বাঙ্গলা ভাষায় আজকাল ভালো সম্পাদক গড়ে উঠছেন না; সম্পাদনা বিষয়টাকে অতি সহজ একটি কাজ বলে মনে করে নিয়েছেন বলেই বোধহয় ব্যাপারটা সহজ কাজের তকমা লাভ করে ফেলেছে। আর লালু-ভুলু সবাই আজকাল সম্পাদকের পদ না পেলে মুখ গোমড়া করে ফেলেন। অগত্যা ক্ষমতাসম্পন্ন কবি-সাহিত্যিক-প্রাবন্ধিকদের কেউ একজন সম্পাদক বনে যান; আর তাকে পেছন থেকে অত্যাবশ্যকীয় সাহিত্য-বোধের সহায়তা দেন, জোয়াল টেনে নেপথ্যে থেকে চাকা ঘোরান — সেই দলে থাকা সবচেয়ে যোগ্য এক বা একাধিক সাহিত্যসেবী। অনেক সময় দেখা যায়, সম্পাদকীয় দপ্তরে কার্যকরী কেউ নেই, যদিও সেই সম্পাদক-মণ্ডলীর অবয়ব বিশাল। সেখানে একজন প্রুফ রিডারকে পয়সা দিয়ে ঠিকায় নিয়োগ করা হয়; তারপর সম্পাদকের এক পরিচিত-তনু বেশ কয়েক ঘন্টা পাণ্ডুলিপি উল্টেপাল্টে প্রকাশ যোগ্য কিছু একটা দাঁড় করিয়ে চলে যান (বিনিময়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কিছু পান কিনা সমীক্ষা করা হয় নি)। তারপর এক সুবাতাস-ভোরে যথা নিয়মে কার্যক্রম আলো করে নতুন পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়।
প্রশ্ন উঠবে, এখানে তো যোগ্যতা দেখানোর কিছু নেই, এটা একটা দলগত কাজ এবং সংস্থা বা সংগঠনের মতাদর্শ যিনি গভীরভাবে বুঝবেন, তিনিই সম্পাদক হবেন। ব্যাস! বকলমে হয়ে গেল যিনি সংগঠনের প্রধান, তিনিই সংগঠনের মুখপত্রেরও প্রধান। তাঁর নাম জ্বলজ্বলে হরফে ছাপা হল, আর নেপথ্যে যাবতীয় বৈচিত্র্যময় কাজের দেখভাল সুসম্পাদনা করে পশ্চাতে অনালোকিতই থেকে গেলেন প্রকাশের মূল কারিগর। ছোটোবেলা থেকে হরেক কিসিমের সংগঠনে থেকে এটাই আমার উজ্জ্বল আবিষ্কার, সম্পাদকের প্রকাশ আর মনন এক নয়; ‘যাহা ফোটে তাহাতে গন্ধ নাই’; ‘যাহার প্রচার হয় তা পাতে দিবার অযোগ্য’।
সম্পাদনা মানে তো কেবল তৈরি লেখা ছাপানো নয়! সম্পাদক এক অগ্রণী সমাজ-সচেতক, সাহিত্য-বোদ্ধা, ব্রহ্মজ্ঞানের সঙ্গে বাস্তবজ্ঞানের সমন্বয়ক। সম্পাদক নানান লেখার অপ্রয়োজনীয় অংশ বাদ দিয়ে তা থেকে মণিমাণিক্য সংগ্রহ করে আনবেন। একজন সম্পাদকের কাছ থেকে নিশ্চয়ই শেখা যায় অনেক কিছু, লেখার গৃহিণীপনার মানেটা কী সম্পাদকই শিখিয়ে দেন! অনেক নামকরা সাহিত্যিকের উঠে এসেছেন স্বনামধন্য সম্পাদকের মুন্সিয়ানায়। অনেকসময় কম তথ্যেও সুনিপুণ পরিবেশনার আধারে প্রস্তুত-পত্রিকা পাঠককে যারপরনাই আনন্দ দেয়; কখনও তথ্যের উপর অধিক মনোযোগী হতে হয়, কোথাও লেখকের লেখার প্রথমে ইন্ট্রো দিয়ে তার নির্যাস বার করে আনতে হয়, কোথাও লেখার শেষে বা প্রথমে সম্পাদকীয় সংযোজনের মাধ্যমে তার অপূর্ণতাকে পূর্ণ করে দিতে হয়। তাতে লেখকের সম্যক ধারণা হয় — কী দিয়েছিলাম পাণ্ডুলিপিতে, আর কীভাবে বেরোলো ছাপার হরফে। পরিবেশনার দিগন্ত খুলে দেন সম্পাদক; তার নানান প্রক্রিয়া — কখনো উপযুক্ত ছবি, কার্টুন, পরিসংখ্যান, কখনো সারণী, ছক, চার্ট। সম্পাদক একজন সমাজসেবীও বটে; অন্যের জন্যও সময় ব্যয় করবেন তিনি; লেখক তৈরি হবে সম্পাদককূল তৈরি থাকলে। তিনি সবাইকে বাঁটোয়ারা করে দেবেন টপিক, তথসূত্র কোথা থেকে পাবেন — তা বলে দেবেন; লেখা পাবার পর এডিট করে নেবেন। তা না হলে পরবর্তী জেনারেশন তৈরি হবে কী করে?
ইউজিসি একসময় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রমোশনের জন্য সম্পাদিত বই, পত্রিকা, পুস্তিকার জন্য ভালো মার্কস রেখেছিল। বিগত কয়েক দশকে অধ্যাপকরা প্রভাব খাটিয়ে দলীয় ইমেজ বজায় রেখে ভালো গবেষকদের লেখা তাগাদা দিয়ে চেয়ে নিয়ে ‘যা হোক তা হোক’ একটা সম্পাদিত বই বের করে নিত। কেউ বা কারা বই লেখার জন্য ছক করে সেমিনারের আয়োজন করে জমা পাওয়া প্রবন্ধের আগাপাছতলা ঠিকমতো না দেখেই প্রেসে পাঠিয়ে দিত। তারপর বই বের হবার পর কখনও লেখকের একটা জুটতো, কখনও জুটতো না, অনেক সময় বইটি কিনে নিত হত। অর্থাৎ নিজের লেখা কোয়ালিটি প্রবন্ধ নিজেই দাম দিয়ে কিনলাম। এটাও তো একটা দাম দেওয়া, কী বলুন সম্পাদক মশাই! এখন নিশ্চয়ই উপর মহলের শিক্ষাবিদরা বুঝে গেছেন সম্পাদিত বই একটা প্রহসন ছাড়া কিছুই নয়। জোর করে চাপানো অজস্র সম্পাদিত ভ্যলুমকে স্রেফ লবিতে তুলে রাখা ছাড়া আর কোনো কাজে লাগানো যায় না।
মনে রাখতে হবে উপযুক্ত সম্পাদক নির্বাচন না করে পত্রিকা প্রকাশ করলে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ পত্রিকা বনফুলের মত বনেই ফুটবে, আর বনেই ঝরে যাবে। অবশ্য সবাই একবার সম্পাদক হিসাবে নিজের নাম ছাপানো অক্ষরে দেখতে চায়। আগ্রহটা ক্রনিক অসুখে পরিণত হলেই বিপদ। বাঙ্গলায় উপযুক্ত সম্পাদকের বড্ড অভাব। সকলের মনযোগে থাক, সম্পাদনা একটা যোগই বটে।