রাজনৈতিক জগতের কেউ কেউ নরেন্দ্র মোদীর ঐতিহাসিক জয়ের মুহূর্তগুলির দীর্ঘায়িত হওয়াকে এক শ্রেণীর বিরোধীদের কাছে দুঃস্বপ্নের রাত্রির দীর্ঘায়ন বলে বর্ণিত করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ভারত’ এই বার নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ধ্বংস হয়ে গেল। হ্যা, হিন্দুদের মনকে ঈর্ষা ও ঘৃণার মাধ্যমে বিষিয়ে দিয়েই একাজ সফল হয়েছে। এ সমস্ত শুনলে মনে হয় হিন্দুরা যেন তাদের ক্লোদাক্ত মনের অন্দরে গোঁড়ামি আর ঘৃণাকে লালন করে আসছিল কেবল একজন লোহা থেকে সোনা বানানোর বাজিকরের অপেক্ষায় যে এসেই তাতে বিস্ফোরণ ঘটাবে। মোদী খুব ভালো ভাবেই জানতেন এই তথাকথিত ‘কালা জাদুর’ সীমাবদ্ধতা। ৮০-র দশকের শেষের দিকে মোদীর রাজনৈতিক গুরু এল কে আদবানী বিজেপির সভাপতি হিসেবে উপলব্ধি করেছিলেন নির্বাচনী ময়দানে। কৌশল হিসেবে শুধুমাত্র গোঁড়া হিন্দুত্বের সাফল্যের সীমারেখা। সেই কারণে সমগ্র নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণ করলে মোদী কেবলমাত্র হিন্দুত্বের ধ্বজা উড়িয়ে, গোঁড়া হিন্দুত্ববাদীদের লাইন অনুসরণ করেই ক্ষমতায় ফিরেছেন এমনটা ভাবা একেবারেই ভুল। মোদী তার সর্বব্যাপী প্রভাব কখনই হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বা সংবিধানের ধাঁচাকে এড়িয়ে একটি হিন্দু পাকিস্তান গড়ার দিকে ধাবিত করাননি।
তাঁর ভেতরে যদি এই ধরনের কোনো উগ্র প্রবণতা থাকত সেক্ষেত্রে তিনি প্রশাসনিক ক্ষমতার নানাবিধ প্রয়োগের মাধ্যমে হিন্দুদের রামমন্দির উপহার দেওয়ার চেষ্টা করতেন। বাস্তবে কিন্তু প্রতিটি জাতীয়তাবাদী হিন্দুর কাছে রামমন্দির নির্মাণ কেবলমাত্র হিন্দু গৌরবের সর্বময় নিদর্শন নয়। এটি হিন্দুরাষ্ট্র তৈরির পথে প্রথম দিকচিহ্ন। নজর করলে দেখা যাবে মোদীরশাসনকালে হিন্দুত্বের রথযাত্রা কেন্দ্র করে কোনো উন্মাদনা পরিলক্ষিত হয়নি। কোনো বড়ো ধরনের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার খবর তো নেই-ই। অবশ্যই ভারতে মুসলমান আধিপত্যের অতীত নিদর্শনগুলিকে লুপ্ত করে দেওয়া নিয়ে কট্টরবাদীদের চাপ নিরন্তর ছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলিকে সামলানো হয়েছে। শুনলে অবাক হতে হবে অতীতের মুসলমান ঐতিহ্যের সংরক্ষণের এই বিচিত্র পরিকল্পনা নিয়েছেন উত্তরপ্রদেশের গেরুয়াধারী মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। তাজমহল ও ফতেপুর সিক্রিকে কেন্দ্রস্থলে রেখে এই পরিকল্পনায় এক প্রাচীন। ঐশ্বর্যময় সোনালি ত্রিভুজের পরিকল্পনা করা হয়েছে। পূর্ণ প্রকল্প রূপায়িত হলে ৫ লক্ষ চাকরি ও বছরে ৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আসতে চলেছে।
