ত্রিম্বকেশ্বর দক্ষিণমুখী হনুমান মন্দিরের
মোহান্ত কল্পবৃক্ষ গিরি মহারাজ (Mohant Kalpavriksha Giri Maharaj) (৭০)‚ তাঁর সঙ্গী মোহান্ত সুশীল গিরি মহারাজ (Mohant Sushil Giri Maharaj) (৩৫) ও তাদের ড্রাইভার নীলেশ তেলগাডে (Nilesh Telgad) (৩০) কে ১৬ই এপ্রিল‚২০২০ তে নৃশংসভাবে গণপ্রহারে হত্যা করা হয়। এই ঘটনা ঘটেছে মহারাষ্ট্রের পালঘর জেলার গড়চিনচেল গ্রামে। দুই জন সন্ন্যাসীই বারাণসীর শ্রী পঞ্চ দশম আখড়ার সাথে যুক্ত ছিলেন।
এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের ১৭ই এপ্রিল‚ ২০২০ তে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯ শে এপ্রিল সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ঘটনা ভাইরাল হওয়ার পরেই আমরা এই বর্বরতার বিষয়ে জানতে পারি। স্বাভাবিকভাবেই এই কল্পনাতীত ভয়াবহতা আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়ে দিয়ে যায়। তবে সবথেকে অদ্ভুত ছিলো যে‚ তথাকথিত উদারপন্থী-বামপন্থী এবং জেএনইউ গ্যাং যারা কিনা তথাকথিত মানবতার স্বঘোষিত ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর সেজে ঘুরে বেড়ায় তাদের এই বিষয়ে ন্যুনতম কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এই একই ঘটনা যদি কোনো সংখ্যালঘুর সাথে হতো তবে এতক্ষণে দেশ জুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ বেঁধে যেত। কিন্তু হিন্দু সন্ন্যাসীদের এই করুন পরিণতি তাদের ভণ্ড মানবিকতায় কোনো আঘাত করেনা।
আমরা এই ঘৃণ্য অপরাধের প্রতি নিন্দা জানাই। এই দেশে ঘটা একই ধরনের অন্যান্য অপরাধগুলোর মতো এই হত্যাকাণ্ডটিও আমাদের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ।
পালঘর জেলার (Palghar district) এই অঞ্চলগুলিতে প্রধানত কোঙ্কন, ওয়ার্লি এবং ঠাকর উপজাতি সম্প্রদায়ের লোকদের দ্বারা বাস করে।পালঘরের এই দূর-পার্বত্য অঞ্চলে খ্রিস্টান মিশনারিজ এবং সহিংস বামপন্থীরা তাদের প্রভাব বিস্তার করেছে। এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরেই ‘কাশতাকরী’ নামে একটি বাম মনোভাবাপন্ন সংগঠন এবং মিশনারি গীর্জাগুলি নিজেদের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। আমরা সবাই জানি যে মিশনারি অধ্যুষিত উপজাতি অঞ্চলে মগজধোলাইয়ের শিকার ধর্মান্তরিতরা আদমশুমারিতে উপজাতিদের জন্য পৃথক ধর্মীয় আইন আনার জন্য চাপ দিয়ে আসছিলো ।
খুব সম্প্রতি ঝাড়খণ্ডের সশস্ত্র পাথালগাদি আন্দোলনে উপজাতিরাও একইভাবে প্ররোচিত হয়েছিল যে তারা যেন ভূমি আইনকে স্বীকৃতি না দেয়। এই অরণ্যবাসীদের বারবার এটা বলে প্ররোচিত করা হচ্ছে যে তারা হিন্দু নয়। তাদের পরিচয় হিন্দুদের থেকে আলাদা।
ব্রিটিশ শাসকরাও একইভাবে “বিভক্ত করো ও শাসন করো” নীতি অনুসারে ভারতের বিভিন্ন জনজাতির জন্যে পৃথক পৃথক ধর্মীয় আইন আনে। এই পৃথক আইন ব্যবস্থা ১৮৭১ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত চালু ছিলো। স্বাধীনতার পরে ১৯৫১ এর আদমশুমারি থেকে এটা সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু বামপন্থী গোষ্ঠী ও খ্রীস্টান মিশনারিরা উপজাতিদের মধ্যে বিভেদের বীজ বুনতে এর পুনঃপ্রবর্তনের জন্যে ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
