The Status Of Women At Border Area Of India: West Bengal Border – ভারতবর্ষের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে মহিলাদের অবস্থান সীমান্ত : পশ্চিমবঙ্গ

ড. মনীষা কোঠের, প্রজেক্ট ডিরেক্টর

ড. অঞ্জলি দেশপাণ্ডে, সেক্রেটারী দৃষ্টি স্ত্রী অধ্যয়ন প্রবোধন কেন্দ্র, প্রজেক্ট ডিরেক্টর

শতরূপা, সমীক্ষা সংযোজিকা

দৃষ্টি স্ত্রী অধ্যয়ন প্রবোধন কেন্দ্র, পুণা

ভারতবর্ষের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে মহিলাদের অবস্থান, সীমান্ত – পশ্চিমবঙ্গ

© গ্রন্থসত্ত্ব ও দৃষ্টি স্ত্রী অধ্যয়ন প্রবোধন কেন্দ্র, পুণা

সর্বপ্রকার সত্ত্ব সংরক্ষিত। লিখিত অনুমোদন ছাড়া এই গ্রন্থের কোন অংশ উপস্থাপনা করা হবে না। অনুবাদ : নন্দিনী রায় গ্রন্থ প্রকাশ : ২৪শে ডিসেম্বর ২০১৯, ভারতবর্ষ। প্রকাশক : দৃষ্টি স্ত্রী অধ্যয়ন প্রবোধন কেন্দ্র, পুণা। ঠিকানা : দৃষ্টি স্ত্রী অধ্যয়ন প্রবোধন কেন্দ্র, পুণা।

কৌশিক আশ্রম। ৯৮, মিত্রমণ্ডল কলোনী, পার্বতী পুণা – ৪১১০০৯, মহারাষ্ট্র, ভারতবর্ষ ফোন নং : ০২০-২৪৪২৩৭৯০ (সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৫টা) 3-6267 : [email protected]

ওয়েব সাইট : www.streeadhyayam.org

প্রচ্ছদ : জয়দেব দাস।

সম্পাদনা : পাপিয়া মিত্র মুদ্রণ পরিকল্পনা : মালবিকা চট্টোপাধ্যায় বর্ণসংস্থাপনে : জেএমএস এন্টারপ্রাইসেন্স

১৫সি, ভুবন সরকার লেন, কলকাতা-৭০০০০৭ মো : ৯৮৩১৬৭২৪৯৮ / ৯৮৩০৪ ৭৭৮২৫ – Gary : [email protected] WhatApp : ৯৮৩১৬ ৭২৪৯৮

প্রাককথন

ভারতবর্ষের নারীদের জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত অতি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলি আরও গভীরতর অনুধাবন করার লক্ষ্যে দৃষ্টি স্ত্রী অধ্যয়ন প্রবোধন কেন্দ্র (মহিলা চর্চা কেন্দ্র) স্থাপিত হয়েছে ও দীর্ঘকাল যাবৎ কর্মরত রয়েছে। একইসঙ্গে, সমাজ ও পরিবারের ক্ষেত্রে এই সমস্যাগুলির প্রভাব কি প্রকার সে বিষয়েও দৃষ্টিপাত করা হয়েছে।

গবেষণাকারীদের সুবিধার্থে প্রয়োজনীয় তথ্যসংগ্রহ, দলিলীকরণ ও সেগুলির উপযুক্ত ক্ষেত্রে যোগান দেওয়ার কাজে আমরা নিয়োজিত রয়েছি। চর্চা কেন্দ্র স্থাপনের অভিপ্রায় গ্রহণের সময় থেকেই আমরা সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে ‘মহিলা বিশ্ব’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু করেছি। আমাদের সংগৃহীত তথ্যগুলি বিবিধ বিষয়ে শ্রেণীবদ্ধ, যেমন—স্বাস্থ্য, শিক্ষা, রোজগার, আইন, কর্মসংস্থান, হিংসাত্মক কার্যকলাপ, সংস্কৃতি ইত্যাদি। উক্ত তথ্যগুলি সমাজসেবী ও গবেষকদের কাজের জন্য অত্যন্ত সহায়ক। দৃষ্টির বার্ষিক বিশেষ সংখ্যা নির্দিষ্ট কোন একটি বিষয় বা সমস্যা নিয়ে প্রকাশিত হয়, উদাহরণস্বরূপ, স্ত্রী-ভ্রূণ হত্যা, নারীস্বাস্থ্য, কর্মরত মহিলাদের সমস্যা, মহিলা ও সুরক্ষা, সিদ্ধান্তকারীরূপে নারীর ভূমিকা, নারী ও অর্থনীতি, নারীপাচার ইত্যাদি।

‘দৃষ্টি’ মূলতঃ সমাজে নারীর অবস্থানগত পরিস্থিতি বিষয়ে অধ্যয়ন করে। সমীক্ষা, প্রতিবেদন ও সুপারিশের মাধ্যমে এই পরিস্থিতির উন্নতির লক্ষ্যে সাহায্য করার চেষ্টা করে। এপর্যন্ত রাজ্য সরকার ও কেন্দ্র সরকার দ্বারা নারী বিষয়ক নীতি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্যভাবে আমাদের প্রতিবেদন কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করেছে।

আমাদের গবেষণামূলক প্রতিবেদনগুলির উদ্দেশ্য হল, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মহিলারা যে বিবিধ প্রকারের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন তা নথিবদ্ধ করা এবং তার ব্যাখ্যা প্রদান করা।

