ডোবাল দিয়ামানতাকোসের লাল কার্ড, বেঙ্গালুরুর সঙ্গে ড্র করে প্লে-অফের দৌড়ে আর নেই ইস্টবেঙ্গল

ইস্টবেঙ্গল ১ (মেসি বোউলি)
বেঙ্গালুরু ১ (সুনীল-পেনাল্টি)

রেফারি শেষ বাঁশি বাজানোর পর একদৃষ্টে মাঠের দিকে তাকিয়ে ছিলেন বছর পঞ্চাশের এক সমর্থক। শূন্য দৃষ্টিতে বেশ কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর আচমকাই চোখের কোণ দিয়ে বেরিয়ে এল জল। কেউ দেখার আগেই সেই জল সকলের আড়ালে মুছে নিলেন। তার পরেই গোটা দলের উদ্দেশে হাততালি দিতে থাকলেন।

এই দৃশ্যটাই গোটা মরসুমে ইস্টবেঙ্গলের যাত্রাপথটা বলে দিল। অনেক কাছে এসেও শেষ রক্ষা হল না। কাপ আর ঠোঁটের দূরত্বটা রয়েই গেল। পাঁচ বছর আইএসএলে খেলার পরেও প্লে-অফের যোগ্যতা অর্জন হল না। গঙ্গাপাড়ের পড়শি মোহনবাগান যেখানে টানা দু’বার লিগ-শিল্ড ঘরে তুলেছে, সেখানে লাল-হলুদ শিবিরে আরও এক বার শুধুই আঁধার। তবে শত দুঃখের মধ্যেও স্বস্তি একটাই, অন্তত আত্মসমর্পণ করে লজ্জাজনক ভাবে মরসুমটা শেষ করতে হয়নি। এই মরসুমে অন্তত শেষ পর্যন্ত লড়াই করেছে ইস্টবেঙ্গল। মরসুমের প্রথম ছ’টি ম্যাচে শূন্যের বদলে অন্তত পাঁচ পয়েন্ট থাকলে আজ এই দিন হয়তো দেখতে হত না।

রবিবার যুবভারতীতে প্রায় ৪৪ মিনিট দশ জনে লড়াই করে অসম্ভবকে প্রায় সম্ভব করে তুলেছিল ইস্টবেঙ্গল। শেষরক্ষা হল না। ৯০তম মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোল করে ইস্টবেঙ্গলের স্বপ্ন শেষ করে দিলেন বাংলারই জামাই সুনীল ছেত্রী। গোলের পর উচ্ছ্বাসও করলেন না। তিনিও কি মনে মনে চাইছিলেন প্রাক্তন ক্লাব ইস্টবেঙ্গল প্রথম ছয়ে শেষ করুক? ভাবনা যা-ই হোক, বাস্তব তাতে বদলায় না। আর রবিবারের বাস্তব বলছে, বেঙ্গালুরু বিরুদ্ধে ১-১ ড্র করে এ বারের আইএসএলে লাল-হলুদের প্লে-অফের দৌড় শেষ হয়ে গিয়েছে। আর কোনও ভাবেই তারা ষষ্ঠ স্থানে শেষ করতে পারবে না। প্রচুর সুযোগ নষ্টের খেসারত দিতে হল ইস্টবেঙ্গলকে।

প্রথমার্ধে অন্তত চার গোলে এগিয়ে যেতে পারত ইস্টবেঙ্গল। পিভি বিষ্ণু একাই দু’টি সহজ সুযোগ নষ্ট করলেন। অতীতে বেশ কয়েকটি ম্যাচে ইস্টবেঙ্গলকে জেতাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন বিষ্ণু। তবে রবিবার যে দু’টি সুযোগ মিস্‌ করলেন তা সহজে ভুলতে পারবেন না। কারণ এই দু’টি সুযোগের অন্তত একটি থেকে গোল হলে ইস্টবেঙ্গলকে এ দিন পয়েন্ট নষ্ট করতে হত না। অকারণে কেনই বা প্রথমার্ধে মাথা গরম করতে যাবেন দিমিত্রিয়স দিয়ামানতাকোস? দলকে ডোবানোর দায় তিনিও ঝেড়ে ফেলতে পারেন না। দ্বিতীয়ার্ধে সমান-সমান লড়াই হলে ইস্টবেঙ্গল যে আরও গোল করত না, কে বলতে পারে!

বেঙ্গালুরুর বিরুদ্ধে ইস্টবেঙ্গল প্রথম থেকেই আগ্রাসী খেলা শুরু করেছিল। প্রথমার্ধে এত আগ্রাসন আগের ম্যাচগুলিতে দেখা যায়নি। সেই আগ্রাসনের ফলও পায় তারা। ছ’মিনিটের মাথায় দিয়ামানতাকোসের শট কোনও মতে বাঁচিয়ে দেন গুরপ্রীত সিংহ সান্ধু। ১০ মিনিটের মাথায় প্রথম সুযোগটি নষ্ট করেন বিষ্ণু। বাঁ দিক থেকে বল নিয়ে উঠেছিলেন দিয়ামানতাকোস। বক্সের কাছাকাছি পৌঁছে তা পাস করেন বিষ্ণুকে। তবে বিষ্ণুর গতি এতটাই ছিল যে বলে পা ঠেকাতেই তা গোলের অনেক উপর দিয়ে উড়ে যায়।