অরণ্যবাসী মানুষ ও অন্যান্য নাগরিকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির কোনো সুযোগই তারা ছাড়ছেনা। তারা আদিবাসী বা মূল নিবাসী শব্দগুলো ক্রমাগত ব্যবহার করে যাচ্ছে যাতে যাতে এই জনজাতির মানুষেরা অন্যদের থেকে নিজেদের আলাদা মনে করে। এর ফলে উপজাতি সম্প্রদায়ের কেউ কেউ হিন্দু ধর্মকে শত্রুর চোখে দেখতে শুরু করেছে। হিন্দুদের প্রতি এ জাতীয় শত্রুতা কয়েক বছর ধরে কিছু জনজাতির মধ্যে‚ বিশেষত পালঘরের বাম মনোভাবাপন্ন বা ধর্মান্তরিত উপজাতি ব্যক্তিদের মধ্যে বেড়েই চলেছে।
প্রসঙ্গত খ্রিস্টান মিশনারিদের ক্রিয়াকলাপ সংক্রান্ত নিয়োগী কমিটির রিপোর্টে (১৯৫৬) অনেক আগেই এই জাতীয় পরিণতির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিলো। ফলে ধর্মান্তরকরণের উপর আইনী নিষেধাজ্ঞা আরোপের সুপারিশ করা হয়। কিন্তু কিছু দুর্ভাগ্যজনক কারণে এটি কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।
আমাদের দেশ ও সমাজকে খন্ড বিখন্ড করে দুর্বল করার লক্ষ্যে বহু জাতীয়তাবিরোধী ও অসামাজিক কাজকর্ম চালানো হচ্ছে। কিন্তু সত্যিই কি ভারতীয় সভ্যতায় নাগরিক ও অরণ্যবাসীদের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিলো? ভারতের প্রাচীন মহান সাহিত্যকর্মগুলি‚ যেমন বেদ, পুরাণ, রামায়ণ ও মহাভারতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সহযোগিতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থানের কথা বলা আছে।
আচার্য বিনোবা ভাবে বলতেন যে বেদ হলো আদিবাসী পাঠ্য। হিন্দু ও উপজাতি সম্প্রদায় উভয়ই প্রকৃতি এবং একই দেবদেবীদের উপাসনা করে। ভীল‚ মাদিয়া‚ গোন্ড‚পারধন ইত্যাদি উপজাতিরা মহাদেব শিবের উপাসনা করে। ইউরোপীয়রা উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি যে যে অঞ্চলেই পৌঁছে সেখানকার আদিবাসীদের উপর জাতিগত নির্মূলীকরণ চালিয়েছে। তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। কিন্তু ভারতের এমন কোনো রক্তস্নাত ইতিহাস নেই। আর ‘আর্য আক্রমণের তত্ত্ব’ সৃষ্টির পেছনে আসল উদ্দেশ্য তো এখন ফাঁস হয়েই গেছে। তাহলে কেন এই অযথা জাতিবিদ্বেষ? কেন তা মানুষের হৃদয়কে কলুষিত করছে? আমাদের এই বিষয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
যখন হিন্দু সাধু-সন্ন্যাসী‚ সমাজকর্মী বা এই জাতীয় সংগঠনরা উপজাতির লোকদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ বা আদর্শিক শোষণের বিরোধিতা করে মিশনারি ও বামপন্থীদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়‚ এমনকি তাদের হত্যা পর্যন্ত করা হয়‚ তখন আমাদের আর নির্লিপ্ত থাকা শোভা পায়না। এই হিন্দুফোব গোষ্ঠীই ২০০৮ সালের ২৩ শে আগস্ট, শুক্রবার‚ জন্মাষ্টমীর দিন স্বামী লক্ষ্মানানন্দ সরস্বতীকে হত্যা করে।