একটি চর্চাকেন্দ্র হওয়ার সূত্রে ‘দৃষ্টি সমস্যাগুলির পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মনন ও অনুশীলনের ওপর জোর দেয়। প্রতিবেদনগুলিকে বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষণের মাপকাঠিতে প্রামাণিক হিসাবে পরিগণিত করে। ফলতঃ যে কোন সরকারী বা সমাজসেবী সংস্থা এর ভিত্তিতে তাদের নীতি, কার্যপদ্ধতি, কাজের ক্ষেত্র নির্বাচন করতে পারে। দৃষ্টি’র পশ্চিমবঙ্গের স্বেচ্ছাকর্মীবৃন্দ সেখানকার পরিস্থিতির একটি স্বচ্ছ চিত্র তুলে ধরার প্রয়াসে অত্যন্ত মননশীলতার সঙ্গে কাজ করেছেন। অন্যান্য সমাজসেবী ও সাংবাদিকবৃন্দও এই নিরীক্ষা ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সাহায্য করেছেন। আমরা তাদের অবদানের জন্য কৃতজ্ঞ। সরকারী নীতি নির্ধারণ ও সমাজসেবী সংস্থাগুলির কার্যপদ্ধতি নিরূপণের ক্ষেত্রে। নিরীক্ষার ফলাফল ও সুপারিশগুলি কার্যকরী ভূমিকা নিতে সক্ষম হবে।

সমস্যাগুলির বিষয়ে আপনাদের অভিমত প্রকাশের মাধ্যমে আমাদের পরবর্তী সমীক্ষা ও উদ্দিষ্ট এলাকার পরিবারসমূহের শান্তিপূর্ণ জীবনযাত্রা স্থাপনের লক্ষ্যে আমাদের প্রচেষ্টায় সহায়তা প্রদানের জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।

ডঃ মনীষা কোঠেকার, প্রজেক্ট ডিরেক্টর

ডঃ অঞ্জলি দেশপাণ্ডে, সম্পাদক, দৃষ্টি স্ত্রী অধ্যয়ন প্রবোধন কেন্দ্র

স্বীকৃতি

আমরা দক্ষিণবঙ্গের সীমান্ত এলাকায় মহিলাদের অবস্থান সম্পর্কে সমীক্ষা পরিচালনা করেছিলাম। সীমান্ত অঞ্চলে মহিলাদের অবস্থার প্রকৃত মূল্যায়ন করা বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বেশ কঠিন। এই অঞ্চলগুলিতে মহিলারা অপরিচিত ও বহিরাগত ব্যক্তিদের কাছে নিজেদের সম্পর্কে কথা বলতে কিছুটা অনিচ্ছুক। এই পরিস্থিতিতে আমাদের মহিলা সাক্ষাৎকারীদের বহুবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তৎসত্ত্বেও, তারা নিজ ব্যয়ে সীমান্তবর্তী বিভিন্ন গ্রামগুলিতে পরিদর্শন করতে দ্বিধাগ্রস্ত হন নি। এই সমীক্ষাটি সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র মুর্শিদাবাদ, বারাসাত, নদীয়া ও বসিরহাট জেলার স্থানীয় প্রতিনিধিদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে। আমরা তাদের কাছে একান্তভাবে কৃতজ্ঞ।

বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী সামাজিক সংগঠন প্রশিক্ষণ ও বৈঠকের জন্য স্থান প্রদান করে আমাদের সহযোগিতা করেছেন। তাদের সহযোগিতার ফলে আমরা ডাক ব্যবস্থার মাধ্যমে পাঁচশত কপি নমুনা সমীক্ষা পাঠাতে পেরেছি। আমাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা রইল তাদের প্রতি। এছাড়াও আমরা ধন্যবাদ জানাই বিভিন্ন সংগঠন থেকে আসা মহিলাদের নিয়ে তৈরি ‘মাতৃশক্তি’ গোষ্ঠীর সদস্যাদের—সমীক্ষার ক্ষেত্রে তাদের অবদানের জন্য।

প্রণাম

শতরূপা (স্টাডি কোঅর্ডিনেটর)

ভারতবর্ষের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বিশেষতঃ পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী নারীদের অবস্থা ও পরিস্থিতি

ভূমিকা

এই বিশেষ প্রতিবেদনটি একটি সর্বভারতীয় সমীক্ষার অংশবিশেষ। আন্তর্জাতিক সীমানাসংলগ্ন রাজ্যগুলি বিশেষ অভিনিবেশের দাবি রাখে। সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী মহিলারা অন্যান্য রাজ্যের মহিলাদের থেকে অনেক বেশি প্রতিকূলতার সম্মুখীন হন। সীমান্ত অঞ্চলের মহিলাদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার নিশ্চিতিকরণ সর্বাগ্রে চিন্তনীয় বিষয়।

পশ্চিমবঙ্গ এবং জম্মু-কাশ্মীরের সীমান্ত সমস্যাগুলির তুলনামূলক আলোচনায় যদিও সামান্য, কিন্তু অর্থপূর্ণ পার্থক্য চিহ্নিত করতে পারা যায়। জম্মু-কাশ্মীরের সীমান্ত সমস্যা আরও বেশি জটিল এবং সেখানে সংঘাতও অনেক তীব্র। তুলনায় বাংলাদেশ সীমান্ত আপাতভাবে অনেক শান্ত হলেও এখানকার অন্যান্য অনেক বিষয় উদ্বেগজনক যা অবহেলা করা যায় না। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত অঞ্চলে অনুপ্রবেশের সুযোগ বেশী এবং বাংলাদেশের থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশ ভারতবর্ষের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি বড় ভীতির কারণ। পশ্চিমবঙ্গের সীমানা বরাবর রয়েছে বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মতো দেশগুলি। সীমান্ত অঞ্চলে বসবাসকারী মহিলাদের কিছু বিশেষ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এই বিষয়টি বিবেচনায় রেখে পশ্চিমবঙ্গের সমীক্ষক দল দক্ষিণবঙ্গের মহিলাদের পরিস্থিতির উপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতে মনস্থ করেছে।

পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত জেলাগুলির জনসংখ্যার পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। নারী পাচার ও গরু চুরি অন্যতম গুরুতর সমস্যার উদাহরণ। এই পটভূমিতে পশ্চিমবঙ্গের নারীদের সমস্যা সম্পর্কিত প্রতিবেদনটি সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ।

গবেষণার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঃ

১) ভারতবর্ষের জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্যের সাপেক্ষে নারীদের অবস্থান।

