ভ্যান চালিয়ে ব্যাট কেনা বাবর এখন শিখরের সতীর্থ, ভারতের হয়ে খেলার স্বপ্ন দেখেন বীরভূমের তরুণ

সুরাতের হোটেলে রয়েছেন তিনি। একই হোটেলে রয়েছেন শিখর ধাওয়ান, ইরফান পাঠান, ইউসুফ পাঠান, সুরেশ রায়নার মতো তারকা। তাঁদের কাছ থেকে দেখছেন বীরভূমের মাঠপলসা গ্রামের বাবর আলি। দশ বছর জেলার হয়ে ক্রিকেট খেলেছেন। আর্থিক প্রতিকূলতার মোকাবিলা করেও ক্রিকেট ছাড়েননি। রাজ্য দলে ট্রায়ালে ডাক পেলেও জায়গা পাননি। তবু হাল ছাড়েননি বাবর। লেগে থেকেছেন। তারই ফসল ‘বিগ ক্রিকেট লিগ’। সেখানে বিশ্বের নামকরা সব ক্রিকেটারের সঙ্গে খেলার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আগামী দিনে অন্তত এক বার হলেও জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন দেখেন ২৭ বছরের এই উইকেটরক্ষক-ব্যাটার। তাঁর আদর্শ মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। তিনিও তো রাঁচীর মতো শহর থেকে উঠে এসে ভারতের অধিনায়কত্ব করেছেন। সেই পথেই এগোতে চান বীরভূমের তরুণ।

ছোট থেকেই অর্থাভাব ছিল বাবরদের সংসারে। সাঁইথিয়ার মাঠপলসা গ্রামে মা ও বোনকে নিয়ে থাকেন বাবর। টিনের চালের বাড়িতে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। মা গ্রামের একটি প্রাইমারি স্কুলে রান্না করেন। সেখান থেকে যা পান তাতেই সংসার চলে। সেই কারণে, ছোট থেকেই রোজগার করতে হয়েছে বাবরকে। উচ্চমাধ্যমিকের পর থেকে আর পড়াশোনা করতে পারেননি। কখনও গাড়ি চালিয়েছেন। কখনও ভ্যান টেনেছেন। আবার কখনও ঘুগনি বিক্রি করেছেন। সেখান থেকে যা রোজগার হয়েছে তা সংসারে দেওয়ার পাশাপাশি সেখান থেকে নিজের খেলার খরচ চালিয়েছেন বাবর। তবু স্বপ্নকে মরতে দেননি। মনের জেদ তাঁকে থামতে দেয়নি।

cricket

এখন বিগ ক্রিকেট লিগে নর্দার্ন চ্যালেঞ্জার্সের হয়ে খেলেন বাবর। সেই দলে তাঁর অধিনায়ক ধাওয়ান। যে ধাওয়ান দীর্ঘ দিন জাতীয় দলে খেলেছেন, যাঁর এক রেকর্ড সেই ক্রিকেটারের সঙ্গে খেলছেন বীরভূমের ছেলে। যাঁর ক্রিকেট খেলাটাই শুরু হয়েছিল ধার করা কিট দিয়ে। সুরাতের হোটেলে বসে আনন্দবাজার অনলাইনকে বাবর বললেন, “ক্রিকেট কিট কেনার টাকা ছিল না। তাই গ্রামের কারও কাছে ব্যাট, গ্লাভস থাকলে ধার নিতাম। এ ভাবেই আমার ক্রিকেট শুরু। পরে নিজে রোজগার করে কিট কিনেছি। কিন্তু খেলা ছাড়িনি।”

১০ বছর ধরে বীরভূম জেলা দলে খেলেন বাবর। উইকেটরক্ষক-ব্যাটার তিনি। ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রচুর রান করলেও তার পরের ধাপে পৌঁছতে পারছিলেন না। বাবর বললেন, “কলকাতায় অনেক ক্লাবের হয়ে খেলেছি। কিন্তু টাকার অভাবে কলকাতায় থাকতে পারিনি। তাই সে রকম যোগাযোগ তৈরি হয়নি। সিএবি (বাংলা ক্রিকেট সংস্থা)-র অনেক প্রতিযোগিতাতেও খেলেছি। এক বার ওরা ট্রায়ালে ডেকেছিল। কিন্তু আমি দলে জায়গা করতে পারিনি।”

