Novak Djokovic: হৃদয় না জিতুন, টেনিস মানে এখন জোকোভিচই

নোভাক জোকোভিচ, উইম্বলডন জেতার জন্য অভিনন্দন। এক নিঃশ্বাসে এটাও মনে করিয়ে দেওয়া যাক, জীবনে চলার পথে এমন কয়েক জন তারকার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়, যাঁরা চিরন্তন দ্বিতীয়।

টেনিস দুনিয়ায় আপনি হচ্ছেন সেই দু’নম্বর। কারও কারও কাছে এমনকি বরাবরের জন্য আপনার স্থান তিন নম্বরে। প্রায় সমসাময়িক যুগের অন্য দুই তারকা, রজার ফেডেরার আর রাফায়েল নাদালকে আপনি টেনিস রেকর্ডেই শুধু টপকাতে পারবেন। হৃদয়ের ভোটে কখনও হারাতে পারবেন না! কখনও বলা যাবে না আপনি সেই হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা, যাঁর সুরে সম্মোহিত হয়ে জনতা ছুটেছিল ঐতিহ্য আর আবেগের সেন্টার কোর্টে।

টেনিসের অবিসংবাদী সম্রাট যে এখনও সেই রজার ফেডেরার, তা তো নিজে চোখেই দেখে নিতে পারলেন এই উইম্বলডনেও। প্রিয় সবুজ ঘাসে খেলছেনই না ফেডেরার। চোটে এমনই ঘায়েল যে, আর কখনও কোর্টে ফিরতে পারবেন কি না, তা নিয়েই চরম সংশয় রয়েছে। কিন্তু কিংবদন্তিদের সংবর্ধনায় যখন পা রাখলেন, সেন্টার কোর্ট ভেঙে পড়ল আবেগ আর উচ্ছ্বাসে। কয়েক দিন বাদে আপনি যেখানে সপ্তম বার ট্রফি জিতবেন কিন্তু ডিউক ও ডাচেস অব কেমব্রিজের সামনে এত হাততালি বরাদ্দ থাকবে না চ্যাম্পিয়নের জন্যও।

উইম্বলডনে রজার জিতেছেন আট বার, আপনি সাত বার। প্রায় ধরেই ফেলেছেন। গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ের দৌড়ে আপনি ২১, রজার ২০। মুখোমুখি সাক্ষাতেও আপনি এগিয়ে। তবু হৃদয়ের সেন্টার কোর্টে কোথায় আপনি আর কোথায় রজার?

এক জন টেনিসের হ্যারি পটার। যাঁর খেলা দেখতে দেখতে মনে হয় র‌্যাকেটটি যেন ডিয়াগন অ্যালির অলিভ্যান্ডার্স থেকে কেনা। যে দোকান থেকে হ্যারি তাঁর জাদুদণ্ড কিনতেন! অন্য জন সেই ‘খলনায়ক’, যিনি কোভিড প্রতিষেধক নেবেন না বলে নানা ‘ছলনার’ আশ্রয় নেন। আদালতের রায়ে মেলবোর্ন পার্কে নামতে না পেরে বিতাড়িত হন অস্ট্রেলিয়া থেকে।

নোভাক, ইতিহাসের প্রতি আপনার ঝোঁক কতটা জানা নেই। থাকলে জানতে পারতেন, জীবনের মতোই টেনিস শুরু হয়েছিল বাগানে। প্রাচীনতম যে ছবি পাওয়া যায় খেলাটিকে নিয়ে তা একটি কার্টুন। ১৮৮০ সালে প্রকাশিত। ডেক-চেয়ারে বসে থাকা সুসজ্জিত দুই মহিলা আর তাঁদের পাশে রাখা দু’টি র‌্যাকেট। কোর্ট ‘রোল’ করা হচ্ছে, তাঁরা অপেক্ষায় কখন নামবেন খেলতে!

ফেডেরারের টেনিসে দর্শক বাগানের শোভাই খুঁজে পায়। জিমি কোনর্স কী বলেছিলেন জানেন? ‘‘টেনিসে হয় তুমি গ্রাস কোর্ট বিশেষজ্ঞ, নয়তো হার্ড কোর্ট বিশেষজ্ঞ, নয়তো ক্লে কোর্ট বিশেষজ্ঞ। আর নয়তো তুমি রজার ফেডেরার!’’ আপনার বেসলাইন-নির্ভর, রোবটের মতো টেনিস দেখতে অনেকেরই অনীহা। কোর্টের বাইরেও তো আপনি সেই অসহ্য লোকটা, যিনি আতঙ্কের অতিমারির মধ্যেও মাস্ক না পরে অনুষ্ঠান করেন, ইন্টারভিউতে বসেন, বাচ্চাদের সঙ্গে হাত মেলান! আবার বুক ফুলিয়ে ঘোষণাও করেন, প্রতিষেধক নেব না!

বরাবর ইংলিশ সামারের এই সময়টা মানেই অনেক ক্রীড়াপ্রেমীর কাছে লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড, ‘প্লিজ় মাইন্ড দ্য গ্যাপ’, সেন্ট জন্‌স উডে নেমে লর্ডসের দিকে ক্রিকেট দেখতে হাঁটা, উইম্বলডন স্টেশন, সেন্টার কোর্ট, স্ট্রবেরি অ্যান্ড ক্রিম এবং রজার ফেডেরার! আপনার সঙ্গে দর্শকদের এমন আত্মিক মেলবন্ধন কখনও তৈরি হয়েছে হৃদয়ের কোনও স্টেশনে?

