পোর্ট ব্লেয়ার, যেখানে অবস্থান বৃহৎ এক কারাগার যার নাম সেলুলার জেল। এ কারাগারের নাম সেলুলার এ কারণে যে, এর সাতটি উইং ছিল, যা মাঝখানে একটি সুউচ্চ পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তিন তলাবিশিষ্ট উইংগুলো এমনভাবে তৈরি ছিল যে এর সামনে-পেছনে আরেক উইং থেকে দেখা যেত না। কাজেই এক উইংয়ের বন্দিরা অন্য উইং সম্পর্কে কোনো ধারণাই পেত না।
এ কারাগারে সর্বমোট ৬ হাজারের উপরে কারাকক্ষ ছিল। এখন মাত্র তিনটি উইং আর পর্যবেক্ষণ টাওয়ারটি সংরক্ষিত রয়েছে। পোর্ট ব্লেয়ারের অবশ্যদর্শনীয় স্থান এ সেলুলার জেল। আগেই বলেছি, এর সঙ্গে জড়িত ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন।
সেলুলার জেলে বিপ্লবীদের শুধু বন্দি করেই রাখা হয়নি, প্রায় ৯০ জনকে ফাঁসিও দেওয়া হয়েছিল। ফাঁসির জায়গাটিও সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। গভীর রাতে পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে বিপ্লবী বন্দিদের চোখের সামনেই ফাঁসি দেওয়া হতো, হয়তো তাদের মধ্য থেকেই কোনো একজনকে।

আন্দামানে প্রথমদিকে কোনো নির্দিষ্ট কারাগার ছিল না। সমগ্র দ্বীপটিই ছিল কারাগার। অষ্টাদশ শতাব্দীতে লেফটেন্যান্ট ব্লেয়ার এ জায়গায় প্রথম স্থাপনা গড়ে তোলেন। পরে আন্দামানকে খোলা জেলে রূপান্তরিত করা হয় ১৮৫৭ সালের ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ বা প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের ব্যর্থ চেষ্টার পরের বছর, ১৮৫৮ সাল থেকে।
যদিও ১৭৮৯ সালে তৎকালীন বেঙ্গল সরকার সমগ্র দ্বীপাঞ্চলকে কারাগার হিসেবে ঘোষণা দিয়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তদের দ্বীপান্তর করে কালাপানিতে পাঠাত। আদতে আন্দামানের চারদিকে জলরাশি কোনোভাবেই কালো রঙের নয়, বরং অদ্ভুত সুন্দর নয়ন জুড়ানো নীল স্বচ্ছ জল।
কালাপানি হিন্দু ধর্মমতে ধর্মচ্যুত হওয়ার ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। হিন্দুদের কালাপানি পার হওয়া ছিল ধর্মবহির্ভূত কাজ। এ কারণেই তৎকালীন ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির হিন্দুসেনাদের অন্যতম শর্ত ছিল সমুদ্র পার না হওয়া। পরে অবশ্য এ মতবাদ টেকেনি। সেই সময় থেকে কালাপানি মানে গভীর সমুদ্র আর আন্দামান যেহেতু বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, চারদিকে সমুদ্র, তাই এ নামে পরিচিত হয়েছিল। এখনও কালাপানি আর আন্দামান একাকার হয়ে আছে।
প্রথম জেল তৈরি হয় ভাইপার দ্বীপে। তবে আন্দামান উন্মুক্ত ছিল জাতীয়তাবাদী কয়েদিদের জন্য।

আন্দামানের পোর্ট ব্লেয়ারের কারাগার তৈরির পরিকল্পনা বহু আগের হলেও ১৮৫৭ সালের সিপাহী যুদ্ধের কারণে সময়মতো নির্মাণকাজ শুরু করা যায়নি। তবে সেলুলার কারাগার তৈরি ত্বরান্বিত হয় ১৮৭২ সালের ফেব্য়রির ৮ তারিখে।
সেলুলার জেল তৈরির কাজ শেষ হয় ১৯০৬ সালে। তারপর থেকেই সেখানে যাবজ্জীবনের জন্য দেশান্তরী করা হতে থাকে বিপ্লবীদের। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন বাংলার বিপ্লবী। বাঘা যতিনের সমর্থক থেকে শুরু করে ‘যুগান্তর’ ও ‘অনুশীলন সমিতি’র শত শত সদস্যকে বন্দি রাখা হয়। এর মধ্যে অনেকের মৃত্যু, ফাঁসি হয় পোর্ট ব্লেয়ারের সেলুলার জেলে। আরও পরে পাঞ্জাবের ভগৎ সিং ও তাঁর বহু সহযাত্রীকে আন্দামানে অন্তরীণ রাখা হয়, যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন বটুকেশ্বর দত্ত। অনেকে অনশন ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে জীবন দান করেন উপমহাদেশের স্বাধীনতার জন্য।
সেলুলার জেলের অন্যতম বিখ্যাত বাসিন্দা ছিলেন ভারতে হিন্দুত্ববাদের প্রবক্তা বিনায়ক দামোদর সাভারকার, যার নামে পোর্ট ব্লেয়ারের বিমানবন্দরের নাম বীর সাভারকার ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। হিন্দু ঐক্য দৃষ্টিভঙ্গির কারণে কংগ্রেসের নেতাদের সঙ্গে কখনোই তার বনিবনা হয়নি।

