অসহিষ্ণুতা : প্রসঙ্গ অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের টুইট বার্তা

অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড একটা ট্যুইট করে রাম মন্দিরের ভূমি পুজনের প্রাক্কালে। সেই ট্যুইটের বক্তব্য বাবরি মসজিদ ছিল আছে থাকবে। হাজিয়া সোফিয়া ওদের কাছে খুব বড় একটা উদাহরণ। একটি অন্যায়, অত্যাচারী, নির্লজ্জ, সংখ্যাগুরু তোষণকারী বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে জমির অন্যায় অধিগ্রহণ অবস্থার পরিবর্তন করতে পারবে না। ভগ্ন হৃদয় হওয়ার কোন দরকার নেই। পরিস্থিতি চিরকাল স্থায়ী হয় না।

ট্যুইটটি অত্যন্ত মূল্যবান যেখানে একটা বিষম মনোভাব, চরম ধর্মীয় বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধতার বহিঃপ্রকাশ। এই টুইটের মাধ্যমে বেশ কিছু জিনিস খুব পরিষ্কার করে বলে দেওয়া হয়েছে। যে বার্তা আমরা পেয়েছি তার বিশ্লেষণ করা খুব দরকার। যখন ৪৯২ বছরের সুদীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে শ্রী রাম তাঁর নিজের মাতৃভূমিতে, তাঁর নিজের জন্মভূমিতে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছেন। হিন্দুর দেশে হিন্দুর প্রধান আরাধ্য দেবতা সুদীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর সুপ্রিম কোর্টের দরবারে সাক্ষ্যপ্রমাণ সহকারে জয় লাভ করে তবেই রাম মন্দির নির্মাণ হতে চলেছে। যে দেশে সংখ্যাগুরু ধর্মীয় ভাবাবেগের এই করুন অবস্থা, সেখানে রাম যে দীর্ঘদিন গৃহহীন থাকবেন তাতে আর আশ্চর্য কী।

ধর্মনিরপেক্ষ দেশে কোন বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা কোনো ‘ল বোর্ড’ কতটা আইনসম্মত সেটা এবার সুনিশ্চিত করার সময় এসেছে। যারা প্রতিমুহূর্তে ধর্মনিরপেক্ষতার কাঁসর ঘন্টা বাজায়, তাদের কাছে অথচ পাঁচ ওয়াক্তের নামাজ মাইক বাজিয়ে জায়েজ কেন, সেই বৈধ প্রশ্ন তোলে না কোন রাজনৈতিক দল, কোন সেকুলার সংবাদ মাধ্যম‌। যারা হিন্দু ধর্মের সমস্ত ধর্মীয় পুজোকে উৎসবে পরিণত করে, শিবরাত্রির দুধ নিয়ে জল ঘোলা করে, দেওয়ালির আতসবাজি থেকে হোলিতে জলের অপচয় নিয়ে যাদের কথার শেষ হয় না, তারাই কুরবানী নিয়ে চুপ থাকে। ধর্মীয় উদারতা আসলে হিন্দুদের ধর্ম পালনের পরিপন্থী। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার দায় শুধুমাত্র সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের। এই যে দীর্ঘদিনের পরিচিত পরিবেশ সেখানে মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড যে রাম মন্দিরের বিপক্ষে বলবে, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই

এবার এক এক করে বিশ্লেষণ করা যাক বক্তব্যের সারবত্তা কতটা। ঐতিহাসিকভাবে এই মসজিদ যে বাবর তৈরি করেছিল তার কোন প্রমাণ নেই। যে তিনটে শিলালিপি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছিল যে মসজিদটি বাবর নির্মাণ করেছিল, সেই শিলালিপি সবগুলোই নকল, ভুয়ো। ফার্সী ভাষায় লেখা শিলালিপিতে বলা হয়েছিল ৯৩০ হিজরী অর্থাৎ ১৫২৩ খ্রীঃ এ বাবরের নির্দেশে তার সেনাপতি মীর খান এই মসজিদ নির্মাণ করে। না ১৫২৩ খ্রীঃ এ বাবর ভারত অধিকার করেছিল আর না মীর খান বলে বাবরের কোন সেনাপতির উল্লেখ সমকালীন কোন তথ্যে পাওয়া যায়। বাবরের আত্মজীবনীতে মীর খানের নাম পাওয়া যায় না। পরে ৯৩০ হিজরী নাকি ভুল পাঠোদ্ধার বলা হয় এবং মীর খানকে মীর বাকি বলে চালানো হয়। কিন্তু এখানেও গণ্ডগোল হয়। বাবরনামা অনুযায়ী বাবরের সৈন্যসামন্ত অযোধ্যায় প্রবেশ করেই নি। আর অযোধ্যার আশেপাশের যুদ্ধ যারা করেছিল তাদের মধ্যে মীর বাকি কেউ ছিল না।