তবে ইয়ে, কয়েক বছর আগে পড়ব না পড়ব না করেও আপনার আত্মজীবনী পড়তে গিয়ে কয়েকটি তথ্য জানতে পারলাম, যা মনে পড়ে যাচ্ছিল আপনার উইম্বলডন অভিযান দেখতে দেখতে। ১৯৯৯-এর মার্চে তখন আপনার বয়স মাত্র ১১। যুদ্ধবিধ্বস্ত সার্বিয়া। বেলগ্রেডে নিজের বিছানায় শুয়ে আছেন, হঠাৎই কান ঝালাপালা করে দেওয়া বিকট আওয়াজ। ঝনঝন করে জানলার কাচ ভেঙে পড়ার শব্দ। রাতের নিস্তব্ধতা খানখান করে বেজে ওঠে সাইরেন। ন্যাটো (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গাইনেজ়েশন) ফোর্সের বম্বিং শুরু হয়ে গেল।

মা সংজ্ঞা হারালেন, কোনওক্রমে তাঁর জ্ঞান ফিরিয়ে ছুটলেন অন্ধকার রাস্তা ধরে বাঙ্কারের খোঁজে। আর ঠিক তখনই উল্টো দিকের বহুতলের উপর দিয়ে বিশাল ডানা মেলে আবির্ভাব সেই ভয়ঙ্কর দৈত্যটির। এফ-১১৭ বোমারু বিমান! মাটিতে শুয়ে দেখলেন, সামান্য দূরের হাসপাতাল চূর্ণ হয়ে গেল বোমারু বিমানের মিসাইল হানায়!

এক-এক বার মনে হচ্ছে, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড় করিয়ে দেওয়া বেলগ্রেডের রাস্তায় সেই মুহূর্তটাই কি তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিল আজকের যোদ্ধা জোকোভিচকে? যিনি বুম বুম সার্ভ দেখে কোর্টে আতঙ্কিত হবেন কী, জীবনের রাস্তাতেই যে বোমারু বিমানের মিসাইল বর্ষণ দেখে নিয়েছেন!

চার বছর বয়সে যিনি প্রথম টেনিস র‌্যাকেট হাতে তুলেছিলেন আর স্বপ্ন দেখেছিলেন উইম্বলডন জিতবেন! নকল ট্রফি বানিয়ে হাতে তুলে ধরে যিনি শৈশবেই সুপারহিরোর ভঙ্গিতে বলতেন, ‘‘আই অ্যাম দ্য চ্যাম্পিয়ন!’’ বোমারু বিমান হানার সে রাতে কোনও ক্রমে বেঁচে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন বাঙ্কারে। সেখানে তখন বাচ্চারা কাঁদছে, অন্তত ২০টি পরিবারের সকলে আতঙ্কে ঠকঠক করে কাঁপছে। আপনি সারারাত ঘুমোতে পারেননি। কে জানত, প্রায় তিন মাসের কাছাকাছি ওই বাঙ্কারই হয়ে উঠবে আপনাদের ঘরবাড়ি। সন্ধে আটটার পরে যেখানে আলো জ্বলবে না পাছে বোমারু বিমান সেই আলোর রেখা ধরে মিসাইল বর্ষণ করে যায়। এক-আধবার মনে হচ্ছে ঠিকই যে, বেলগ্রেডের বাঙ্কারের ওই তিন মাস কি আপনার টেনিসকেও নিশ্ছিদ্র করতে শিখিয়ে গিয়েছিল! ফেডেরারের যেমন ফোরহ্যান্ড, নাদালের টপস্পিন, আপনার তেমন কোনও বিশেষ শট নেই। আপনার বিশেষ শক্তি নেই, আবার দুর্বলতাও নেই। রিনাস মিশেলসের ডাচ ফুটবল টিমের মতো আপনি হচ্ছেন টেনিসের ‘টোটাল প্লেয়ার’! শুধু শৈশবের যুদ্ধবিধ্বস্ত বেলগ্রেডই নয়, লড়তে হয়েছে অ্যাজ়মার সঙ্গেও। এখন যে হেলায় পাঁচ সেটের সব দ্বৈরথ জেতেন, সে তো কল্পনাতেও সম্ভব ছিল না একটা সময়!

আপনি সেই জোকার, যে কি না এক দিন ‘সিরিয়াস’ হয়ে উঠল। না হলে বাবার পিৎজ়া আর প্যানকেকের রেস্তরাঁতে বড় হওয়া কেউ এক নিঃশ্বাসে ডায়েট থেকে গ্লুটেন, ল্যাকটোজ় ছেঁটে ফেলতে পারে! কখনও ঠান্ডা জল পান করবেন না বলে শপথ নেন, পরিপাকে ব্যাঘাত ঘটাবে বলে!

জন ম্যাকেনরো তখন চুটিয়ে খেলছেন। গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতছেন। সেই সময় তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, নিজেকে ফিট রাখেন কী ভাবে? ম্যাকেনরোর জবাব? ‘‘টেনিস খেলি!’’ আপনি ম্যাকেনরো জমানার টেনিসকে অতীত করে দিয়েছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন, চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা আর জীবনের লক্ষ্য নয়, জীবনই! জয় আর চ্যাম্পিয়নের পাখির চোখ, জয় তাঁর লাইফস্টাইলের অঙ্গ! যুদ্ধ দেখে কাঁপতে থাকা সেই কিশোর কখন যে নিজেই যোদ্ধা হয়ে গেল!

হৃদয় হয়তো বলেই যাবে রজার ফেডেরার! কিন্তু সবুজ ঘাসে আপনার হাতে উইম্বলডন ট্রফি চকচক করতে দেখে হাততালি যে দিতেই হয়! না বলে উপায় কী যে, নোভাক জোকোভিচ, ২০২২-এ আপনিই টেনিস!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.