বাংলা নববর্ষ মানেই হালখাতা, প্রভাতী অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীত, দুপুরে বাঙালি পদে ভুঁড়িভোজ আর সন্ধ্যায় আড্ডা। সব মিলিয়ে স্বর্গাদপী গড়িমসির একটা দিন। সন্ধ্যায় টেলিভিশনের সংবাদে ঢাকায় রমনা ময়দানের খবর, বাংলা নববর্ষ পালনের অপরাধে কয়েকজন যুবক যুবতীকে রক্তাক্ত করেছে একদল মৌলবাদী। খবর শুনতে শুনতেই দুই বন্ধু স্কচ–হুইস্কি নিয়ে ঢুকবে। বাংলা নববর্ষে মৌরলা মাছ ভাজার সঙ্গে ইংলিশ খাওয়াটাই তো দস্তুর। এরপরের দু’ঘণ্টায় সত্তরের দশকের বাংলা ছুঁয়ে ফেলা। বাঙালি মানে প্রগতিশীলতা, বাঙালি মানে প্রতিবাদ, বাঙালি মানে এগিয়ে থাকা।
কিন্তু বাঙালির সংজ্ঞাটা কী? কে বাঙালি? ২০০৪ সালে বিবিসি ১১ ফ্রেব্রুয়ারি থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত একটা সমীক্ষা করেছিল। সমীক্ষার শিরোনাম ছিল ‘গ্রেটেস্ট বেঙ্গলি অফ অল টাইম’। সেই সর্বকালের সেরা বাঙালি ১৪১১ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখ মানে ১৪ এপ্রিল ২০০৪ সালে বিবিসি জানাল যে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি মনোনীত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। দ্বিতীয় হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর সতেরতম স্থান পেয়েছেন স্বামী বিবেকানন্দ। মুজিবর রহমানের প্রতি বিন্দুমাত্র অশ্রদ্ধা না করেও বলা যায় যে, প্রশ্নটা তো ছিল সর্বকালের শ্রেষ্ঠ! এই উপমহাদেশটাতে জ্ঞানের আলো, স্বাধীনতার স্ফুলিঙ্গ তো এই বাংলার মাটিতেই জ্বলেছিল। রামমোহনের সতীদাহ প্রথা রদ করা, বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়ন, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম’ গান, অবনীন্দ্রনাথের ‘ভারতমাতার’ চিত্রপট– বাঙালি বাদ দিলে ভারতের নবজাগরণ আধ পৃষ্ঠায় শেষ। সর্বকালের হিসাবে এই স্বর্ণময় সময়ের কথা উঠে এল না কেন? ভারতবর্ষ স্বাধীনতার পরে ভারতের ‘জাতীয় ক্যালেন্ডার’ তৈরির কাজ শুরু হয়। এই ক্যালেন্ডার রিফর্ম কমিটির অধ্যক্ষ ছিলেন আর এক বাঙালি মেঘনাদ সাহা। তাঁর নেতৃত্বে সিএসআইআর–এর এই বৈজ্ঞানিকদের দল জাতীয় সম্বৎ প্রকাশ করেছিলেন। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সঙ্গে বৈশাখ থেকে চৈত্র মাসের এই দিনপঞ্জিও ‘দ্য গেজেট অব ইন্ডিয়া’তে অন্তর্ভূক্ত হল। এত গৌরব, এত মানুষের ত্যাগ কীভাবে বিস্মৃত হল একটা জাতি?