২) শিক্ষা, রোজগার ও স্বাস্থ্যের নিরিখে ভারতীয় নারীদের অবস্থান নির্ণয়।

৩) ভারতবর্ষের নারীদের সমস্যার মূল কারণগুলিকে চিহ্নিত করা।

৪) ভারতীয় নারীদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে গৃহীত নীতিগুলির মধ্যে যদি কোন ফঁক থাকে তা খুঁজে বের করা।

৫) নারীদের পরিস্থিতির উন্নতিকল্পে বিভিন্ন পরিকল্পনা ও কৌশল সুপারিশ করা।

বর্তমান সমীক্ষাটির উদ্দেশ্যগুলি নিম্নরূপে সংজ্ঞায়িত হল – দক্ষিণবঙ্গের সীমান্ত জেলাগুলিতে নারীদের পরিবারগত অবস্থান, স্বাস্থ্য-পরিষেবার, শিক্ষালাভের সুযোগসুবিধা, কর্মসংস্থান এবং নানান সমস্যা ও বিরোধিতার মোকাবিলার বিষয়গুলির চর্চা ও অধ্যয়ন।

সমীক্ষা ও নমুনার নকশা :

এই সমীক্ষার প্রয়োজনে একটি বিশদ প্রশ্নমালা প্রস্তুত করা হয়েছিল। এতে মোট ৩১টি প্রশ্ন সংকলিত হয়েছে। প্রশ্নগুলি হিন্দী ও ইংরাজী উভয় ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে। দক্ষিণবঙ্গের তিনটি জেলায় মুর্শিদাবাদ, নদীয়া এবং উত্তর চব্বিশ পরগণার বসিরহাট ও বারাসাত অঞ্চলে এই সমীক্ষাটি গৃহীত হয়েছিল। ৪৭ জন স্থানীয় মহিলা স্বেচ্ছাকর্মীকে এই কাজে মনোনীত করা হয়েছিল। ২০১৭ সালের মার্চ মাসে কলকাতার পারেখ ভবনে সমীক্ষার প্রশ্নমালাটি সঠিক উপস্থাপনার বিষয়ে সারাদিনব্যাপী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। স্বেচ্ছাকর্মীদের বয়ঃসীমা ছিল ২৪-৪০ এবং তাদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল উচ্চমাধ্যমিক পাস। উল্লিখিত ৪টি স্থানেই ২ জন করে সংযোজিকা সমীক্ষার কাজের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। নির্বাচিত নমুনাগুলি সহজবোধ্য ও উদ্দেশ্যের পরিপূরক ছিল। মূলতঃ দূরবর্তী সীমান্তসংলগ্ন গ্রামগুলিতে মোট ৪৬৬ জন উত্তরদাতার মধ্যে প্রশ্নমালাটি পরিবেশিত হয়েছিল। উত্তরদাতারা মূখ্যতঃ বিবাহিতা মহিলা যাদের বয়স ২০-৬০ বছরের মধ্যে।

আলোচনা ও সিদ্ধান্ত

দক্ষিণবঙ্গে সীমান্ত অঞ্চলে বসবাসকারী মহিলাদের সম্পর্কিত এই সমীক্ষাটি তাদের শিক্ষা, পারিবারিক পরিস্থিতি, কর্মনিযুক্তি, স্বাস্থ্য পরিষেবার লভ্যতা ও তাদের সমস্যাগুলির বিষয়ে মূল্যবান তথ্য সরবরাহ করেছে।

পশ্চিমবঙ্গে নারীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান

ভূমিকা :

দৃষ্টি, স্ত্রী অধ্যয়ন কেন্দ্র (নারী চর্চা কেন্দ্র) একটি তথ্য দলিলীকরণ ও গবেষণা কেন্দ্র যার স্থাপনা হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। এই কেন্দ্রের কাজ হল ভারতবর্ষের নারীদের বিবিধ সমস্যামূলক বিষয়গুলিকে সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গীতে অনুধাবন করা। এই কেন্দ্র বিভিন্ন সংবাদপত্র ও পত্রিকা থেকে নারী সংক্রান্ত বিষয়ে প্রকাশিত খবরাখবর ও প্রবন্ধ সংগ্রহ করে মাসিক প্রকাশনী মহিলা বিশ্ব’-র মাধ্যমে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সংক্ষিপ্ত বিবরণ ও বিবিধ ক্ষেত্রে মহিলাদের সফলতার কাহিনী প্রকাশ করে থাকে। ভারতবর্ষের মহিলাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার মূল্যায়ন করার লক্ষ্যে ‘দৃষ্টি বিভিন্ন প্রদেশে সমীক্ষা কার্য পরিচালনা করেছে।

সাহিত্যিক পর্যালোচনা

যে বৃহত্তর ক্ষেত্রটিতে আমরা এই সমীক্ষার ফলাফলকে প্রয়োগ করতে পারি সেটি হল সীমান্ত ও লিঙ্গবৈষম্যমূলক চর্চা। খুব স্বল্পসংখ্যক লেখা এই প্রসঙ্গে পাওয়া গেছে। প্রথম যে বইটি পশ্চিমবঙ্গ ও জম্মু-কাশ্মীর প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সেটি হল পলা ব্যানার্জী ও অনুসূয়া বসু রায়চৌধুরি সম্পাদিত ভারতের সীমান্ত অঞ্চলের নারীরা (Women in Indian Borderlands)। সেজ প্রকাশনীর এই বইটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের প্রতিবেদন প্রস্তুতিতে বইটি নির্দেশক গ্রন্থ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়াও আরেকটি প্রয়োজনীয় গ্রন্থ, যা বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে তা হল সীমা শেখাওয়াত ও অন্যান্য দ্বারা সম্পাদিত ‘নারী ও সীমান্ত ও উদ্বাস্তু, অভিবাসী ও সম্প্রদায়সমূহ’ শীর্ষক রচনাটি। এই বইটি লিঙ্গসংক্রান্ত ও হিংস্রতার বিষয়কেন্দ্রিক এবং এতে সীমান্ত সংক্রান্ত বিষয়ে জড়িত মহিলাদের অভিজ্ঞতার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করার প্রচেষ্টা রয়েছে।

