এই বাংলা রবীন্দ্র-নজরুলের বাংলা, এ বাংলার মাটি লালনের গানে পুষ্ট। এখানে কোনও রকম প্রাদেশিকতার প্রবেশ নেই। ইদানীং এ কথা বারবারই বলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং স্পষ্টতই, বাংলার মাটি যে বিজেপির জন্য শক্ত ঘাঁটি– তা বোঝাতেই বারবার এ প্রসঙ্গ মনে করিয়ে দেন তিনি। বুঝিয়ে দেন, এ রাজ্যের সংস্কৃতি, কোনও রকম সংকীর্ণতাকে প্রশ্রয় দেয় না।
তবে এই বক্তব্যের পাশাপাশিই আজকাল আরও একটা কথা বারবারই উঠে আসছে, ‘বহিরাগত’। এ কথার লক্ষ্যও বিজেপিই। সর্বভারতীয় এ পার্টি যে কোনও ভাবেই বাংলার মাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারবে না, তারা যতই বাংলায় প্রচার ও প্রসার চালাক তারা যে আদতে ‘বাঙালি’ ঐতিহ্য থেকে অনেক দূরে, সেটাই যেন বোঝাতে চায় শাসক দল।
এই প্রেক্ষাপটেই আজ বৃহস্পতিবার সকালে বীরভূমের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ বছর পূর্ণ উপলক্ষে ভার্চুয়াল একটি বক্তৃতা দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রনাথ মোদী। তার ছত্রে ছত্রে উঠে এল রাবীন্দ্রিক ভাবনা। ‘বহিরাগত’ তকমা দিয়ে যখন তাঁদেরই আক্রমণ করা হচ্ছে বাংলায়, তখন বাংলার রবীন্দ্রনাথকেই অস্ত্র করলেন মোদী। রবীন্দ্রনাথের বাক্য দিয়েই শুরু করলেন বক্তৃতা, শেষও করলেন তাই। আর তাতেই যেন সূক্ষ্ম ইঙ্গিত মিশে রইল, রবীন্দ্রনাথের বাংলা নিয়ে গর্ব করলে, প্রাদেশিকতা ও বহিরাগতর অজুহাতে কাউকেই ঠেকিয়ে রাখা ঠিক নয়।
মোদী বক্তৃতা শুরুর গোড়াতেই বলেন, “হে বিধাতা, দাও দাও মোদের গৌরব দাও।” ছাত্রছাত্রীদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য গুরুদেব এই বাক্য লিখেছিলেন বলে উল্লেখ করেন তিনি। জানান, তিনি নিজেও আজ এই কথাটাই বলছেন বিশ্বখ্যাত বিশ্বভারতীর পড়ুয়াদের উন্নতি কামনা করে। জানান, এই প্রতিষ্ঠানের ১০০ বছর পূর্ণ করার অনুষ্ঠানে বক্তৃতা রাখতে পেরে তিনি খুশি। গুরুদেবের চিন্তা, দর্শন ও পরিশ্রমের কথা উল্লেখ করে বলেন, তাঁর স্বপ্নকে বিমূর্ত করার চেষ্টা করে চলেছে বিশ্বভারতী। নতুন ভারতের নির্মাণে এই প্রতিষ্ঠান নিত্যনতুন প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।
তাঁর কথায়, “ভারতে স্বাধীনতার কথা বলি তখন উনিশ শতকের কথা মনে হয়। কিন্তু এর বীজ অনেক গভীরে। ভক্তি আন্দোলন ভারতকে এক সূত্রে বেঁধেছিল। চৈতন্য মহাপ্রভু থেকে রামদাস, কবীর থেকে তুলসীদাস– সকলে এই আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। বিবেকানন্দও সেই ভক্তি আন্দোলনের ফসল। সেই সঙ্গে নতুন জ্ঞানের চেতনা স্বাধীনতার বিপ্লবকে সফল করেছিল। সেইসময় সবচেয়ে বড় ভূমিকা নেয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি। বিশ্বভারতীও তার অন্যতম। তার শতবর্ষে গৌরব কামনা করি।”
