললেন, “বাংলার শিল্পের মেরুদণ্ড চটশিল্পকে ধ্বংস করে দিয়েছে। একেবারে ভেঙে দিয়েছে।” ছানা খাওয়া শেষ। বললেন, “দেরি হয়ে যাচ্ছে। এ বার পদযাত্রায় যেতেই হবে। যা বললাম ২৩ তারিখ মিলিয়ে নেবেন।”
পাঁচ গাড়ির কনভয় শ্যামনগর থেকে রওনা দিল নোয়াপাড়ার দিকে। একদম সামনের গাড়ির ফ্রন্ট সিটে ফ্রন্ট ম্যান অর্জুন।