বাসুদেব বলবন্ত ফাড়কে জন্মেছিলেন চিৎপাবন ব্রাহ্মণ বংশে। রামোসী এবং অন্যান্য বনবাসী জাতিদের একত্র করে তিনি যুদ্ধ ঘোষনা করেন ইংরেজ রাজশক্তির বিরূদ্ধে। ১৮৭১ সালে তাঁর আক্রমনে ইংরেজ রাজশক্তি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ২০এ জুলাই ১৮৭৯ বিজাপুরের দেভার নাভাডগিতে ধরা পড়েন। নভেম্বরের ৭ তারিখে তাঁর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আদেশ হয়। ১৮ই এপ্রিল তাঁর আপীল নাকচ হয় এবং তেহেরান জাহাজ সাহায্যে তাঁকে এডেন দূর্গে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ১২ তারিখে তিনি কারাগার থেকে পলায়ন করেন এবং দশ ঘন্টার মধ্যে ধরা পরেন। কারাগারেই তাঁর মৃত্যু হয়।

এরপর দশ বছর মহারাষ্ট্রের বিপ্লব প্রচেষ্টায় ভাঁটার যুগ। ক্রমশঃ আত্মপ্রকাশ লোকমান্য তিলকের।

১৮৯৩ সালে বোম্বাই প্রদেশে ঘটে উৎকট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সংখ্যাগুরু হওয়া সত্বেও মুসলমানদের হাতে হিন্দুদের যথেষ্ট নিগ্রহ সহ্য করতে হয়। শুরু হয় আত্মানুসন্ধান। দেখা যায়, অন্য সব শক্তি থাকা সত্বেও সন্মিলিতভাবে বিপক্ষের সঙ্গে শক্তি-পরীক্ষায় পরাণ্মূখতার এক অতিশয় দূর্বলতা।
মুসলমানদের মহরম আছে। ঈদ আছে। কিন্তু হিন্দুদের আছে তেত্রিশ কোটি দেব-দেবী। তাদের নিজেদের মধ্যে বিভেদের অন্ত নেই। এর ভেতর সংঘর্ষের চিন্তা নেই। এই অবস্থার প্রতিকারের জন্য একটা সর্বসাধারণের পূজার কথা মাথা চাড়া দিল। সর্বসিদ্ধিদাতা গণেশ পূজা অনাড়ম্বরভাবে মহারাষ্ট্রে প্রচলিত ছিল। দাঙ্গার পরবৎসর ,১৮৯৪ সাল পূজার কর্মসূচী বেশ পাকা হয়ে উঠল। ১৮৯৫ সাল নাগাদ এটা বেশ প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। গণপতিকে মহারাষ্ট্রীরা গজাসুর বিজয়ী মনে করে। বাঙলাদেশে পৌরাণিক স্বয়ং মহেশ্বর, গজাসুর নিহন্তা । তিলক ও শিবরাম পরঞ্জপের উদ্দীপনায় সকলকে এক করে সর্ব্বজনীন উৎসবে পরিণত করা হয় গণেশ-পূজা।

মহারাষ্ট্রের মনে শিবাজি চিত্র তখন জাজ্বল্যমান মহারাজ দেহত্যাগ করেন ১৬৮০ সালের ১৪ই এপ্রিলতিলক রায়গড় দূর্গ সংস্কার কেন্দ্র করে শিবাজি উৎসব প্রচলন করেন। তিলক বললেন রায়গড় দূর্গ ছাড়া মহারাষ্ট্রে আর কোন স্থান এই উদ্দেশ্যের পক্ষে বেশী উপযোগী বলে বিবেচিত হতে পারে না।

এর পরের বক্তৃতায় তিলক স্পষ্টভাবেই বলে দিলেন আফজল হত্যায় শিবাজি (Shivaji) কোনও পাপ করেননি,ন্যায্য পথই তিনি গ্রহন করেছিলেন। তিনি বললেন ঘরে যদি দস্যু ঢোকে এবং তাকে অন্য উপায়ে জব্দ করার বিশেষ অসুবিধা থাকে, তখন তাকে পুড়িয়ে মারাই যুক্তিযুক্ত ।

শিবাজি উৎসবই কুরুক্ষেত্র-সমরের মহাশঙ্খ ধ্বনি। বাঙ্গলায় ঘাঁটি তৈরি হয়েছিলো অরবিন্দ, যতীন্দ্রনাথ, পি মিত্র, ওকাকুরা ও সরলাদেবীর যুক্তপ্রচেষ্টায়। ১৯০২ সালে শিবাজি (Shivaji) ঊৎসব বাঙ্গালীর কানে ঝংঙ্কার দিলো নতুন উদ্যমের