‘পশ্চিমবঙ্গের নারীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান’ শীর্ষক বিশেষ প্রতিবেদনে আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি কিভাবে সীমান্ত অঞ্চলের সমস্যাগুলি ভারতীয় মহিলারা প্রাত্যহিক জীবনে মোকাবিলা করে।

তালিকা-১

উত্তরদাতাদের বাসস্থান

উত্তরদাতাদের স্থান ও জেলা

মুর্শিদাবাদ ১২৯

নদীয়া ১২৪

বসিরহাট (উঃ ২৪ পরগণা) ১২২

বারাসাত ( – ঐ – ) ৯১

মোট – ৪৬৬

উপলব্ধি ও পর্যবেক্ষণ

ধর্মীয় আচরণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তরদাতাদের বৃহদংশ অর্থাৎ ৪১৮ জন (৯১.৮৫%) জানান যে তারা হিন্দু এবং ৩৬ জন (৭.৭৩%) জানান তারা মুসলিম। একজন শিখ ও একজন বৌদ্ধ উত্তরদাতা ছিলেন। ৫৮.৮% উত্তরদাতা তপশীল জাতিভুক্ত, ১০.৯৪% ওবিসি এবং ২৫.৭৫% ওপেন ক্যাটেগরিভুক্ত।

যদিও ৭৫.৯৭% উত্তরদাতার নিজস্ব ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট রয়েছে (এটি সরকারের জন-ধন যোজনার ফল হওয়া সম্ভব), কেবলমাত্র ২২.১% উত্তরদাতার প্যান কার্ড রয়েছে। প্যান কার্ড মূলতঃ আয়কর জমা দেওয়ার কাজে বা অন্যান্য বৃহৎ আর্থিক লেনদেনের জন্য ব্যবহৃত হয়। প্যান কার্ড অধিকারীর সংখ্যা স্বল্প হওয়ার অর্থ অধিকাংশ মহিলা উত্তরদাতার বড় অঙ্কের আয়ের অভাব এবং রোজগারের সুযোগ না থাকার ইঙ্গিত। এই পর্যবেক্ষণ পেশা ও আয় সংক্রান্ত তথ্যের দ্বারা সমর্থিত।

উত্তরদাতাদের মধ্যে বৃহত্তর অংশ (৭৩.১৮%) গৃহিণী, ৫.৫৮% ছাত্রী, বাকী ১২.৪৫% খুচরা শ্রমিক যারা মরসুমভিত্তিক বা দৈনিক মজুরি পান। যে সমস্ত মহিলারা স্ব-নিযুক্তি প্রকল্পে যুক্ত অথবা সরকারী / বেসরকারী চাকরি করেন তাদের সংখ্যা ১০%-এর কম। বেশিরভাগ – ৭৮.৩৩% পরিবারের মোট মাসিক উপার্জন ১০,০০০ টাকার কম। ১৬.৩১% পরিবার মাসে দশ-কুড়ি হাজার টাকা উপার্জন করে এবং দশটি পরিবারের মাসিক আয় কুড়ি-পঞ্চাশ হাজার টাকা।

তালিকা-২

পেশা সংখ্যা প্রতিশত

ছাত্রী ২৬ ০৫.৫৮

গৃহবধূ ৩৪১ ৭৩.১৮

বেসরকারী কর্মী ১৪ ৩.০০

সরকারী কর্মী ৫ ১.০৭

স্বনিযুক্তি ২২ ৪.৭২

(ঠিকা কাজ) দৈনিক মজুরী ভিত্তিক ৫৮ ১২.৪৫

নারী ক্ষমতায়নের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি হল শিক্ষাগত যোগ্যতা। সমীক্ষাভুক্ত এলাকার প্রায় ১৩.৭৩% মহিলা নিরক্ষর। অষ্টম থেকে একাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষালাভ করেছেন এমন মহিলার সংখ্যা সর্বাধিক ২৮.৭৬%। ১১-১২ ক্লাশ পর্যন্ত পড়েছেন ৭.৯৪%। মাত্র ৬.৮৭% মহিলা স্নাতক স্তর পর্যন্ত পড়েছেন ও শুধুমাত্র ১.৯৩% মহিলা স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেছেন। শিক্ষালাভ করার ক্ষেত্রে অর্ধেকেরও বেশি (৫৮.৫৩%) মহিলা আর্থিক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। এছাড়া একটি মুখ্য সমস্যা হল পারিবারিক সমর্থনের অভাব। শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে পারিবারিক দায়িত্বভার ও নিকটবর্তী এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাবও অন্যান্য বাধাগুলির অন্যতম যা মহিলাদের কাটিয়ে উঠতে হয়।

তালিকা-৩

যে পর্যায়ে শিক্ষা বিরতি

পর্যায় সংখ্যা প্রতিশত

প্রাথমিক ৭৬ ১৯.৯৫

মধ্যস্তর ৯২ ২৪.১৫

উচ্চ বিদ্যালয় ১২৭ ৩৩.৩৩

উচ্চ মাধ্যমিক ৩১ ৮.১৪

স্নাতক শিক্ষা চলাকালীন ১০ ২.৬২

স্নাতক পরবর্তী ১৪ ৩.৬৭

স্নাতকোত্তর শিক্ষার পর ৫ ১.৩১

মোট ৪৫.০৭% উত্তরদাতা জানিয়েছেন অল্প বয়সে বিয়ের কারণে তাদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। আর্থিক অনটন হল দ্বিতীয় গুরুতর সমস্যা, যার জন্য অকালে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। এই প্রসঙ্গে আরেকটি তথ্য উল্লেখের প্রয়োজন যে, ৩২.৮১% মহিলা খোলাখুলিভাবে জানিয়েছেন, শিক্ষাক্রমের পাঠ্যসূচী তাদের জীবনযাত্রার সাথে সম্পৰ্করহিত, যদিও তারা এর কারণ ব্যাখ্যা করতে পারেননি। মহিলাদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, তারা কি ধরণের দক্ষতা প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। আশ্চর্যজনকভাবে একটা বড় অংশের (৮২.৬২%) মহিলারা জানিয়েছেন যে, তারা কখনো কোন দক্ষতা অর্জনকারী প্রশিক্ষণ কর্মশালা বা কার্যক্রমে যোগদান করেননি।

