ভারতবর্ষের পরাধীনতা সুদীর্ঘ কালের। এদেশে মুসলমান শাসনের গোড়াপত্তন হয় ৭১২ খ্রীষ্টাব্দে সিন্ধুদেশে আরবদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর। মহম্মদ-বিন-কাশিমের হাতে পরাস্ত হন সিন্ধুরাজ দাহির। তবে আরবশাসন তখন সিন্ধু ও মূলতানের বাইরে ভারতবর্ষের অন্য কোথাও প্রতিষ্ঠিত হয় নি। তার পর, ৯৮৬ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ভারতের বুকে অনবরত শুরু হয় তুর্কী আক্রমণ। প্রথমে গজনীর শাসক সবুক্তিগীন, তার পর মামুদ, তার পর মহম্মদ ঘোরী। একা মামুদই ভারতবর্ষ আক্রমণ করেছিল ২১ বার। এই তুর্কীরা বারংবার ভারত আক্রমণ করেছিল মূলতঃ ভারতবর্ষের বিপুল সম্পদের লোভে এবং সেই সঙ্গে চালিয়েছিল ধ্বংসলীলা। মামুদের পর ভারতবর্ষ আবার আক্রান্ত ও লুণ্ঠিত হয় মহম্মদ ঘোরীর দ্বারা। কিন্তু এরা কেউই ভারতে স্থায়ী সাম্রাজ্য স্থাপন করে নি। ভারতে প্রথম স্থায়ী সাম্রাজ্য স্থাপন করে ১২০৬ খ্রীষ্টাব্দে কুতুবুদ্দিন আইবক। সেই থেকে ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহ পর্যন্ত ভারতের বুকে অফিসিয়ালি চলেছিল মুসলমান শাসন। কিন্তু মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় থেকেই অভ্যুত্থান হয় মারাঠাশক্তির এবং বৃটিশদের ভারতে আসার পূর্বেই মুঘলদের হাত থেকে গোটা ভারতের এক বিরাট অংশ উদ্ধার করে ফেলেছিল মারাঠারা। যদিও এই মর্মে একটি জোরালো প্রচার আছে যে মুসলমান শাসক পরাজিত হয়েছিল বৃটিশের হাতে, হিন্দু রাজাদের কেউই তাদেরকে হারাতে পারে নি। কিন্তু বাস্তব সত্য তেমন নয়। ভারতবর্ষের বর্তমান ইসলামপন্থী লবির অনেকেরই বক্তব্য বা অব্যক্ত অনুভূতি হল এই যে বৃটিশ শাসক ভারতবর্ষ দখল করেছিল মুসলমান শাসককে পরাজিত করে। অতএব বৃটিশ ভারত ছাড়বার পর গোটা ভারতের পূর্ণ অধিকার মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণেই ফিরে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এ প্রচার ঐতিহাসিক সত্যঋদ্ধ নয়। বাস্তবে মুসলমানের হাত থেকে ভারতের শাসনভার ছিনিয়ে নেওয়ার কার্য অনেকদূর পর্যন্ত সাধিত হয়ে গিয়েছিল বৃটিশের আগমনের পূর্বেই। মারাঠাদের বীর্যবিক্রমে। মোগল বাদশাহ্ আওরঙ্গজেব ঠেকাতে পারেন নি মারাঠাশক্তিকে। হিন্দু সাম্রাজ্য পুনর্স্থাপিত হয়েছিল ভারতবর্ষের এক সুবৃহৎ অংশে এবং হিন্দু ঐক্যবোধের জন্ম দিয়ে এই প্রক্রিয়ার গোড়াপত্তন করেছিলেন ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ। সেই ঐক্যস্থাপনের প্রক্রিয়াটি, যা শুরু হয়েছিল শিবাজীর হাতে, তা আজও রয়েছে অসম্পূর্ণ। গতকাল, তাঁর জন্মদিবস তাই যথার্থই হিন্দু সাম্রাজ্য দিবস হিসেবে উদযাপিত হওয়ারই উপযুক্ত। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় শিবাজীর সেই স্পিরিট ও নবভারতগঠনে তাঁর পরাক্রমের তাৎপর্য সম্যক তুলে ধরেছেন। “শিবাজী উৎসব” কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—
“তার পরে একদিন মারাঠার প্রান্তর হতে
তব বজ্রশিখা
আঁকি দিল দিগ্ দিগন্তে যুগান্তের বিদ্যুদ্ বহ্নিতে
মহামন্ত্রলিখা।
মোগল-উষ্ণীষশীর্ষ প্রস্ফুরিল প্রলয়প্রদোষে
পক্কপত্র যথা—
সেদিনও শোনে নি বঙ্গ মারাঠার সে বজ্রনির্ঘোষে
কী ছিল বারতা।।”
অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করেছেন যে শিবাজীর সেই ব্রত, তাঁর প্রকৃত উদ্দেশ্য সেই সময়ে অনুধাবন করতে পারে নি বঙ্গভূমি। তারপরের এক স্তবকে কবি লিখলেন—
“হে রাজতপস্বী বীর, তোমার সে উদার ভাবনা
বিধির ভাণ্ডারে
সঞ্চিত হইয়া গেছে, কাল কভু তার এক কণা
পারে হরিবারে?