রবীন্দ্রনাথ লিখলেনঃ

সেদিন এ বঙ্গদেশ উচ্চকিত জাগেনি স্বপনে,
পায়নি সংবাদ-
বাহিরে আসেনি ছুটে, উঠে নাই তাহার প্রাঙ্গনে
শুভ শঙ্খনাদ
-“

মহারাষ্ট্রের সঙ্গে যে প্রারম্ভিক পরিচয় সেটা হয়েছিল বিদেশীর ইতিবৃত্ত সাহায্যে । তারা তোমাকে ”দস্যু বলি করি অট্টহাস্যরবে“ সুতরাং “তব পুণ্যচেষ্টা যত তস্করের নিস্ফল প্রয়াস এই জানে সবে”!!

কবি আরও বলেন-

তোমার কৃপানদীপ্তি একদিন যবে চমকিলা
বঙ্গের আকাশে
সে ঘোর দুর্যোগদিনে না বুঝিনু রুদ্রলীলা-
লুকানু তরাসে
। “

বাঙ্গলায় ১৯০২ সালে অনুষ্ঠিত শিবাজি উৎসব সাধারনের দৃষ্টি বিশেষ ভাবে আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়। এটুকু জানা যায় ১৮৯৬ নভেম্বর ২২-এ হীরেন্দ্রনাথকে সভাপতি করে কলকাতায় শিবাজি উৎসব পালন করার আলোচনা হয়েছিল। বিপিন চন্দ্র পাল ১৯০২ সালে শিবাজি উৎসব উপলক্ষে যে বক্তৃতা রাখেন, তাতে উল্লেখ করেন যে মহারাষ্ট্র -শক্তি-জোট সমস্ত হিন্দুর অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক সম্ভাব্য অভ্যুত্থানের সূচনা করছে। এই প্রসঙ্গে বেঙ্গলী পত্রিকার সম্পাদকীয় উল্লেখ্য-

ভারতে শিবাজি উৎসব সকল জাতি ও শ্রেনীর যে একতার সুর বাঁধতে সচেষ্ট, সেটাই ইংরেজ জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ সৃতিস্তম্ভ বলে মনে করা যেতে পারে। “

১৯০৪ সালে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন শিবাজি উৎসব। ১৩১১ সালে যুগপৎ বঙ্গদর্শন ও ভারতী-তে প্রকাশিত হয়।

সকল লজ্জা -সঙ্কোচ, সকল ক্ষোভ-শঙ্কা পরিহার করে বাঙ্গালী আজ এগিয়ে আসছে শিবাজি ঊৎসব পালন করতে। তাই

মারাঠির সাথে আজি, এ বাঙালী, এক কন্ঠে বলো
জয়তু শিবাজি
মারাঠির সাথে আজি, হে বাঙ্গালী ,এক সঙ্গে চলো
মহোৎসব সাজি।
আজি এক সভাতলে ভারতের পশ্চিম -পূরব
দক্ষিণে ও বামে,
একত্রে করুক ভোগ একসাথে একটি গৌরব
এক পুন্য নামে
।“

১৯০৬ জুন ৪ঠা থেকে ১২ই, ফিল্ড এন্ড এ্যাকাডেমী মাঠে শিবাজির আরাধ্য দেবী ভবানীর বিরাট মূর্তি ধুমধামের সঙ্গে পূজা করা হয়। ৫ই জুন ময়দানে এক বিরাট সভায় তিলক উপস্থিত হয়ে বক্তৃতা দেন। ৭ই জুন সুরেন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে মহারাষ্ট্রিয় নেতৃত্বকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করা হয়।

১৬ই অক্টোবর বঙ্গ-বিভাগ কার্য্যে পরিণত করা হলে, বাঙ্গলায় অশান্তির আগুন জ্বলে উঠলো। তখন উগ্র কর্মপন্থা আবিস্কার ও তার প্রয়োগের জন্যে বাঙ্গালী যুবকেরা মেতে উঠলো। শিবাজি-উৎসব তার উদ্দেশ্য সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেছে। সভা-সমিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহন করে ঘরে ফিরে গিয়ে নিচেষ্ট বসে থাকার দিন অপগত, সুতরাং দ্বন্দের উপযুক্ত ক্ষেত্র বুঝে ইংরেজের সঙ্গে সংগ্রামের জন্য তারা প্রস্তুত হয়ে উঠল

সৈকত বসু (Soikot Basu)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.