ভারতে ইতিহাসে সাভারকার কে দীর্ঘতম কঠোর জেলখানায় (৫০ বছর) দণ্ডিত করা হয়েছিল এবং ব্রিটিশ হোম বিভাগের ‘ডি (বিপজ্জনক) কারাগারে’ শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছিল ভিডি সাভারকারকে।
সেলুলার জেলখানায় নির্দোষ বন্দিদের মধ্যে সবচেয়ে তারঁ ওপর সবচেয়ে অধিক অমানবিক নির্যাতন হয়, দাঁত হ্যান্ডক্যাফ, শিকল গেজ, ক্রস-বার শাখা, তেজস্ক্রিয়তা ইত্যাদি ছাড়াও তেল-মিলিংয়ের মতো অত্যাচার তিনি পেয়েছিলেন ও সহ্য করেছিলেন।
সশস্ত্র প্রহরী পরিবেষ্টিত হয়ে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে ৪ ঠা জুলাই বীর সাভারকার আন্দামানে উপনীত হলেন। ১৮৫৭ সালে সিপাহী যুদ্ধের পর থেকে ভারতে মুক্তিকামী বীর যোদ্ধাদের উক্ত দ্বীপে অভ্যন্তরীণ রাখা হতো । দুশ্চর তপস্যারত দেশপ্রাণ বীর পুরুষদের স্মৃতিবিজড়িত ভূখণ্ডে পদার্পণ করে বীর সাভারকার নীরবে স্বদেশ ভক্ত বীরপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন ।
বিখ্যাত সেলুলার বন্দি নিবাসে তিনি নির্দিষ্ট কক্ষে প্রবেশ করছেন , এমন সময় উপস্থিত হলেন মিস্টার বেরি । তিনি উপস্থিত হয়ে অত্যন্ত রুক্ষ স্বরে বীর সাভারকার কে প্রশ্ন করলেন “
আপনিই মার্সেলিস থেকে পলায়নের চেষ্টা করেছিলেন?’
তা শুনে বীর সাভারকার গম্ভীরভাবে উত্তর করলেন, ” সে চেষ্টা করেছিলাম বৈকি । কিন্তু তাতে আপনার কি প্রয়োজন ? “

নবাগতের সঙ্গী অপরাপর বন্দীদের যে স্বাতন্ত্র আছে প্রথম আলাপেই মিস্টার বেরি তা উপলব্ধি করলেন।
পরের দিন সকালে কয়েকজন ইউরোপীয় ভদ্রলোক বীর সভারকারকে দেখাবার জন্য মিস্টার বেরির সঙ্গে কারা কক্ষে উপস্থিত হলেন। মিস্টার বেরি সাভারকার কে লক্ষ্য করে বললেন , “ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস আপনিতো সংকলন করেছেন এবং সিপাহিদের শহীদ বলে বর্ণনা করেছেন ।”
বীর সাভারকার বললেন , “এ বিষয়ে আমি অনেক বই পড়েছি।”
মিস্টার বেরি প্রশ্ন করলেন , “তা হলে এসব লুণ্ঠনকারী দস্যুদের স্বদেশ ভক্ত বীর পুরুষ বলে বর্ণনা করলেন কেন ? সিপাহী বিদ্রোহের সময় আমার বাবা ওইসব উশৃংখল জনতার হাতে ধরা পড়েছিলেন । আমি তার কাছে শুনেছি যে , ,নরপিচাশ নানাসাহেব এমনকি সম্ভ্রান্ত বংশের ইংরেজ মহিলাদের উৎপীড়ন করেছিলেন .”
সাভারকর তৎক্ষণাৎ উত্তর করলেন ,”আপনার বাবা মিথ্যাবাদী । তিনি কি নিজে তা দেখেছেন?”
হতমভব মিস্টার বেরি বললেন, ” যিনি প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি তাঁর নিকট শুনেছেন ।”
বীর সাভারকার বললেন, ” লখনৌতে ইংরেজ নর-নারী যখন বন্দী হয়েছিলেন তখন নানাসাহেব যে কানপুরে ছিলেন এটি ঐতিহাসিক সত্য ।”

