আগে নির্বাচন হত একদিনে, আর টেষ্ট ক্রিকেট হত পাঁচদিনের। এখন ভোট হয় এক মাস ধরে, আর টেষ্ট ক্রিকেট শেষ হয়ে যায় মাত্র দেড় দিনে! ভোটের ক্ষেত্রে ব্যালটের জায়গায় এসেছে ইভিএম, আর টেষ্ট ক্রিকেটে নবতম সংযোজন পিঙ্ক বল। সেই পিঙ্ক বলের দাপট এমন যে, ভারত এবং ইংল্যান্ডের মধ্যে তৃতীয় টেষ্ট শেষ হয়ে গেল মাত্র ১৪০ ওভারের মধ্যে। ইতিহাস বলছে, প্রথম যখন সীমিত ওভারের ক্রিকেট খেলা শুরু হয়েছিল, তখনও এক একটি দল ৬০ ওভার করে ব্যাট করত। ভারত যে প্রুডেনসিয়াল কাপ জিতেছিল, সেই বিশ্বকাপ পর্যন্তও প্রতিটি দল ৬০ ওভার ব্যাটিং করার সুযোগ পেত। আর আমেদাবাদের নতুন স্টেডিয়ামে ক্রিকেটের আবিষ্কর্তা দেশ আর এই মুহূর্তে সব থেকে শক্তিশালী দেশের মধ্যে ব্যাট-বলের লড়াই, চারটি ইনিংস শেষ হয়ে গিয়েছে তার থেকে ঠিক কুড়ি ওভার বেশিতে৷ অর্থাৎ ৬০X২=১২০+২০=১৪০ ওভারে। ক্রিকেট ইতিহাসে এই অবিস্মরণীয় ঘটনা যেহেতু ঘটেছে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নামাঙ্কিত নতুন স্টেডিয়ামে, তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় রসিকতা ছড়িয়েছে, ‘মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’।
এই সব রসিকতার বাইরে যে প্রশ্নটা জরুরি এবং যে কোনও ক্রিকেট অনুরাগীর কাছে নিজের আবেগকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য জেনে রাখাটা জরুরি, সেটা হচ্ছে এই দিন-রাতের টেষ্ট ক্রিকেটের বা গোলাপি বল ক্রিকেটের রহস্যটা কি, যে এই রকম দেড় দিনের মধ্যে টেষ্ট শেষ হয়ে যাচ্ছে! আমাদের ছোটবেলায় যখন ক্রিকেট দেখতে যাওয়াটা একটা ‘উৎসব’ বা ইভেন্টের মতো ছিল, তখন পাঁচদিনের টেষ্ট ক্রিকেটের টিকিট ভাগাভাগি করে নিয়ে পাঁচদিন পাঁচজন দেখতে যেত। তখনও টি-২০ ফেসবুকের মতোই ভবিষ্যতের গর্ভে রয়ে গিয়েছে, সীমিত ওভারের ক্রিকেটও কচ্চিত-কদাচিৎ হয়। তাই টেষ্ট ক্রিকেটই ছিল বাইশ গজের যুদ্ধের জন্য সেরা রঙ্গমঞ্চ। স্বভাবতই টেষ্টের টিকিটে চতুর্থ বা পঞ্চম দিনের খেলা দেখতে যাওয়ার সুযোগের আলাদা ‘মর্যাদা’ ছিল। কারণ, শেষের দিন অথবা তার আগের দিনই তো উত্তেজনার পারদ চড়বে এবং সেই উত্তাপে নিজেদের সেঁকে নেওয়াটাই ক্রিকেটের আসল আকর্ষণ ছিল। কখনও যদি চারদিনে টেষ্ট ম্যাচ শেষ হয়ে যেত, তাহলে পঞ্চমদিন যাঁর খেলা দেখতে যাওয়ার কথা ছিল, তাঁর ‘বঞ্চনা’য় সকলে সমব্যাথী হত। আরও হা-হুতাশ হত পঞ্চম দিনের লাঞ্চ প্যাকেট বা বিকেলের চা-এর সঙ্গে ফিস ফ্রাই ‘মিস’ হয়ে গেল বলে।
কিন্তু গোলাপি বলের ক্রিকেটে তো সবই মিস। দ্বিতীয় দিনের পরে যাঁরা তৃতীয় বা চতুর্থ দিনের খেলা দেখতে যাবেন বলে আশা রেখেছিলেন, তাঁরা নিশ্চয় এখনও বিশ্বাস করেন, ভারত থেকে বিদেশে পাঠানো সব কালো টাকা ফেরৎ আসবে এবং তাঁদের অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা করে জমা পড়বে! এই রকম আশাবাদ না থাকলে তো এবার থেকে ধরে নিতে হবে দিন-রাতের টেষ্ট ম্যাচ মানে তিন দিন খেলা হলে বাবা রামদেবের ওষুধে করোনাও সেরে যাবে!