উত্তরদাতাদের মধ্যে ৫৭% অণু-পরিবারের সদস্য, যা আজকাল ভারতবর্ষের অধিকাংশ শহর ও শহরতলীর বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যৌথ পরিবারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে ৩৯% এবং ৪% হল শাখা-প্রশাখাযুক্ত পরিবার।

সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, মহিলারা খুব একটা অবসর সময় পান না, ফলে তাদের পক্ষে ব্যক্তিগত কোন আগ্রহের বিষয়কে অনুসরণ করা সম্ভব হয় না। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসার সময় ৪১.৬৩% উত্তরদাতা জানিয়েছেন, তারা বিশেষ অবসর সময় পান না। বাকিদের অবসর সময় কাটানোর উপায় জিজ্ঞাসা করা হলে ১৭.৬০% জানিয়েছেন যে, তারা টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখতে পছন্দ করেন। ৭% মহিলারা বইপড়া, সেলাই, উলবোনা ইত্যাদি কাজে অবসর কাটান। প্রাপ্ত উত্তরের থেকে প্রতিফলিত হয়েছে যে, মাত্র ৩৩ জন মহিলা উত্তরদাতা প্রতিদিন কিছু না কিছু অধ্যয়ন করেন এবং ২২ জন সঙ্গীতচর্চার জন্য প্রত্যহ কিছু সময় ব্যয় করতে পারেন।

রোজগার সংক্রান্ত বিষয়ে জিজ্ঞাসার উত্তরে ৪৬৬ জন উত্তরদাতার মধ্যে ৯৯ জন (২১.৩%) কোন না কোন কাজের সাথে যুক্ত বলে জানিয়েছেন। মাত্র ১২ জনের পূর্ণ সময়ের কাজ আছে। বৃহৎ অংশের (৭৪ জন) মহিলারা কেবলমাত্র ঠিকা কাজ করেন ও ১৩ জন উত্তরদাতা চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন। এর পেছনে নানা কারণ থাকা সম্ভব। মহিলাদের ঘরের নানাবিধ কাজ ছাড়াও সন্তান পালনের দায়িত্ব নিতে হয়। সুতরাং, তাদের পক্ষে পূর্ণকালীন কাজ করা সম্ভব হয় না। আরেকটি কারণ হল শিক্ষাগত ও দক্ষতাগত যোগ্যতার অভাব। কেবলমাত্র ৩৫ জন দক্ষ এবং ২০ জন আধা-দক্ষ কর্মী হিসাবে নিযুক্ত। উপরোক্ত তথ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গে সীমান্তবর্তী এলাকার মহিলাদের মধ্যে দক্ষতা উন্নয়নমূলক ট্রেনিং / প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা লক্ষণীয়। অণু-পরিবারের সংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধির কারণে ও পরিবারগুলিতে শিশুদের দেখাশোনার জন্য বয়স্ক ব্যক্তির অভাবে মহিলাদের কর্মানুসন্ধানের ইচ্ছা, উৎসাহহীনতা এবং কর্মপ্রাপ্তির সম্ভাবনা সংকুচিত হয়ে যায়।

দারিদ্র্যের কারণে দৈনিক আহারের পরিমাণ ও ধরণও সীমাবদ্ধ। প্রায় ২৩.৬১% মহিলা দিনে দু-বার আহার করতে পারেন এবং ৬৯.৩১% মহিলা দিনে ৩ বার আহার গ্রহণ করেন। শুধুমাত্র ৩৪.৫৫% মহিলা প্রতিদিন ভরপেট আহার যোগাড় করতে সক্ষম।

লেখচিত্র-১

স্বাস্থ্য পরিষেবা

সরকারী হাসপাতাল ৭৭.২৫%

বেসরকারী হাসপাতাল ১৬.৭৪%

বেসরকারী ও সরকারী হাসপাতাল ৬.০১%

শারীরিক অসুস্থতার ক্ষেত্রে ৫৬.৪৪% মহিলা দাবি করেছেন যে, তাদের কোন অসুস্থতা নেই। কিন্তু বাকিরা উচ্চ-রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসে ভুগছেন এবং ৭.৯৪% মহিলা স্ত্রী-রোগজনিত সমস্যার শিকার। আরেকটি প্রশ্নের উত্তর প্রসঙ্গে ৭৭.২৫% মহিলা উল্লেখযোগ্যভাবে জানালেন যে তারা হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ পান।

একটি বড় অংশের মহিলারা (৬৩.৩০%) বলেছেন যে, তাঁরা সুখী ও সন্তুষ্ট। তারা তাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবন উপভোগ করছেন। এক-তৃতীয়াংশ মহিলা স্থিতিশীল জীবনযাপন করছেন। প্রায় ৩.৮৬% মহিলা জানিয়েছেন তারা বর্তমান জীবন নিয়ে অত্যন্ত খুশি এবং ১.২৯% একদমই খুশি নন।

মহিলাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তারা কতদিন যাবৎ ওই অঞ্চলের বাসিন্দা। কিছুজন দেশভাগের আগে থেকে সেখানে বসবাস করছেন আবার অন্যরা অভিবাসী হিসাবে এসেছেন।

অভিবাসনের পেছনে কি কি কারণ ছিল তাও জানতে চাওয়া হয়েছিল।

তালিকা-৪

অভিবাসনের কারণ

এদেশে চলে আসার কারণ সংখ্যা প্রতিশত

জবাব দেননি ২১২ ৪৫.৪৯%

দেশভাগের কারণে ৪২ ৯.০১%

সাম্প্রদায়িক নৃশংসতা ২৫ ৫.৩৬%

মুসলমানদের দ্বারা অত্যাচারিত ৩৭ ৭.৯৪%

মুসলমানদের হাত থেকে পরিবারকে রক্ষা করার জন্য ১৫ ৩.২২%

স্থানীয় বাসিন্দা ৩২ ৬.৮৭%

বিবাহসূত্রে আসা ৬২ ১৩.৩০%

উপার্জনের খোঁজে ২৯ ৬.২২%

পারিবারিক কারণ ৮ ১.৭২%

উন্নত জীবনে আশায় ৩ ০.৬৪%

বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রসীমা বৃদ্ধির ফলে গৃহহীন হয়ে ১ ০.২১%