আজ নববর্ষের দিন বোধহয় আর একবার ভাবার প্রয়োজন, বিশেষ করে বাংলার যে অংশ ভারতবর্ষের মধ্যে আছে, সেখানে কী হারিয়েছে যার জন্য এই বিস্মৃতি? স্পষ্টতই যেটা নেই সেটা হল ‘ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন’। মত প্রকাশের অধিকার সহজে আসে না। এ্রর জন্য একটা জাতির সাহস লাগে। কয়েক দশকের ত্যাগ প্রয়োজন হয়। এপার বাংলার সংবাদ মাধ্যম হয়তো সেই সাহসটাই হারিয়েছে। প্রতিবাদের সাহসকে গ্রাস করেছে পাওয়ার লোভ। কিন্তু ভাবমূর্তি বজায় রাখা প্রয়োজন। তাই তাঁরা সহজ শিকার খোঁজেন। যাদের বিরুদ্ধে বললে প্রগতিশীল হওয়া যাবে আবার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে না। তারা সেই অভিনয়টাই করেন যাতে এরাজ্যে কোনও বিপদের ঝুঁকি নেই কিন্তু লক্ষ্মীলাভের আশ্বাস আছে। রাজ অনুগ্রহের সম্ভাবনা আছে।
অথচ ‘বেঙ্গল গেজেট’ ভারতে প্রকাশিত প্রথম খবরের কাগজ। ভারতীয় ভাষার প্রথম সংবাদপত্র বাংলা সমাচার দর্পনও এই বাংলা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। দেশের সর্বপ্রথম হিন্দি সংবাদপত্র ‘উদন্ত মার্তণ্ড’ ৩০ মে ১৮২৬ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশ করেছিলেন যুগল কিশোর শুক্লা। মানুষের দুঃখ, অত্যাচারীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হাতিয়ার ছিল সংবাদ মাধ্যম, খবরের কাগজ। বাংলার সংবাদপত্রের এই অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতায় ভীত হয়ে ইংরেজ ভাইসরয় লর্ড লিটন ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট লাগু করলেন ১৮৭৮ সালে। অমৃতবাজার পত্রিকা বাংলা থেকে ইংরাজি হয়ে গেল। কিন্তু প্রতিবাদ বন্ধ হল না। ১৯২২ সালে তাঁর ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার পূজা সংখ্যায় কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন ‘আনন্দময়ীর আগমনে’। একেবারে দেশাত্মবোধের বারুদে ভরা কবিতা। ইংরেজ ধূমকেতু নিষিদ্ধ করল, গ্রেফতার হলেন নজরুল।
এই সাহস, এই সোজা শক্ত মেরুদণ্ড ছিল বাংলা সংবাদ জগতের গর্ব। ১৯৪৬–৪৭ সালের ভয়াবহ হিন্দু নির্যাতনের মর্মস্পর্শী ছবি তুলে ধরেছিল আনন্দবাজার পত্রিকা। সেদিন বাংলার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর মুসলিম লিগ সরকার সেই অপরাধে জরিমানা করেছিল আনন্দবাজার পত্রিকার উপর। স্বাধীনতার পরেও এই উন্নতশির সাংবাদিকের সারা ভারতবর্ষ নতমস্তকে কুর্নিশ করত। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত ইন্দিরা গান্ধীর এগারো বছরের শাসন নিয়ে বরুণ সেনগুপ্ত লিখেছিলেন ‘ইন্দিরা একাদশী’। জেল হয়েছিল বরুণ বাবুর। তবু হিমাদ্রির শিখরের মতো উন্নতশির ছিল কলকাতার সাংবাদিকতা। আর কটা উদাহরণ আছে সারা ভারতবর্ষে? দেখান আর একটা ‘ইন্দিরা একাদশী’!
আজ ২০১৯ সাল। গত ২৯ চৈত্র ১৪২৫ তারিখে কলকাতার খবরের কাগজের শিরোনাম হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ সাহেবের বক্তব্য। বিমানবন্দরে শুল্ক দফতরের সঙ্গে কলকাতা পুলিশের বিবাদ, বিধিবহির্ভূত ভাবে সোনা আনার জন্য মহামান্য সর্বোচ্চ আদালত বলেছেন যে, ”রাজ্যে কী চলছে দেখতে চাই।” রাজনৈতিক নেতানেত্রীর ঘনিষ্ঠ মানুষদের নিয়ে এমন বিতর্ক নতুন নয়। অনেক ক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন আদালতও গণতন্ত্রের এক অপরিহার্য স্তম্ভের মতো ভীষণ দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রশ্নটা সম্পূর্ণ অন্য। প্রশ্নটা হল গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ মানে সংবাদ মাধ্যমকে নিয়ে। কলকাতায় মত প্রকাশের অধিকার কি আদৌ আছে?