অবশ্যই ছিদ্রান্বেষীরা বলতেই থাকবে গেরুয়াধারীকে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী করে ও সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে তাকে দিয়ে ব্যাপক প্রচার করিয়ে বিজেপি হিন্দুত্বের প্রবল প্রচারকদের আশ্বস্ত রেখেছে। একই প্রেক্ষিতে বিতর্কিত সাধ্বী প্রজ্ঞা সিংহ ঠাকুরকে দল কেন লোকসভায় ঢোকার সহজ ছাড়পত্র তুলে ছিল? সাদা চোখে বিষয়টা যতই বিসদৃশ লাগুক না কেন এর অন্তর্নিহিত সংকেত দিল গভীর। নিজেদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠভূমি ও উচ্চাশা চরিতার্থ করতে কংগ্রেসের যাঁরা হিন্দুত্বের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদকে এক আসনে বসিয়ে দিচ্ছিলেন তাদের কাছে একটি নির্ভেজাল শান্তির সংকেত পেল। এখানে মুসলমানদের জন্য কোনো অর্থবহ কিছু ছিল না।
অনেকেরই হয়তো নজর এড়িয়ে গেছে ২০১৪ সালে যেদিন থেকে মোদী ক্ষমতায় বসেছেন সেদিন থেকেই ভয়ংকর দ্রুততায় একশ্রেণীর সেকুলারবাদী তার কার্যকলাপের ওপর এক ধরনের ড্রোণ অপারেশন’(ওপর থেকে নজরদারি করা) জারি রেখেছেন। নিজেদের মধ্যে চাউর করছেন সেই পুরনো কেচ্ছা দেশের সেকুলার পরিকাঠামোটা ধ্বংস হয়ে যেতে বসেছে। আক্রমণাত্মক হওয়া তো দূরের কথা হিন্দুরা বিগত পাঁচ বছরে শুধু রক্ষণাত্মকই থেকে গেছে।
এঁরা মোদীর আর এস এস ব্যাকগ্রাউন্ড ও সেই হেতু হীনমনস্ক হিন্দু আধিপত্যবাদীদের সঙ্গে তাঁর যোগ নিয়ে তীব্র বিষোগার জারি রেখেছিলেন। জনমনে এমন ধারণা চালাতে চেয়েছিলেন যে দেশে তার যে অগণন অনুরাগী রয়েছে তারা সকলেই হিন্দু মৌলবাদী। যাঁরা এক ধরনের নতুন ভক্তিবাদকে প্রতিষ্ঠা দিতে চান যা তাদের ভাষায় আদৌ মিলনাত্মক নয়, চরমভাবে বিভাজন সৃষ্টিকারী। এদের মধ্যে আবার চরমপন্থীরা মোদীর সমর্থকদের অন্তিম তকমা দিতে সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সিভিল রাইট মুভমেন্টকারীদের খুন করার দল ‘klu klax klan’-এর সমগোত্রীয় ঘোষণা করলেন। ছবি এঁকে বোঝালেন এরা মাথায় ঢাকা দিয়ে থাকা মুসলমানদের প্রতি অন্ধ ঘৃণাজনিত কারণে। ঘৃণা আছে দলিত, সমলিঙ্গীয়, উদারবাদী, গণতন্ত্রে বিশ্বাসীদের ওপর। শুধু তাই নয়, ঘৃণার পাত্র তারা সকলেই যারা হিন্দু রাষ্ট্রের পথের কাটা হতে পারে। সমাজকে খণ্ড বিখণ্ড করে ক্ষমতা ভোগ করার কি কদর্য কৌশল! ঠিক যেন প্রত্যেকটি উদারবাদী আর্বান নকশাল নয় তেমনি প্রতিটি মোদী সমর্থকও কখনই মৌলবাদী নয়। বরঞ্চ অধিকাংশ মোদী সমর্থকই বিরক্ত হয়েছেন যখন কিছু কিছু ক্ষেত্রে কট্টর মুসলমান বিরোধীদের বিজেপি প্রশ্রয় দয়েছে। উদাহরণ স্বরপ গো সংরক্ষণের নামে নিমর্ম মানুষ নিধন বহু মোদী সমর্থকই বহু ক্ষেত্রে মেনে নিতে পারেননি। এ ব্যাপারে সরকারি তৎপরতার অভাব সমর্থকদের বিরক্তই করেছে।