সরকারের উচিত সীমান্ত সুরক্ষার প্রতি কড়া নজরদারি রেখে মুসলমানদের আগ্রাসন রোধ করা এবং বঙ্গোপসাগরের জলসীমা বৃদ্ধি ভবিষ্যতে যেন বড় সমস্যা না হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য এখন থেকে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

উত্তরদাতাদের আরও প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, তাদের নিজস্ব বাড়ি আছে কিনা এবং অন্য কোন সম্পত্তির তারা মালিক কিনা। মোট ৪১৩ জন (৮৮.৬৩%) মহিলা নিশ্চিতভাবে জানিয়েছেন যে, তাদের নিজস্ব বাড়ি আছে এবং ২৯.৪০% মহিলার নিজস্ব জমি-জমা রয়েছে।

পরিবার পরিকল্পনা

সমীক্ষার সময় আরও তথ্য পাওয়া গেছে যে, তিন-চতুর্থাংশ উত্তরদাতার মাত্র একটি বা দুটি সন্তান। এর থেকে বোঝা যায় যে, সরকারী ও সমাজসেবী সংস্থাগুলির জন্ম নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়েছে। ৬৩.১১% মহিলা যে বাড়ির পরিবর্তে হাসপাতালে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, এটি মা-ও শিশুর স্বাস্থ্যের পরিস্থিতির উন্নতির দ্যোতক। এছাড়া আরেকটি ইতিবাচক দিক হল প্রত্যেক মা তাঁর সন্তানদের টীকাকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।

জল সরবরাহ ব্যবস্থা

জল সরবরাহের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, ৫১.৭২% কলের জল ব্যবহার করেন ও বাকিরা টিউবওয়েল, জলাশয় বা পুষ্করিণীর জল ব্যবহার করেন। ২৬% মহিলা উত্তরদাতাদের গৃহে কোন শৌচালয়ের ব্যবস্থা নেই এবং মাত্র ৫.৮% উত্তরদাতার সরকারী শৌচাগার ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। সুতরাং এক-পঞ্চমাংশ মহিলা উত্তরদাতার খোলা জায়গায় মল-মূত্রত্যাগ করা ছাড়া কোনো উপায়ন্তর নেই। সীমান্ত অঞ্চলে বসবাসকারী মহিলাদের পক্ষে এই ধরণের পরিস্থিতি খুবই দুঃখজনক কারণ নারী সুরক্ষা ও নিরাপত্তা এই অঞ্চলগুলিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা।

লেখচিত্র-২

স্বাস্থ্য পরিষেবা

বাড়িতে শৌচাগার আছে?

হ্যাঁ ৭৪%

না ২৬%

দৈনন্দিন রন্ধনকাজে জ্বালানী

দৈনন্দিন রান্নার কাজে ব্যবহৃত জ্বালানী মহিলাদের জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি তাদের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলতে সক্ষম। সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ৬১.৩৭% মহিলা স্টোভ ব্যবহার করলেও এলপিজি গ্যাস ব্যবহারকারীর সংখ্যা মাত্র ৩১.৩৩%। এর থেকে বোঝা যায় যে সীমান্ত এলাকায় উজ্জ্বলা’ প্রকল্প-র বাস্তবায়ন বেশ দুরূহ।

পরিচ্ছন্নতা

উত্তরদাতাদের তাদের গৃহস্থালী ও আশেপাশের পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রায় ৮২.৬২% উত্তরদাতা জানিয়েছেন, তাঁরা তাঁদের গৃহ ও গৃহসংলগ্ন এলাকার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে সন্তুষ্ট। যদিও, ১৭.৩৮% মহিলা তাদের গৃহসংলগ্ন এলাকার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

চিকিৎসা পরিষেবা

একটি প্রশ্ন ছিল চিকিৎসার সুযোগ ও সহজলভ্যতা বিষয়ক। প্রায় ৮৮.৪১% উত্তরদাতা জানিয়েছেন এই ধরণের সুযোগ-সুবিধা নিকটবর্তী এলাকায় সহজেই পাওয়া যায়। এই বিষয়ক আরেকটি প্রশ্নের উত্তরে ৭৮.৩৩% উত্তরদাতা জানিয়েছেন যে, তারা নিয়মিত এলাকার চিকিৎসাকেন্দ্র উপযোগ করে থাকেন এবং এ বিষয়ে তাদের বিশেষ কোন অভিযোগ নেই। এই সূত্রে ছোঁয়াচে রোগ এবং মহামারী সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে জানা যায় যে, সীমান্ত এলাকায় সার্বিকভাবে স্বাস্থ্যের হাল বেশ ভালো এবং এবিষয়ে তেমন উদ্বেগের কোন কারণ নেই।

পারিবারিক জীবন

দুর্ভাগ্যবশতঃ উত্তরদাতাদের যখন তাদের পারিবারিক জীবনে সুখের বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় তখন ৪৪% বলেন যে, পারিবারিক জীবনে তারা সুখী নন এবং অধিকাংশের মতে দুর্বল আর্থিক অবস্থাই এর জন্য দায়ী।

সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা

সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলিতে নারী সুরক্ষা ও নিরাপত্তা সবসময়ই একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয়। পশ্চিমবঙ্গও এর থেকে মুক্ত নয়। সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ৩৯% মহিলা উত্তরদাতা গুন্ডামি, সীমান্তের অন্য পার থেকে আক্রমণ ইত্যাদি কারণে অসুরক্ষিত বোধ করেন। বিশেষতঃ ৬.৬৭% উত্তরদাতা জানিয়েছেন এর কারণ হল এলাকার মুসলমানদের দ্বারা নিপীড়ন ও হয়রানি। বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত এলাকার জন্য একটি গুরুতর সমস্যা।

তালিকা-৫

গ্রামে মহিলারা নিরাপদ নন কেন?