বিচ্ছিন্ন উপজাতি জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের চেষ্টা এবং ওড়িশার কন্ধমল জেলায় ধর্মান্তকরণের বিরোধিতা করার জন্য এই মহাত্মাকে তাঁর প্রাণ দিতে হয়েছিল। একইভাবে স্বামী অসীমানন্দকেও মিথ্যে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের অভিযোগে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছিল দেশবিরোধীদের প্রতি তার কার্যকলাপ আটকানোর জন্য।
কিছু নীতিবোধহীন মন্ত্রী ও আমলারা তাদের রাজনৈতিক প্রভুর নির্দেশে স্বামী অসীমানন্দের উপর চরম অত্যাচার চালায়। তাঁর দোষ শুধু এটাই ছিলো যে‚ তিনি গুজরাটের দাংস জেলার আদিবাসীদের সামাজিক ও ধর্মীয় জাগরণের জন্য কাজ করছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টার ফলে সেই আদিবাসীরা নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য-পরিচয় সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে ও মূলস্রোতে ফিরে আসতে শুরু করে। সাঙ্গলি থেকে মুম্বাইতে আসার সময় মহারাষ্ট্রের সাতারা জেলায় সূর্যাচার্য কৃষ্ণদেবানন্দ গিরি মহারাজের উপর আক্রমণটিও আমাদের একই অপরাধমূলক মানসিকতার উদাহরণ দেখায়। সেই আক্রমণকারীরা মহারাজের অযোধ্যা সফরকে বাধা দিতে চেয়েছিল।
মহারাষ্ট্রের পালঘর জেলার কয়েকটি ঘটনার একটি সামান্য ইতিহাসই আমাদের বোঝাতে সক্ষম যে এই ষড়যন্ত্র কতটা ভয়াবহ রূপ নিয়ে ফেলেছে। এখানে দুটি ঘটনা অবশ্যই উল্লেখ করা প্রয়োজন। ১৯৫৬ সালে পালঘর জেলার থেরোন্ডা গ্রামে মুম্বাই ও রায়গড় অঞ্চলের তৎকালীন আরএসএস প্রচারক প্রয়াত দামু আন্না তোকেকারের নেতৃত্বে ‘হিন্দু সেবা সংঘ’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
এই সংস্থাটি তৈরী করার মূল লক্ষ্য ছিলো
জেলার আদিবাসী সম্প্রদায়ের সামাজিক, শিক্ষামূলক এবং অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতা দূরীকরণ। দামু আন্নার জনপ্রিয়তা ও মহৎ চরিত্রের ফলে আদিবাসী সমাজের লোকেরা তাঁর সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করে। ফলে নিজেদের স্বার্থহানি হতে দেখে বাম এবং মিশনারি গুন্ডারা তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৮০ সালের এক রাতে তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়। কিন্তু ভাগ্যক্রমে সেই রাত্রে তিনি অন্যত্র থাকায় বেঁচে যান। তবে তার সংগঠনের হয়ে কাজ করা ওয়ামনরাও সহস্রবুদ্ধে ও তাঁর স্ত্রীকে গুন্ডারা আক্রমণ করে উভয়কেই গুরুতর আহত করে।
এই অশুভ হিংস্র জোটের কার্যকলাপের দ্বিতীয় উদাহরণ দেখা যায় মাধবরাওয়ের ক্ষেত্রে। তারা প্রয়াত মাধবরাও কানেকে হত্যার জন্যে তালশারিতে ‘বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বনবাসী কল্যাণ কেন্দ্র’ আক্রমণ করে। ১৯৬৭ সালে দামু আন্নার পরামর্শে, মাধবরাও কানে মহারাষ্ট্র এবং গুজরাটের সীমান্তে‚ আজকের পালঘর জেলার তালছড়িতে একটি কেন্দ্র চালু করেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে শিক্ষা, পল্লী উন্নয়ন, পরিবেশ সুরক্ষা, বৃক্ষরোপণ ইত্যাদি বিষয়ে নানা কর্মসূচি পালন করা হতো ।