অনেকেই বলে থাকেন তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধীরা যে ভাবে সদা হিন্দুত্বকে খাটো চোখে দেখাতে ও তার তীব্র নিন্দা করে হিন্দুত্বের ভাবাদর্শকে কলঙ্কিত করতে অভ্যস্ত নরেন্দ্র মোদী সেই অনন্য আঘাত পাওয়া থেকে হিন্দুত্বকে বাঁচাতে চান। কিন্তু এই আঘাতের সরাসরি প্রত্যাঘাত বা কট্টর হিন্দুত্বের রাস্তা না ধরে তিনি Hinduness যার বাংলা নিরুপণ করা ঝুঁকিপূর্ণ তাকেই বেছে নিয়েছেন। হিন্দু জাতির যে চিরকালীন গুণাবলী সেই পথে অগ্রসর হওয়া বললেই হয়তো কিছুটা বলা যেতে পারে। এই হিন্দুমনস্কতাই সমাজের বহুবিধ স্তরকে তার দিকে আকৃষ্ট করেছে। কেবলমাত্র উচ্চবর্ণই বিজেপি’র পক্ষে যাকে এই গতানুগতিক মত বাতিল হয়ে গেছে।
বাস্তবে এই হিন্দু মনস্কতা ধর্মের পরিভাষা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্রে সরসচ্ছাচালক মোহন ভাগবত তার দিল্লিতে দেওয়া বক্তৃতামালার এক অংশে সুন্দর ভাবে বলেছেন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে যাঁরাই ভারতে বসবাস করে এই হিন্দুমনস্কতাকে উপলব্ধি করেছেন তারা কখনই দেশের মধ্যে বিদ্যমান বৈচিত্র্যকে বিভাজন বলে মনে করেন না। কেননা তাদের মধ্যে জীবন সম্পর্কে হিন্দু দৃষ্টিকোণ ক্রিয়াশীল থাকে। মোদীর ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ এই ভাবনা শৃঙ্খলেরই ফলিত রূপ। যা তিনি বারবার আমাদের স্মরণ করিয়েছেন। সকলকে নিয়েই চলতে হবে। হ্যা, হিন্দুমনস্কতা সমাজে সংখ্যালঘুদের কখনই তাদের হক থেকে বঞ্চিত করার কথা বলে না। সমাজে সকলেই যাতে নিজ নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী উঠে অঅসতে পারে সে বিষয়ে সচেষ্ট থাকে। এ বিষয়ে জাতিভিত্তিক আত্মপরিচয়ের সুযোগকে সম্পূর্ণ বিবেচনার বাইরে রাখা হয়।
সংসদ চত্বরে সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনী বিজয়ের পর নরেন্দ্র মোদী তার আপ্তবাক্যটির আর একটু বিস্তার ঘটিয়েছেন। ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ-এর সঙ্গে এখন ‘সবকা বিশ্বাস’ও সংযুক্ত হয়েছে। এই সাম্প্রতিক সংযোজনটি মুসলমানদের ক্ষেত্রে একটি প্রত্যক্ষ বার্তা দিতে চায় যে, তাঁদের ভবিষ্যৎ আদৌ বিপন্ন নয়। মোদী সরকার তাঁদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখবে না।
সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের নির্যাস হিসেবে এটাই বলা যায় যে মোদীর সমর্থক ও অনুরাগীরা এটাই প্রত্যাশা করেন যে রাজনীতি শুধু নিজসমৃদ্ধির জন্য না হয়ে জনজীবনে সকলের সমৃদ্ধির সম্ভাবনাকে আশার আলো দেখাবে।
এই আশার দীপ্তিতেই সাধারণ মানুষ একদিন ‘স্যুট বুট পরে যে কোনো জায়গায় যাওয়ার জন্য তৈরি হতে পারে। সেদিন তার কপালে একটি তিলক থাকলেও ক্ষতি নেই। সেদিন তাকে তার জাতি সংক্রান্ত প্রশংসাপত্র দেখিয়ে চাকরির বা কোনো প্রকল্পের ঋণের আবেদন করতে হবে না। তাদের মধ্যে এমন এই আশাই প্রাণবন্ত যে সেদিন ‘ভারতমাতা কী জয়’ বলা কোনো ধরনের হীনমন্যতার পরিচায়ক হবে না। বরঞ্চ দেশপ্রেমিক ভারত-জনতার বিশাল অংশ সেদিন এই মন্ত্র উচ্চারণ করে তাদের অকুণ্ঠ দেশপ্রেমকেই উদ্যাপন করবে।
রাহুল শিবশঙ্কর
2019-06-13