যদি থাকে তবে ১৬ মার্চ এই কাগজগুলিই এই ঘটনার কোনও খবর করল না কেন? খবরটা এইসব এগিয়ে থাকা কাগজগুলোর নিউজ ডেস্কে আসেনি? অসম্ভব। সেদিন রাতেই যাঁরা রাজনৈতিক বিড করেন, যাঁরা পুলিশ বিড করেন তাঁরা খবর যথাস্থানে পাঠিয়েছিলেন। তবে কি এটা ‘নিউজ’ই নয়? সেটা বললে হয়তো ঘোড়ায়ও হাসবে! তবে? সেনসিটিভ? ছাপালে দাঙ্গা লেগে যেত? নৈতিক দায়িত্বের কথা মাথায় রেখেই এইসব এগিয়ে থাকা, বিশ্বমানের সংবাদপত্রগুলি ১৬ তারিখ, ১৭ তারিখ একটি লাইনও ছাপায়নি। কেন, এ প্রশ্নের উত্তর বাংলার সাংবাদিকরা দিতে পারবে না। সেই মেরুদণ্ডটাই ভেঙে গেছে। আজ পয়লা বৈশাখের পূণ্য দিনে যদি আপামর বাঙালির সত্যি কিছু চাওয়ার থাকে তো সেই মেরুদণ্ড। হরিশ মুখার্জির, নজরুল ইসলামের বা বরুণ সেনগুপ্তের মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ড পুলিশের লাঠিতে ভাঙে না আর টাকার থলির সামনে বেঁকে যায় না।
সাংবাদিকতাও একটা পেশা। কেউ ডাক্তার হয়ে, কেউ ইঞ্জিনিয়ার হয়ে, কেউ বা অধ্যাপক হয়ে অনেক পয়সা করবেন আর একজন যোগ্য শিক্ষিত মানুষ সফল সাংবাদিক হয়ে চিরকাল গরীব থাকবেন? সাংবাদিকরা কি চুরির দায় ধরা পড়েছেন? যুক্তিযুক্ত প্রশ্ন। তবু সমাজ তাঁদের কাছে আশা করে। যেমন একজন এফআরসিএস ডাক্তারের কাছে আশা করে যে, তিনি মরণাপন্ন রুগীর শিয়রে সারারাত জাগবেন। একজন অতি উচ্চশিক্ষিত সাংবাদিকের কাছেও সমাজের প্রত্যাশা এখনও শেষ হয়ে যায়নি। সমাজ তাকে কোটি টাকার ব্যবসার মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দেখতে চায় না। তার না বলা কথার বাঙ্ময় মুখ হিসাবেও দেখতে চায়। একজন চাকুরীজীবী মানুষের কত টাকা হতে পারে যে, এনফোর্সমেন্ট ডায়রেক্টরেট তাকে ডেকে পাঠাবে? ধনকুবের মালিক নয়, শিক্ষিত, মেরুদণ্ডী, সমাজ সচেতন সাংবাদিক শেষ কথা বলবেন, সেটার দিকেই আজ তাকিয়ে আছে বাংলা।
হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় তার হিন্দু পেট্রিয়ট কাগজে লাগাতার নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরূদ্ধে লিখেছিলেন। তাঁর লেখায় কেঁপে উঠেছিল কোম্পানির শাসনের ভিত। ইংরেজের উৎপীড়নে আর অত্যধিক পরিশ্রমে মাত্র ৩৭ বছর বয়েসে মারা যান হরিশ। গরীব ঘরের ছেলে ছিলেন, দারিদ্রের জন্যই পড়া ছেড়েছিলেন। মৃত্যুও হল সেই দারিদ্রের কারণেই। তাঁর মৃত্যুর পরেও ইংরেজ তাঁর বিধবা স্ত্রীর উপর মামলা চালায়। হরিশ কী পেয়েছে?
হরিশচন্দ্রের ত্যাগ বাংলাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। মৃত্যুর কয়েক বছর পরেই বাংলার গ্রাম–গঞ্জের রাস্তায়, হাটেবাজারে কোনও বাউল গেয়ে গেয়ে ফিরত, ”নীল বাঁদরের জ্বালায়/ সোনার বাংলা হল ছারখার/ অসময়ে হরিশ ম’ল/ লং–এর হল কারাগার।”
আজ ১৪২৬ সালের নববর্ষে বাংলার মানুষ সেই হরিশ মুখার্জিকে চায়। বঙ্গলক্ষ্মী তার জন্যই সোনার আসন পেতে রেখেছেন। বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল আজীবন কাঁদবে তার পায়ে।