মাঠ ঘুরে দর্শকদের ধন্যবাদ জানিয়ে চোখের জলে বিদায় সুনীলের, সাক্ষী রইলেন প্রায় ৬০ হাজার সমর্থক

শেষ বাঁশি বাজতেই হতাশায় বসে পড়লেন ভারতীয় ফুটবলারেরা। সুনীল ছেত্রী তখন মাঠের মাঝখানে একা দাঁড়িয়ে। কোনও সতীর্থ তাঁর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন না। কুয়েতের বিরুদ্ধে ড্র তখন হারের মতো মনে হচ্ছে গুরপ্রীত সিংহ সাঁধুদের কাছে।

কোচ ইগর স্তিমাচ এগিয়ে গেলেন সুনীলের দিকে। তাঁকে সান্ত্বনা দিলেন। কুয়েতের এক ফুটবলার এসে হাত মিলিয়ে গেলেন সুনীলের সঙ্গে। হতাশ সুনীল তখনও স্তম্ভিত। ভারতীয় জার্সিতে তিনি যে শেষ ম্যাচ খেলে ফেলেছেন, তা যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। তবে পেশাদার ফুটবলারদের আবেগে ভাসতে নেই। সুনীল তা জানেন। তাই কিছু ক্ষণের মধ্যে সব কিছু সামলে নিলেন।

গোটা মাঠ ঘুরতে শুরু করলেন সুনীল। মাঠে উপস্থিত প্রায় ৬০ হাজার দর্শক যেন এটার অপেক্ষাতেই ছিল। সুনীল মাঠের প্রতিটি কোণে গেলেন আর চিৎকারে ফেটে পড়ল যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন। ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার দর্শকদের প্রণাম জানালেন বার বার। নিজেও আবেগে ভাসলেন। মাঠ ছেড়ে বার হয়ে যাওয়ার আগে সতীর্থেরা দাঁড়িয়ে ছিলেন সুনীলকে গার্ড অফ অনার দেওয়ার জন্য। সুনীল সতীর্থদের মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাওয়ার আগে কেঁদে ফেললেন। দাঁড়িয়ে চোখ মুছলেন। চোখের জল নিয়েই সতীর্থদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মাঠ ছাড়লেন সুনীল।

ম্যাচের আগে সুনীলকে সম্মান জানানোর ক্ষেত্রে ফিফার কিছু বাধা ছিল। তাই ম্যাচ শেষেই সুনীলের জন্য করা হয়েছিল ছোট্ট আয়োজন। সেখানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তরফে স্মারক তুলে দিলেন ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। ছিলেন দমকলমন্ত্রী সুজিত বসু, মেয়র ফিরহাদ হাকিমও। সেই সঙ্গে ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান এবং মহমেডানের পক্ষ ত্থেকেও বিভিন্ন কর্তারা সুনীলকে সম্মান জানালেন। সর্বভারতীয় ফুটবল সংস্থার পক্ষ থেকে ছিলেন প্রেসিডেন্ট কল্যাণ চৌবে। এআইএফএফ-এর পক্ষ থেকেও কর্তারা সুনীলকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন। সকলেই সুনীলকে বিভিন্ন উপহার দিয়ে সম্মান জানান। কেউ তুলে দেন পুষ্পস্তবক, কেউ তুলে দিলেন আঁকা ছবি। শেষে সুনীলের জন্য তৈরি করা ছোট্ট মঞ্চে ডেকে নেওয়া হয় তাঁর মা, বাবা এবং স্ত্রী-কে। মাঠে উপস্থিত ছিলেন সুনীলের শ্যালক অভিনেতা সাহেব ভট্টাচার্যও। তবে ছিলেন না প্রাক্তন ফুটবলার এবং সুনীলের শ্বশুর সুব্রত ভট্টাচার্য।

ম্যাচ শেষে সুনীলের জন্য বাইরে অপেক্ষা করছিলেন সাংবাদিকেরা। কিন্তু তাঁদের ফাঁকি দিয়ে যান তিনি। তিন নম্বর গেট দিয়ে বেরিয়ে যান সুনীল। তবে হতাশ করেননি সাংবাদিকদের। তাঁদের জন্য চিঠি রেখে যান তিনি। সেখানে লেখেন, “গত ১৯ বছরে আপনাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। কখনও অনেক কথা বলেছি, কখনও আবার সব কথা বলতে পারিনি। কথা বলতে গিয়ে কখনও একরাশ বিরক্তি প্রকাশ পেয়েছে। আমি সব সময় আপনাদের সামনে নিজের সঠিক মনোভাবটা তুলে ধরতে চেয়েছি। আমি সব সময় আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছি। সেখানে না চাইতেও শিরোনাম তৈরি হয়ে যাওয়ার ভয় থাকলেও কথা বলেছি।”

সুনীলের সংযোজন, “এই চিঠির মাধ্যমে আমি আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। আপনারাই আমার কথা তুলে ধরেছেন। আমার গল্পটা বলতে সাহায্য করেছেন। আপনাদের ভালবাসার জন্য ধন্যবাদ। আপনাদের কাজটা সহজ নয়। সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ। আমি চাইব আপনারা ভারতীয় ফুটবলের গল্প মানুষকে বলতে থাকুন। সেটা ভাল হোক, বা ততটা ভাল নয়। আমাদের এটা দরকার। আপনারা মাঠে সেরা জায়গাটা পান। আশা করি এই ১৯ বছরে আপনাদের অভিজ্ঞতাটা একটু স্পেশ্যাল করতে পেরেছি। এ বার কখনও একটা, দুটো ম্যাচে আপনাদের সঙ্গে বসে দেখতে চাইব।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.