বীরসা মুণ্ডা, বীনা দাস, ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা– স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের নাম নেন মোদী। জানান, দেশে আত্মসম্মানের জন্য এঁরা হাসতে হাসতে প্রাণ দিয়েছেন। “তাই ভারতকে মজবুত ও আত্মনির্ভর বানানোর জন্য আপনাদের সহযোগিতা চাই। সারা বিশ্বের কাছে ভারতকে পৌঁছে দিতে চাই এক নম্বরে।”
তিনি পাশাপাশি মনে করিয়ে দেন, “স্বতন্ত্র পরম্পরা এবং ভারতের সংস্কৃতিকে একত্র করে গুরুদেব রাষ্ট্রবাদের জন্ম দেন , পাশাপাশি বিশ্ব মানবিকতারও। আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম দেখুন বিশ্ব আর মা ভারতী। বিশ্বভারতী আত্মনির্ভর ভারতের পথিকৃৎ। আত্মনির্ভর ভারতের বিকাশে আত্মবিশ্বাসের জন্ম দেয় বিশ্বভারতী।”
অনেকেই মনে করছেন, রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভাবনাকে বারবার তুলে এনে কার্যত রাজ্যের শাসকদলকেই বার্তা দিতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি আরও উল্লেখ করেন, “পৌষ মেলা ‘ভোকাল ফর লোকাল’-এর আদর্শ উদাহরণ। এই মহামারী কালে ‘ভোকাল ফর’ লোকাল হওয়া খুবই জরুরি। তাহলে বহু স্থানীয় মানুষের প্রতিভা বিশ্বের দরবারে পৌঁছবে, অন্ন সংস্থানও হবে অনেকের।”
এখানেই শেষ নয়। সংস্কৃতি ও শিক্ষা নিয়েও কথা বলেন মোদী, আর তা বলতে গিয়ে ফের অবতারণা করেন রবীন্দ্রনাথের গানের লাইনের। মনে করিয়ে দেন, “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।” অর্থাৎ এ লড়াইয়ে কাউকে পাশে পাওয়া বা না পাওয়ার ওপরে কিছুই নির্ভর করছে না। এর পরেই ফের রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির, জ্ঞান যেথা মুক্ত…। অর্থাৎ আমরা এমন ব্যবস্থার প্রচলন করি যাতে আমরা মুক্ত হতে পারি। মাথা তুলে চলতে পারি। মনকে ভয় মুক্ত করতে পারি। আজ জাতীয় শিক্ষানীতি এরই ধারক।”– বলেন মোদী।
মোদী আরও বলেন, একে অপরে সংস্কার, ঐতিহ্য ও রীতিনীতি বিনিময় করায় বিশ্বাসী ছিলেন গুরুদেব। নানাজাতি, নানাভাষার দেশ এভাবেই জুড়ে থাকতে পারে বলে মনে করতেন তিনি। তাই রবীন্দ্রনাথ যখন গুজরাতে গিয়েছিলেন, তখন সেখানকার মহিলাদের যে শাড়ি পরার ধরন, ডান দিকে আঁচল করে, তা বদলে বাঙালিদের মতো বাঁ দিকে আঁচল করার প্রথা প্রচলন করেন, এমনটাই দাবি করেন মোদী।
প্রধানমন্ত্রীর কথায়, “আমাদের উচিত কবিগুরুর এই বিনিময়ের ভাবনাকে আরও শক্তিশালী করা। আমি গুরুদেবের কথা দিয়েই শেষ করব, ‘ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল, লাগল যে দোল। স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল, দ্বার খোল।’ দেশে নতুন সম্ভাবনার দ্বার আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আপনারা আরও এগিয়ে চলুন, সাফল্য়ের সঙ্গে দেশের মুখ উজ্জ্বল করুন, শুভেচ্ছা রইল।”