cricket

সেই বাবরই আচমকা বিগ ক্রিকেট লিগে খেলার সুযোগ পান। একটি বিজ্ঞাপনে এই প্রতিযোগিতার কথা জানতে পেরেছিলেন তিনি। তার পরে কলকাতায় এক পরিচিতের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি ট্রায়ালের জন্য বাবরের নাম নথিভুক্ত করান। বাবর বললেন, “এই প্রতিযোগিতার জন্য ওরা বিভিন্ন শহর থেকে ক্রিকেটার নিচ্ছিল। মহমেডান মাঠে আমার ট্রায়াল হয়েছিল। অর্ধশতরান করেছিলাম। কিপিংও ভাল করেছিলাম। পরে আরও কয়েকটা ম্যাচ খেলি। তার পরে দেখি নর্দার্ন চ্যালেঞ্জার্স দলে আমার নাম আছে। সে দিন যা আনন্দ হয়েছিল, তা বলে বোঝাতে পারব না।” এই প্রথম বার কোনও বড় প্রতিযোগিতায় সুযোগ পেয়েছিলেন বাবর। বলা ভাল, তাঁর খেলা তাঁকে সুযোগ করে দিয়েছিল। অভাবের সংসার প্রথম বার কিছু টাকা হাতে পেয়েছিল। গ্রামের দরিদ্র সন্তান বাবরের এই সাফল্যে খুশি তাঁর গ্রাম। তিনি এখন মাঠপলসার গর্ব। বাবরের খেলার খবর রাখেন গ্রামের সকলে। তাঁরা চান বাবরের হাত ধরেই এই অজ গ্রামকে এক দিন সকলে চিনুক।

বিগ প্রিমিয়ার লিগে মোট ছ’টি দল রয়েছে। নর্দার্ন চ্যালেঞ্জার্স, এমপি টাইগার্স, মুম্বই মেরিনস, রাজস্থান রেগালস, সাউদার্ন স্পার্টান্স ও ইউপি ব্রিজ স্টার্স। আইপিএলের ধাঁচেই হয় প্রতিযোগিতা। রয়েছে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারের নিয়মও। বাবরের নর্দার্ন চ্যালেঞ্জার্সে ধাওয়ান ছাড়াও ড্যারেন ব্রাভো, ডেন ভিলাস, উপুল থরঙ্গার মতো ক্রিকেটার খেলেন। এই প্রতিযোগিতায় ইরফান পাঠান, ইউসুফ পাঠান, সুরেশ রায়না, কেদার যাদব, অমিত মিশ্র, নমন ওঝার মতো ভারতীয়ের পাশাপাশি তিলকরত্নে দিলশান, তামিম ইকবাল, রিচার্ড লেভি, ডোয়েন স্মিথ, হার্শেল গিবস, ইমরান তাহিরের মতো বিদেশি তারকারা খেলেন।

cricket

দলের অধিনায়ক ধাওয়ানের সঙ্গে কথা হয়েছে বাবরের। তাঁকে কিছু পরামর্শও দিয়েছেন ধাওয়ান। বাবর বললেন, “শিখর ভাই আমাকে বলল, ‘তোর বাড়ি কোথায়’? আমি বললাম, কলকাতা। বলল, ‘কলকাতা শহরে’? বললাম, না বীরভূমের একটা গ্রামে। তখন হেসে বলল, ‘তুইও গ্রামের ছেলে। আমিও। গ্রামে যে ভাবে খেলতিস, এখানেও তেমনই খেলবে। বেশি কিছু ভাবতে যাবি না। ক্যামেরার দিকে তাকাবি না। তোর কাজ শুধু ভাল খেলা। শুধু নিজের কাজটা করে যাবি।’” ধাওয়ানের সেই মন্ত্র নিয়েই সামনে দিকে এগিয়ে যেতে চান বাবর। শুধু ধাওয়ান নয়, ইউসুফ, ইরফান থেকে দিলশান, যাঁর সঙ্গেই দেখা হয়েছে, পরামর্শ চেয়েছেন। তাঁদের থেকে শিখতে চেয়েছেন। সেই কারণেই হয়তো তাঁর খেলা আগের থেকে অনেক ভাল হয়েছে। বাবর বললেন, “এত বড় বড় তারকাদের সঙ্গে থাকা, কথা বলা, খেলার প্রভাব তো পড়বেই। এখন মাঠে অনেক আত্মবিশ্বাস নিয়ে নামি। আমার খেলা আগের থেকে ভাল হয়েছে। আরও ভাল খেলতে চাই।”

cricket

এখানেই থেমে যেতে চান না বাবর। জানেন, সামনে পথ খুব কঠিন। কিন্তু এত দিন যে লড়াই তিনি করেছেন তা তো শুধু খেলা নিয়ে নয়। অভাবের সংসারে কোনও রকমে দু’মুঠো খেয়ে থেকেছেন। কিন্তু স্বপ্ন শেষ হয়ে যেতে দেননি। তিনি লড়াই করতে জানেন। যে ভাবে অজ গ্রাম থেকে উঠে এসে সুরাতে ধাওয়ান, পাঠানদের সঙ্গে একই হোটেলে তিনি রয়েছেন, সে ভাবেই আগামী দিনে জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের সঙ্গেও এক হোটেলে থাকার স্বপ্ন দেখেন বাবর। তাঁর এই উত্থান শুধু ক্রিকেটের সাফল্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। জীবনের যুদ্ধে জিতে অসম্ভবকে সম্ভব করার চেষ্টা করছেন তিনি। জানেন, এখনও অনেক পথ চলা বাকি। সেই পথ চলতে চান বাবর। যেমন এত দিন চলেছেন। বীরভূমের মাঠপলসা গ্রামের বাবর শুধুই ছুটে চলেছেন নিজের স্বপ্নের পিছনে। নীল জার্সিটা পরে এক বার মাঠে নামতে চান তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.