তোমার সে প্রাণোৎসর্গ, স্বদেশলক্ষ্মীর পূজাঘরে
সে সত্যসাধন,
কে জানিত, হয়ে গেছে চির যুগযুগান্তর-তরে
ভারতের ধন”।।
শিবাজীর (Shivaji) সে সত্যব্রত প্রকৃতই অক্ষয় হয়েছে এদেশে। গুরু রামদাসের দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে সন্ন্যাসীর গৈরিক উত্তরীয়ধ্বজার সমুখে শপথ করে প্রজাপালনের ব্রত উদযাপন—এ-ই ছিল শিবাজীর অখণ্ড হিন্দুত্বের পথ ও আদর্শ। হিন্দু রাজা তিনিই যিনি প্রজারঞ্জন করেন, ভোগবাদী জীবনদর্শন তাঁর নয়। রাজ্যশাসন তাঁর কর্মমাত্র, তদধিক কিছু নয়।
“পালিবে যে রাজধর্ম,
জেনো তাহা মোর কর্ম,
রাজ্য লয়ে রবে রাজ্যহীন“(কবিতা: প্রতিনিধি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)—গুরু রামদাসের এমত বাণীকে পাথেয় করে অখণ্ড ভারতগঠনের সে আরব্ধ কার্য, যা শুরু হয়েছিল শিবাজীর হাতে, যে কার্য বহুদূর অগ্রসর হয়েছিল উত্থিত মারাঠাশক্তির পরাক্রমে, সেই কার্য সম্পন্ন করতে হবে আমাদের সকলকে। গতকাল, শিবাজী দিবস তথা হিন্দু সাম্রাজ্য দিবসে এমন শপথই গৃহীত হয়েছে প্রতি ভারতীয়ের ঘরে ঘরে।
ছত্রপতি শিবাজি (Chhatrapati Shivaji) মহারাজের আরব্ধ কাজ সুসম্পন্ন করতে হলে তাঁর সার্বিক হিন্দু ঐক্যের ভাবধারাটিকে হৃদয়ঙ্গম করা প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, শিবাজীকে বুঝতে পারে নি তাঁর সমসাময়িক কাল। অথচ তাঁর প্রকৃত আদর্শটি উপলব্ধি না করে সে আরব্ধ কার্য সম্পাদন অসম্ভব।
“কোন্ দূর শতাব্দের কোন-এক অখ্যাত দিবসে
নাহি জানি আজি
মারাঠার কোন্ শৈলে অরণ্যের অন্ধকারে বসে,
হে রাজা শিবাজী,
তব ভাল উদ্ভাসিয়া এ ভাবনা তড়িৎপ্রভাবৎ
এসেছিল নামি—
‘একধর্মরাজ্যপাশে খণ্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারত
বেঁধে দিব আমি’।“—
রবীন্দ্রনাথের বর্ণনায় এই অখণ্ড হিন্দু সাম্রাজ্য গঠনই ছিল তাঁর আদর্শ ও উদ্দেশ্য।
শিবাজীর সে আরব্ধ কার্য সম্পাদন করতে হলে জাতি, পেশা, ভাষা, বর্ণ, আরাধ্য ও ভৌগোলিক অবস্থান নিরপেক্ষভাবে সমগ্র হিন্দুসমাজের এক ছত্রতলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার অবশ্য প্রয়োজনীয় কর্তব্যকে অন্তরের অন্তঃস্থলে ধারণ করতে হবে। অষ্টাদশ শতাব্দীর বিভেদদীর্ণ অন্ধকারময় হিন্দুত্বের প্রেক্ষাপটে শিবাজি মহারাজের এই আদর্শ, শুধু বঙ্গদেশ নয়, তাঁর নিজস্ব অনুগামীদের পরবর্তী প্রজন্মও অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, আর সেই কারণেই ছত্রপতির আরব্ধ কাজ তাঁরা সেইসময় সম্পন্ন করতে পারেন নি। উল্টে, মুঘলদের আগ্রাসী ইসলামিক সাম্রাজ্যবাদের প্রতিস্পর্ধা হিসেবে পাল্টা আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তাঁরা হিন্দুত্বের অন্তর্লীন সর্বজনীনতা ও inclusiveness বা সর্বসমন্বয়তাকে অগ্রাহ্য করে, সম্ভবত অনিচ্ছাকৃতভাবেই অন্যান্য বৈদেশিক শক্তি, যেমন আগ্রাসী খৃষ্টান সাম্রাজ্যবাদের বিভিন্ন ধারার ভারতভূমিতে প্রবেশের পথ সুগম করে তুলেছিলেন। ফলতঃ, ত্যাগধর্মী, সর্বজনীন সনাতন হিন্দুত্বের আদর্শদীপ্ত সাম্রাজ্য গঠনের কাজ সেই যুগে অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছিল আর আজও অসম্পূর্ণই থেকে গেছে।
বর্তমান একবিংশ শতাব্দীতে, যখন সনাতন হিন্দুত্ব তার কালিমাময়, ঐসলামিক প্রভাবযুক্ত মধ্যযুগ অতিক্রম করে ধীর-নিশ্চিত পদক্ষেপে ক্রমশঃ তার সুপ্রাচীন গৌরবময় অতীত রূপকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে, তখন আবার একবার ত্যাগধর্মী, অনাগ্রাসী, সর্বজনকল্যানকামী অখণ্ড হিন্দু সাম্রাজ্য স্থাপনের নতুন সম্ভাবনা জেগে উঠছে। ক্ষেত্র প্রস্তুত। তবে তার জন্য আগে আমাদের জাতি, বর্ণ, ভাষা, ভৌগলিকতা, এমনকি উপাস্যধর্মের-ও ঊর্ধে উঠে, বল ও বুদ্ধিকে কেন্দ্রীভূত করে, অজস্র বিরূদ্ধ শক্তির ছল ও ক্রূর চক্রান্তকে প্রতিহত করার স্থিরসঙ্কল্প নিয়ে ভারতমন্ত্রে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমরা পারব, পারবই, পারতেই হবে। মাভৈঃ।
দেবযানী ভট্টাচার্য্য (Debjani Bhattacharyya)