নিরাপত্তাহীনতার কারণ প্রতিশত

যৌন হয়রানি ৭.৯৪

উত্যক্ত করা ১২.৪৫

অবৈধ পাচার ১৫.২৪

অন্যান্য ১.৫০

অবৈধ নারী ও শিশুপাচার

সীমান্তে বিশেষতঃ গ্রামগুলিতে, নারী ও শিশুপাচার, ইভটিজিং, যৌন হেনস্থার মত অনৈতিক কুকর্মগুলি মহিলাদের অসুরক্ষিত বোধ করতে বাধ্য করে ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এগুলি অত্যন্ত বিপজ্জনক। ১৫.২৪% উত্তরদাতা এই কারণগুলিকে গ্রামে নিরাপত্তার অভাব বোধ করার হেতু বলে চিহ্নিত করেছেন। ইভটিজিং (১২.৪৫%) ও যৌন হেনস্থা (৭.৯৪%) দুটি প্রধান সমস্যা। ফলতঃ প্রায় ৯০% মহিলা রাত্রে বাড়ির বাইরে যেতে বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ বোধ করেন।

লেখচিত্র-৩

আপনারা কি নিরাপদ?

হ্যাঁ ৩৯%

না ৬১%

বাজার করা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজের জন্য তারা সকাল বা দুপুরবেলাই পছন্দ করেন। বাইরে বেরোতে হলে তাদের সঙ্গী থাকে কিনা এই প্রশ্নের উত্তরে ৫৭.৯৪% মহিলা নিশ্চিতভাবে জানিয়েছেন যে তারা কোন সঙ্গী ছাড়াই বাইরে যাতায়াত করেন। কিন্তু ২৭.০৪%-র কাছাকাছি মহিলা জানিয়েছেন তারা বাইরে বেরোতে হলে স্বামীর সঙ্গে যেতে পছন্দ করেন। এই তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, সরকার ও স্থানীয় আধিকারিকদের উচিত সীমান্ত এলাকায় মহিলাদের সুরক্ষার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা। এই পরিপ্রেক্ষিতে যখন তাদের জিজ্ঞাসা করা হয় যে তারা উপার্জনশীল হওয়ার ক্ষেত্রে পরিবারের অনুমতি পান কিনা, ৭৬.৬১% উত্তরদাতা ইতিবাচক উত্তর দেন। এটি মহিলাদের পরিবারের একজন উপার্জনশীল সদস্য হিসাবে উদ্যোগী হওয়ার ক্ষেত্রে পরিবারের সমর্থনের দ্যোতক। ভারতীয় সমাজের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এটি একটি ইতিবাচক দিক। কিন্তু আমাদের ভুললে চলবে না যে ২৩.৩৯% উত্তরদাতা বাড়ির বাইরে কাজের অনুমতি পান নি যার কারণগুলি হল—বাড়িতে কাজের চাপ, নিরাপত্তার অভাব, পরিবারের সদস্যদের মতের অমিল, যৌন হেনস্থা, কর্মদক্ষতার অভাব ইত্যাদি। এই সূত্রে যখন তাদের সরকারী অনুষ্ঠান ও কার্যক্রমে উপস্থিতির বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় তখন অর্ধেক উত্তরদাতাই জানিয়েছেন যে তারা এ জাতীয় অনুষ্ঠান বা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন না।

লেখচিত্র-৪

নিরাপত্তাহীনতার কারণ

সীমান্তের অন্য পার থেকে আক্রমণ ৫০.৫৬%

অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ৩৬.১১%

গুণ্ডামি ১৩.৮৯%

মুসলমানদের দ্বারা অত্যাচার ও হয়রানি ৬.৬৭%

পরিশেষে, সকল উত্তরদাতাকে সরাসরি প্রশ্ন করা হয় যে তারা তাদের বর্তমান বাসস্থান থেকে দূরে অন্য যেকোন স্থানে বসবাস করতে পছন্দ করবেন কিনা।

উত্তরদাতারা এক্ষেত্রে প্রায় সমান সমান দুটি দলে বিভক্ত হয়ে যান। প্রায় ৪৮% মহিলা যাঁরা পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত অঞ্চলে বসবাস করেন তাঁরা তাঁদের বাসস্থান নিয়ে অখুশি। সুযোগ পেলেই তারা অন্য কোন জায়গায় চলে যেতে আগ্রহী।

সর্বশেষ প্রশ্নটি সীমান্তবর্তী এলাকার মহিলাদের মনোভাবের সার কথাটি প্রকাশ করেছে। পূর্ববর্তী প্রশ্নগুলির উত্তর অনুধাবন করলে প্রতিপন্ন হয় যে সুরক্ষা ও নিরাপত্তার সমস্যাই মহিলাদের পরিবারসহ অন্যত্র অভিবাসী হওয়ার ইচ্ছার কারণ। সীমান্ত এলাকায় সুরক্ষা ও নিরাপত্তার পরিবেশ মহিলাদের পক্ষে সহায়ক নয়। এটি একটি দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি। সরকারের দায়িত্ব সীমান্ত অঞ্চলে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা বৃদ্ধি করা ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে ক্রমশঃ বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি করা, বিশেষতঃ মহিলারা যেন তাদের নিজের দেশের মাটিতে অবাধে চলাফেরা ও কাজকর্ম করতে পারেন তার ব্যবস্থা করা।

সুপারিশ

দক্ষিণবঙ্গের উপস্থাপিত সমীক্ষার ফলাফল ও আলোচনার ভিত্তিতে গবেষকদল নিম্নলিখিত সুপারিশগুলি পেশ করতে আগ্রহী।

১// পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী এলাকায় মহিলাদের কার্যকরী ও অর্থপূর্ণ কাজের সুযোগের অভাব রয়েছে। আর্থিক ক্ষেত্রে মহিলাদের সংযোজিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ দ্বারা তাদের চাকরি ও ব্যবসার ক্ষেত্রে যথাসাধ্য সুযোগ প্রদান করা উচিত।

২// মহিলা শিক্ষার্থীদের শিক্ষা চলাকালীন পড়া ছেড়ে দেবার হার উল্লেখযোগ্য। স্নাতক স্তরের পড়াশোনা সম্পূর্ণ করার আগেই অধিকাংশ মহিলা শিক্ষার্থী পড়া ছেড়ে দেন। শিক্ষা পাঠ্যসূচিও তাদের জীবনযাত্রার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক নয়। সরকারী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন উভয়েরই মহিলাদের মধ্যে শিক্ষার স্তর বৃদ্ধির জন্য সংশোধনমূলক পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

৩// কাজের সুযোগ বা উপার্জন করার জন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি দক্ষতারও অভাব মহিলাদের রয়েছে। যৎসামান্য যেসব প্রশিক্ষণ তাদের দেওয়া হয় সেগুলিও পরম্পরাগত নৈপুণ্য, যেমন—দরজির কাজ, এমব্রয়ডারি, ফ্যাশন ডিজাইনিং ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ। সরকারী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির উচিত হবে স্থানীয় শিল্পে চাহিদা আছে এমন নতুন ধরনের কারিগরি শিক্ষার প্রচলন যা মহিলাদের স্বনিযুক্তিমূলক উদ্যোগের জন্য উপযোগী হবে। উপযুক্ত প্রশিক্ষণের দ্বারা এই সমস্ত দক্ষতাপ্রাপ্ত মহিলাদের কর্মক্ষমতাকে পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হবে।

৪// যেহেতু, মহিলাদের বেশীরভাগই ঠিকা কাজ করে তাদের অবসরযোগ্য সময় যাতে উৎপাদনশীল কাজে প্রয়োগ করা যায় সেজন্য নতুন নতুন কার্যক্ষেত্র চিহ্নিত করা প্রয়োজন।

৫// কর্মরতা মহিলাদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রসাধন কক্ষ, বিশ্রাম কক্ষ এবং খাদ্য-পানীয়ের দোকান সুলভ নয়। শিশুরক্ষণী (creche)-র চাহিদাও কাজের জায়গাগুলিতে ক্রমশঃ উধ্বমুখী। এই সমস্ত প্রাথমিক সুযোগ-সুবিধাগুলির উন্নয়নের মাধ্যমে শিল্পক্ষেত্রে মহিলাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা সম্ভব।

৬// সমীক্ষার মধ্যে দেখা গেছে যে, এখন মহিলারা আরও বেশী মাত্রায় জীবনযাত্রা সংক্রান্ত নানা অসুখ, যেমন, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, বাত-বেদনা ইত্যাদিতে আক্রান্ত হচ্ছেন। অসুখগুলি মুখ্যতঃ স্থূলতা ও অতিরিক্ত ওজনের সঙ্গে জড়িত। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, মহিলাদের মধ্যে শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়ামের ঘাটতি রয়েছে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির উচিত এই ক্ষেত্রে কাজ করা এবং মহিলাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যের মান উন্নয়নের রাস্তা বের করা। উপযুক্ত খাদ্যতালিকা—যা সহজ ও সাধারণ মহিলাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে সেগুলি এর আওতায় আসা উচিত।

৭// সমীক্ষার ফলে মনে হয়েছে যে, সরকারী স্বাস্থ্য পরিষেবা পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত অঞ্চলে বেশ ভালো এবং অধিকাংশ মহিলাই এর সুযোগ গ্রহণ করে থাকেন। এই পরিষেবাগুলির মান বজায় রাখা ও স্থানীয় জনগণের চাহিদা অনুসারে মানোন্নয়ন করার দিকেও দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। মাতৃত্বকালীন, প্রাক্ প্রসবকালীন ও প্রসবোত্তরকালীন স্বাস্থ্য পরিষেবা আরও উন্নত করা আবশ্যক।

৮// উত্তরদাতারা যে সমস্ত অসুখ-বিসুখের কথা জানিয়েছেন তার বেশিরভাগই হল জলবাহিত রোগ। বিষয়টি মাথায় রেখে পানীয় জলের সরবরাহ, যা কলের মাধ্যমে হওয়াই বাঞ্ছনীয়, সুনিশ্চিত করা দরকার। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি গৃহে পানীয় জল-সরবরাহের যোজনা এই অঞ্চলগুলিতে বাস্তবায়িত করা উচিত।

৯// স্বচ্ছ ভারত অভিযান ও উজ্জ্বলা যোজনা আরও দুটি কেন্দ্রীয় সরকারী প্রকল্প যা সীমান্ত বরাবর বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন। স্বল্প সংখ্যক বাড়িতেই কেবল শৌচালয় আছে, অন্যত্র মহিলারা উন্মুক্ত স্থানে শৌচকার্য করতে বাধ্য হন। চিরাচরিত উনানের ব্যবহার এখনও বহুল প্রচলিত। এই সমস্যাগুলির অবিলম্বে সমাধান করা উচিত কারণ এগুলি মহিলাদের স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির উচিত সরকারী প্রকল্পগুলির সুষ্ঠু বাস্তবায়ন করা।

১০// নারী সুরক্ষা ও নিরাপত্তা পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী এলাকার একটি মুখ্য উদ্বেগের বিষয়। সীমান্তের অন্য পার থেকে মুহুর্মুহু আক্রমণ হয়। স্থানীয় গুন্ডা ও মুসলমানদের হাতে অমুসলিম মহিলা ও বালিকাদের হয়রানির ঘটনার খবর পাওয়া যায়। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব সীমান্ত এলাকার নারীদের নিরাপত্তা প্রদান করা, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা রক্ষীবাহিনী মোতায়েন করা ও মহিলাদের মধ্যে সচেতনতার প্রচার ও প্রসার করা। এগুলি অবশ্য কর্তব্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.