যেখানে সূর্যের আলো ঢোকে না৷ ঠাণ্ডা স্যাঁত স্যাঁতে হয়ে থাকে চারদিক৷ কণকণে হাওয়ায় রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে যায়৷ দুর্গম ভয়াবহ পরিবেশ ও অতলস্পর্শী খাদের নিচে অনেক নিচে রুপোলি সুতোর মতো দেখা যায় নদী৷ আর মাথার উপরে আকাশ দেখাই যায়না- ধারণা করা হচ্ছে, সেইখানেই কোনও এক পাহাড়ি খাঁজে পড়ে রয়েছে বায়ু সেনার নিখোঁজ হওয়া বিমানটি৷
এমনই স্থানের খোঁজ যখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি হদিস দিতে পারছে না৷ এই অবস্থায় ভরসা ‘আদি’ (Adi) উপজাতির দুর্ধর্ষ শিকারিদের দল৷ প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকা এই জনগোষ্ঠীর কয়েকজনকে খুঁজতে পাঠানো হয়েছে বিমানটির সর্বশেষ অবস্থান৷
কোমরে ধারালো তলোয়ার, হাতে বর্শা, মাথায় রংবেরঙের পাখির পালক দিয়ে পরা টুপি ও তীর ধনুক নিয়ে মাইলে পর মাইল এই ‘আদি’ মানবরা চলতে পারেন৷ প্রচণ্ড কষ্টসহিষ্ণু তাদের জীবনযাত্রা৷ প্রকৃতি প্রেমী অথচ হিংস্রতা তাদের চরিত্র৷ এমনিতে বাইরের কাউকে তারা কিছু বলেন না৷ কিন্তু তাঁদের জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হতে পারে এমন কিছুই আবার সহ্য করেন না৷ সবমিলে শৌর্য-বীরত্বের আবরণে ঢেকে থাকা এই ‘আদি’ চরিত্র নৃতত্ত্ব ও প্রকৃতি বিশেষজ্ঞদের কাছে প্রবল আকর্ষণীয়৷ এরাই খুঁজে বের করতে পারেন বিমানটির অবস্থান৷ এদের উপরেই আশা রেখেছে অরুণাচল প্রদেশ সরকার৷
গত সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ, ৮ জন বায়ু সেনা কর্মী সহ ১৩ জন যাত্রী নিয়ে অসমের জোরহাট থেকে চিন সীমান্ত লাগোয়া অরুণাচল প্রদেশের মেচুকা অ্যাডভান্সড ল্যান্ডিং গ্রাউন্ডের উদ্দেশে রওনা দেয় ‘অ্যান্টোনভ এএন-৩২’ বিমান। কিছুক্ষণের মধ্যেই জোরহাট এটিসি-র সঙ্গে বিমানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। তারপর এক সপ্তাহ ধরে নিখোঁজ সেই বিমান৷ বায়ু সেনার তরফে বারে বারে তল্লাশি অভিযান চলানো হয়েছে৷ আটিবিপি, স্থল সেনা নেমেছে অভিযানে কিন্তু নিখোঁজ বিমানের বিপদসূচক ব্যবস্থা আগে থেকেই অকেজো থাকার কারণে অবস্থান নির্ণয় করা যাচ্ছে না৷
উত্তর পূর্বাঞ্চলের রহস্যময় স্থান অরুণাচল প্রদেশ৷ চিন ও মায়ানমার সীমান্ত দিয়ে ঘিরে থাকা রাজ্যটির উত্তর ও পূর্ব দিকের অংশটি এখনও সুপ্রাচীন আদিমতায় মোড়া৷ এই অরণ্য রহস্যের তল এখনও পায়নি প্রকৃতি বিজ্ঞান৷ হরেক কীট-পতঙ্গ, সরীসৃপ, তাক লাগিয়ে দেওয়া গুল্ম-গাছের ভাণ্ডার এখানে৷ বস্তুত অরুণাচল প্রদেশের বেশিরভাগ এলাকা এমনই৷ কিন্তু আন্তর্জাতিক সীমান্ত লাগোয়া অঞ্চলগুলি আরও রহস্যাবৃত৷
অরুণাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডু জানিয়েছেন, তল্লাশি অভিযানে নামানো হয়েছে স্থানীয় উপজাতি জনগোষ্ঠীর ওস্তাদ শিকারিদের৷ তারাই একমাত্র গভীর থেকে গভীরতর অরণ্যাঞ্চলে ঢুকতে পারে৷ এটা তাদের কাছে অত্যন্ত স্বাভাবিক কাজ৷ এসব মাথায় রেখে নিখোঁজ বিমানের সন্ধান পেতে অভিযান শুরু করেছে ‘আদি’ শিকারীরা৷ রাজ্য সরকার জানিয়েছে, প্রতিটি দলে রয়েছেন তিন-চারজন শিকারী৷ তাদের তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে৷
প্রথম দলটি- অতি দুর্গম এলাকা বায়োর আদি পার্বত্যাঞ্চলে খোঁজ শুরু করেছে
দ্বিতীয় দলটি- পারি আদি পার্বত্য এলাকায় অভিযান চালাচ্ছে
তৃতীয় দলটি- ভিরগং পার্বত্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে৷
চিনের তিব্বত অংশ এবং সেই সীমান্ত লাগোয়া অরুণাচল প্রদেশের এলাকায় ছড়িয়ে রয়েছেন এই ‘আদি’ (Adi) নামের উপজাতি৷ এদের নিজস্ব রীতি-সংস্কৃতি চমকে দেয়৷ স্থানীয় বোকর ভাষায় তাঁরা কথা বলেন৷ সবার পক্ষে এই ভাষা বোঝা সম্ভব নয়৷ একমাত্র তাঁদের ঘনিষ্ঠরাই সেটি বুঝতে পারেন কিছুটা৷ দুর্গম এলাকায় চমকপ্রদ উপায়ে পাখি শিকার করার হরেক পদ্ধতি রয়েছে তাঁদের৷ তেমনই রয়েছে বিষাক্ত কীট-পতঙ্গ ধরে ফেলার ক্ষিপ্র উপায়৷ আবার কৃষিতেও তারা স্বচ্ছন্দ৷ তবে মূলত শিকারি জীবনকেই তাঁরা বেছে নিয়েছেন৷ অরুণাচলের সিয়াং পার্বত্য এলাকার ঘন জঙ্গলের আঁতি-পাঁতি তাদের মতো কেউ চেনেন না বা বোঝেন না৷