আমাদের কৈশোরে যখন পাকিস্তানে খেলতে গিয়ে শুধু খিজার হায়াতের আম্পায়ারিং বা এলবিডব্লিউ ‘দুঃস্বপ্ন’ ছিল না, ফয়জলাবাদের পিচ দেখেও ভারতীয় ক্রিকেটারদের ‘খাটাল’ মনে হয়েছিল, তার থেকে আমেদাবাদের পিচের চরিত্র কতটা আলাদা? আসলে টেষ্ট ক্রিকেট কতটা এগোল? আমেদাবাদের টেষ্টে দু’দিনে তিরিশ উইকেট পড়ার পরে ইংল্যান্ডের প্রাক্তন ক্রিকেটার বা অধিনায়করা যে তীব্র সমালোচনা করছেন, তার সঙ্গে তো আমাদের অতীতের হা-হুতাশের খুব একটা তফাৎ নেই। এমন কি ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহলিও তো বলে ফেলেছেন, এমন আজব টেষ্ট তিনি জীবনে দেখেননি। যে টেষ্টে আমরা জিতছি, সেখানে পিচ ঠিক ছিল, আর যেখানে বিপক্ষ পিচের সুবিধা নিচ্ছে, সেখানে পিচ খারাপ ছিল, এই তত্ত্ব আদর্শ বলে বিশ্বাস করে নিতে কষ্ট হয়। সেইজন্যই তো যুবরাজ সিং ট্যুইটে বলে ফেলেছেন, এমন পিচ পেলে কি হরভাজন সিং বা অনিল কুম্বলের টেষ্ট ক্রিকেটে উইকেট সংগ্রহ ৮০০ বা ১০০০ পেরিয়ে যেত! যুবরাজের এই খোঁচাকে যাঁরা কটাক্ষ হিসাবে না ধরে একজন অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের টেষ্ট ক্রিকেটের চরিত্র কি দাঁড়াচ্ছে, তাই নিয়ে সংশয় বলে ধরেন, তা হলে বোধহয় ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত থাকবে।
আয়োজক দেশ তাদের পছন্দ মত পিচ বানায়, এটা ক্রিকেটে কোনও নতুন কথা নয়। এক সময় ওয়েষ্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট যেহেতু পেস ব্যাটারির উপর নির্ভরশীল ছিল, তাই ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের পিচে সবুজ ঘাস থাকত। অষ্ট্রেলিয়ার পিচেও সে দেশের পেসারদের সাহায্য করার জন্য ঘাস রাখা হত। তেমনই ভারত কিংবা পাকিস্তানের বোলিং শক্তি যেহেতু স্পিনারদের উপর নির্ভর করত, তাই এই উপমহাদেশের পিচ ‘টার্নিং’ হত। এই সবই জানা কথা। কিন্ত তাই বলে রাত-দিনের এই ক্রিকেটে এমন কি রহস্য থাকবে, বা পিচে এমন কি ছিল যে দু’দিনেই খেল খতম!
অনেক প্রাক্তন ক্রিকেটারই যেটা বলছেন, এটা আইসিসি বা বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থার দেখা উচিত, যেন সব ক্রিকেট খেলিয়ে দেশের পিচে একটা ভারসাম্য থাকে। অর্থাৎ ভারত-ইংল্যান্ডের তৃতীয় টেষ্টে যা হয়েছে, তার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়। সেটা বোধহয় ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ এবং ক্রিকেট অনুরাগীদের কথা ভেবেই সুনিশ্চিত করা উচিত।