পরের মিনিটেই গোল করেন মেসি বোউলি। বেঙ্গালুরুর বক্সে ঢুকে পড়েছিলেন সাউল ক্রেসপো। তার আগে মেসি বোউলির সঙ্গে পাস খেলে নেন। ক্রেসপো বক্সে ঢুকে মাটিতে পড়ে গেলেও তাঁর পা থেকে বল বার করতে পারেননি বেঙ্গালুরুর ডিফেন্ডার। সেই বল ধরে কিছুটা এগিয়ে বাঁ পায়ের জোরালো নিচু শটে গোল করেন মেসি বোউলি। এর পরেই কর্নারের পতাকার সামনে গিয়ে ‘সামারসল্ট’ দেন, যা এক সময় আতলেতিকো দি কলকাতায় খেলে যাওয়া ফিকরু লেমেসার প্রিয় উচ্ছ্বাস ছিল।

এর কিছু ক্ষণ পরেই বিষ্ণুর দ্বিতীয় সুযোগ নষ্ট। বাঁ দিক থেকে মেসি বোউলির নিচু ক্রস বেঙ্গালুরুর ডিফেন্ডার বিপন্মুক্ত করতে পারেননি। সেই বল বিষ্ণুর সামনে আসে। সামনে একা গোলরক্ষক গুরপ্রীত ছিলেন। সেই শটও বারের উপর দিয়ে উড়িয়ে দেন বিষ্ণু। পরের মিনিটে ইস্টবেঙ্গলের গোল বাতিল হয়। বেঙ্গালুরুর বক্সের সামনে পড়ে গিয়েও বাঁ পায়ের শটে বল জালে জড়িয়েছিলেন নাওরেম মহেশ। তবে সেই অফসাইডের কারণে বাতিল করে দেন রেফারি। সামনে থাকা দিয়ামানতাকোসের পায়ে বল লাগেনি। তবে যে হেতু তিনি গোলরক্ষক গুরপ্রীতের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর নজর আটকে দিয়েছিলেন, তাই অফসাইড দেওয়া হয়।

প্রথমার্ধের শেষ দিকে আসে নাটকীয় মুহূর্ত। দিয়ামানতাকোসকে ট্যাকল করার পর রেফারি ইস্টবেঙ্গলকে ফাউল দিলে হঠাৎই পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বেঙ্গালুরুর অ্যালবার্ট নগুয়েরা কিছু বলেছিলেন দিয়ামানতাকোসকে। ইস্টবেঙ্গলের গ্রিক স্ট্রাইকার তেড়ে গিয়ে তাঁর মাথায় আঘাত করে মাটিতে ফেলে দেন। নগুয়েরাকে খুব জোরে আঘাত করা হয়নি। তবে আধুনিক ফুটবলে মাথা দিয়ে আঘাত করার (হেডবাটিং) ক্ষেত্রে রেফারিরা কোনও রকম দয়ামায়া দেখান না। দিয়ামানতাকোসকেও সরাসরি হলুদ কার্ড দেখিয়ে মাঠের বাইরে বার করে দেন রেফারি হরিশ কুন্ডু।

এক জন ফুটবলার কমে যাওয়ার কারণে স্বাভাবিক দ্বিতীয়ার্ধে ইস্টবেঙ্গলকে রক্ষণাত্মক খেলতে হয়েছে। রক্ষণ শক্তিশালী করার জন্য লাকরাকে তুলে নিশু কুমারকে নামান অস্কার ব্রুজ়‌ো। ইস্টবেঙ্গলকে বাগে পেয়ে ধীরে ধীরে চাপ বাড়াতে থাকে বেঙ্গালুরু। তবে গোলমুখ খুলতে পারছিল না তারা। মেন্ডেজ় একটি সুযোগ নষ্ট করেন। খেলার বিপরীতে প্রতি আক্রমণ করছিল ইস্টবেঙ্গলও। দূর থেকে নেওয়া শৌভিক চক্রবর্তীর একটি শট অসাধারণ দক্ষতায় বাঁচান গুরপ্রীত।

৭৩ মিনিটের মাথায় আরও একটি সহজ সুযোগ হারায় ইস্টবেঙ্গল। বেঙ্গালুরুর একটি ফ্রিকিক থেকে শিবশক্তি নারায়ণনের শট পোস্টে লেগে ফেরে। সেই বল পেয়ে প্রতি আক্রমণে ওঠে ইস্টবেঙ্গল। মহেশ এবং ডেভিড লালানসাঙ্গা দ্রুত গতিতে ছুটতে থাকেন। মহেশের পাস পেয়ে ডেভিডের সামনে শুধু গুরপ্রীত ছিলেন। গুরপ্রীতের মাথার উপর দিয়ে বল অনায়াসে ‘লব’ করে দিতে পারতেন ডেভিড। তা না করে ডান দিক দিয়ে শট মারতে চান। অনায়াসে তা আটকে দেন বেঙ্গালুরুর গোলরক্ষক।

কিছু ক্ষণ পর আবার পোস্ট খালি হাতে ফেরায় বেঙ্গালুরুকে। ফ্রিকিক থেকে জোভানোভিচের শট পোস্টে লাগার পর ফিরতি বলে রায়ান উইলিয়ামসের শট আটকান প্রভসুখন। বল বার করে দেন ইস্টবেঙ্গলের ডিফেন্ডারেরা।

ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকেরা যে মুহূর্তে জয়ের উচ্ছ্বাস করতে শুরু করেছেন, তখনই নেমে আসে বিপদ। সুনীলের উদ্দেশে ভাসানো একটি বল ক্লিয়ার করতে গিয়ে হাতে লাগিয়ে বসেন নিশু কুমার। রেফারি পেনাল্টির সিদ্ধান্ত দিতে দেরি করেননি। ঠান্ডা মাথায় প্রভসুখনকে পরাস্ত করে লাল-হলুদের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দেন সুনীলই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.