সমাগত জনৈক ইংরাজ ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন , ” আপনি এইসব রাজদ্রোহীদের কে ঘৃণা করেন না ?”
বীর সাভারকার গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন , “আমি আমার জাতীয় নেতাদের অপমান সহ্য করতে পারব না। আপনারা আত্ম মর্যাদা রক্ষা করে কথা বলবেন । “
তাদের হতভম্ব ও নির্বাক দেখে বীর সাভারকর পুনরায় বললেন, ” নানাসাহেব, তাতিয়া তোপি ,প্রমূখ সংগ্রামী নায়কদের স্বার্থান্বেষী, নরহত্যা কারী কেন বলছেন ? তার প্রমাণ দেখাতে পারবেন? নানাসাহেব রাজদন্ড গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন আর তাতিয়া টোপি সুখ্যাতি চেয়েছিলেন, আপনারা এটি বড় অপরাধ বলে মনে করেন । কিন্তু আপনারা কি জানেন না, ভিক্টটর ইমান রাজ্য শাসন করতে চেয়েছিলেন, ওয়াশিংটন ও নেতৃত্বের জন্য ,নাম যশ এর জন্য লালায়িত ছিলেন। যদি তারা কেবল তাদের মহানুভবতার জন্য আপনাদের স্মরণীয় ও বরণীয় হতে পারেন, তাহলে নানাসাহেব তাতিয়া তোপি কি অপরাধ করেছেন?”
মিস্টার বেরি আর বাক্যালাপ না করে সঙ্গীগণ কে সাথে নিয়ে চলে গেলেন।
সেলুলার জেল দেখতে বিশাল। কিন্তু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কক্ষে বিভক্ত ছিল ।মাঝখানে দাঁড়িয়ে চারদিকে দেওয়া স্পর্শ করা যায় । অন্ধকার ময় এই রূপ ক্ষুদ্র কক্ষেই বন্দি দের বাস করতে হতো । তার উপর আন্দামানের আবহাওয়া অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর এবং নিরানন্দময় ছিল। বছরে বাতাসে তিন মাস অত্যন্ত উত্তাপ থাকে এবং বৃষ্টি এত অধিক হয় যে কখনো কখনো কয়েক সপ্তাহ সূর্যালোক দৃষ্টিগোচর হয় না। এর নৈসর্গিক পরিস্থিতি এবং কারাগারের অন্ধ আবেষ্টনী সাভারকারের মনে কোনো প্রভাববিস্তার করতে পারল না ।
কারণ তার দেহ ক্ষুদ্র কক্ষে আবদ্ধ থাকলেও তার কবি মন অন্তশূন্যে, দিগন্তে, সাগর সৈকতে, কুসুম কাননে আনন্দে ঘুরে বেড়াতো । সেই আনন্দ লহরী সুললিত হয়ে ছন্দে উদগত হয়ে উঠত ।
কিন্তু তার ব্যক্ত করার বা লিপিবদ্ধ করার কোন উপায় ছিল না। আলোকের কোন ব্যবস্থা ছিল না এবং কাগজ-কলম বন্দির পক্ষে স্বপ্নরাজ্যের সামগ্রী ছিল।

সুতরাং কাগজ-কলম অভাবে দেওয়ালেই অঙ্গার ইটের টুকরো বা নখের সাহায্যে লিখে ও মুখস্ত করে রাখতেন। এজন্য তাকে দীর্ঘকাল কোনো কারা কক্ষে রাখা হত না। ঘন ঘন কারা পরিবর্তন করা হত।
এই কক্ষ পরিবর্তন করা তার লেখবার স্থানাভাবই পূরণ করত। তিনি এই সব কবিতা মুখস্থ করে রাখতেন। কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে আসবার সময় প্রায় দশ সহস্র কবিতা তিনি কন্ঠে বহন করে আনেন। স্মৃতিশক্তি প্রাচীন বৈদিক মুনি ঋষিদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
আন্দামানের সেলুলার জেল বা কারাগারের সঙ্গে এই ভূখণ্ডে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সমাপ্তি এবং স্বাধীনতার ইতিহাসের এক বিরাট অংশ জড়িত। সে কারণেই বর্তমানে এ কারাগার অন্যতম দর্শনীয় স্থান। আন্দামানের পর্যটনের অন্যতম বা কেন্দ্রীয় আকর্ষণ সেলুলার জেল।
স্বাধীনতা অর্জন অত্যন্ত কঠিন; কিন্তু হারানো মোটেও কঠিন নয়। প্রশ্ন জাগে, যাদের আত্মত্যাগে আমরা স্বাধীন হয়েছি, আমরা কি তাদের ত্যাগের মর্যাদা দিতে পেরেছি?
দূর্গেশ নন্দিনী শ্রীতমা
তথ্যঃ
Kumar, Megha (Nov–Dec 2006). “History and Gender in Savarkar’s Nationalist Writings