আবারও পূর্বোল্লিখিত উদাহরণের প্রায় পুনরাবৃত্তি ঘটে। সংগঠনটির ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার ফলে বাম-মিশনারি গ্যাং প্রায় ৭০০-৮০০ জনকে নিয়ে কেন্দ্রটিতে আক্রমণ চালায়‚ মাধবরাওকে হত্যার উদ্দেশ্যে। কিন্তু মাধবরাও সেই মূহুর্তে কল্যানে থাকায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান‚ তবে শ্রী মহাদেব যোশি এবং তাঁর স্ত্রী মিসেস বসুধা যোশি এই আক্রমণে গুরুতর আহত হন। আঘাত এতটাই গুরুতর ছিলো যে‚ তাঁদের সুস্থ হয়ে বেঁচে ওঠাটাই ভগবানের আশীর্বাদ বলে হয়।
২০২০ সালের ১৬ই এপ্রিল‚ দুইজন সন্ন্যাসী ও তাদের ড্রাইভারের উপর আক্রমণও এই বিকৃত মানসিকতার প্রতিচ্ছবি মাত্র। কল্পবৃক্ষ গিরি মহারাজ‚ সুশীল গিরি মহারাজ ও তাদের ড্রাইভার নীলেশ তেলগাড়ে সিলভাসা যাচ্ছিলেন একজন সন্ন্যাসীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে। কিছু উৎস থেকে জানা গেছে‚
তারা পথ হারিয়ে কাসা থানার নিয়ন্ত্রণে থাকা গড়চিনচালে গ্রামের ভেতর ঢুকে পড়ে।
আর গ্রামের একদল হিংস্র জনতা তাদের গাড়ি থামিয়ে মারধর করতে শুরু করে দেয়।
তবে কাছাকাছি থাকা বনরক্ষীরা তাদের উদ্ধার করে‚ আশ্রয় দিয়ে পুলিশকে ডেকে পাঠায়। কাসা থানাটি সেখান থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। থানা থেকে পুলিশের ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে কমপক্ষে আধ ঘন্টা সময় লাগে। এর মধ্যেই জনতা চাইলে তাদের হত্যা করে ফেলতে পারতো। তবে তারা তা করল না কেন?
ভাইরাল হওয়া ভিডিওগুলিতে স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যে বৃদ্ধ সন্ন্যাসীটি পুলিশের হাত ধরে আছে এই সরল বিশ্বাসে তারা তাকে রক্ষা করবে। কেন পুলিশটি তাকে হিংস্র জনতার মধ্যে এভাবে ঠেলে দিলো? সন্ন্যাসীদের হত্যা করার জন্য তাদের কি কোনো সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ছিলো? তাদের গেরুয়া পোশাক দেখে কেউ কি তাদের হত্যা করার জন্য জনতাকে উস্কে দিয়েছিলো? পুলিশ কেন তাদের বাঁচানোর জন্য শূন্যে বা ঘাতকদের পায়ে গুলি চালিয়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করেনি? লকডাউন কার্যকর থাকা অবস্থাতেও এতগুলো মানুষ কিভাবে একজায়গায় জড়ো হতে পারে? ঘটনা সংক্রান্ত প্রশ্ন কিন্তু কম নয়।
হত্যার পরেও সন্ন্যাসীদের প্রাপ্য কোনো সম্মান দেখানো হয়নি। তাদের মৃতদেহগুলি পোস্টমর্টেমের জন্য একটি নোংরা ধুলামাখা টেম্পোতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। এই হৃদয়বিদারক ঘটনাটি দেখে স্বাভাবিকভাবেই এই জাতীয় অনেক প্রশ্ন ও সন্দেহ জাগে।
তাই হিন্দুরা ক্ষোভ ফেটে পড়ার আগেই উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি তদন্ত করে এই ঘটনাটি খুটিয়ে দেখা সরকারের জন্য বুদ্ধিমান কাজ হবে। আর যারা যারা মানবতার বিরুদ্ধে এই ন্যাক্কারজনক অপরাধের সাথে যুক্ত‚ তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই দ্রুততম ও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
লেখক- বিবেকানন্দ নর্তম (Vivekananda Nartam) , লেখক দিল্লির শায়ম লাল কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন সহকারী অধ্যাপক