বিখ্যাত ইউরোপীয় পর্যটক টিফেনথেলার ১৭৪৩ খ্রীঃ তাঁর ভারত ভ্রমণের সময় অবধ প্রদেশ তথা অযোধ্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন তাঁর ল্যাটিন ভাষায় লেখা ‘Descriptio Indica’ গ্রন্থে। সেখানে মসজিদ সম্পর্কে উনি বলেছেন, একদল মনে করে বাবর মসজিদ নির্মাণ করেছিল, অন্যদল মনে করে আরঙ্গজেব নির্মাণ করেছিল কাশী ও মথুরার সঙ্গে অযোধ্যাতেও। যদি সেই সময় ফার্সীতে শিলালিপি থাকত তবে ফার্সী ভাষায় পণ্ডিত টিফেনথেলার অতি অবশ্যই সেটা পাঠোদ্ধার করতেন এবং সঠিক সিদ্ধান্ত দিতেন। এই রকম সংশয় প্রকাশ করতেন না। এমনকি ২৪ শে ডিসেম্বর ১৮৮৫ খ্রীঃ সাব জজ হরিকিষেণ এবং ১৮ই মার্চ ১৮৮৬ খ্রীঃ জেলা জজ কর্ণেল F. E. A. Chamier অযোধ্যায় মামলার পরিদর্শনে গেলে তখনও পর্যন্ত কোন শিলালিপির উল্লেখ করেন নি। বিভিন্ন প্রমাণ অনুযায়ী মনে করা হচ্ছে যে মসজিদ নির্মাণের কমপক্ষে বহু শতাব্দী পরে এই শিলালিপি প্রক্ষেপ করা হয় এবং বার বার পরিবর্তিত হয়।

সোফিয়া মসজিদ আগে চার্চ ছিল। হাজার বছরের পুরনো চার্চ ভেঙে ফেলা হলো অথচ কোন লিবারেল প্রশ্ন করল না। ধর্মনিরপেক্ষতার গুনগুন গান বাজলো না। কিন্তু যখন উল্টোটা হয় তখন এরা তারস্বরে চিৎকার করতে শুরু করে। নিজেদের দেশগুলো যেখানে তারা সংখ্যাগুরু সেখানে আইন তাদের মর্জিতে চলে। আবার অন্য দেশে যেখানে তারা সংখ্যালঘু সেখানে সংখ্যাগুরুর অনুভূতি মত কিছু হলে তাকে ভিকটিম কার্ড হিসেবে খেলা ছাড়া উপায় থাকে না।

এই টুইটে সরাসরি সুপ্রিমকোর্টের অবমাননা করা হয়েছে। অমান্য করা হয়েছে তার আদেশ। দেড়শ বছরের আইনি লড়াই রীতিমতন জিতে তবেই হিন্দু পক্ষ আজ রাম মন্দির নির্মাণের অধিকার অর্জন করেছে। যে অন্যায় এক বহিরাগত বর্বর সম্রাট করেছিল তার বিপক্ষে রায় দিয়ে ন্যায় হয়েছে। অন্যায় তো হয়েছিল যেদিন তারা হিন্দুদের দেশে এসে হিন্দুদের উপাসনা স্থল ভেঙে, তাকে অপবিত্র করে নিজেদের জয়ধ্বজা উড়িয়ে দিয়েছিল মসজিদ তৈরির নামে। তাদের কাছে ধার্মিক মানে অন্য ধর্মকে আঘাত করা, যারা অবিশ্বাসী তাদের ধ্বংস করা। এদেশে যদি সংখ্যাগুরুর তোষণ হত তবে এতগুলো বছর বৃথা রাম মন্দিরের জন্য হিন্দু পক্ষকে কঠিন লড়াই করতে হতো না। শয়ে শয়ে লোক বলিদান হতো না। খুব সহজেই রাম মন্দির নির্মাণ হয়ে যেত। এখনো পর্যন্ত কৃষ্ণের জন্মস্থানকে হিন্দু পক্ষ উদ্ধার করতে পারে নি। যদি সংখ্যাগুরু তোষণ করাই রাষ্ট্রের কাজ হতো তবে কাশী, বেনারসে মন্দিরের জায়গায় মসজিদ থাকত না। কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরের উপর জ্ঞানবাপী মসজিদ থাকত না। সবগুলো অন্যায় দখলদারদের সরিয়ে পুরনো মন্দির নির্মাণ হত। ভারতীয় বিচারব্যবস্থা সম্পূর্ণ স্বাধীন। কোনরকম প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ঊর্ধ্বে। রাম মন্দিরের জন্য দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছে ‘রাম লালা বিরাজমান‘ এর পক্ষে। সে ক্ষেত্রে এই বক্তব্যকে অন্যায় বলা সরাসরি সুপ্রিম কোর্টের অবমাননা।

অযোধ্যায় কোন জমি দখল হয় নি। দখল হওয়া জমি পুনরায় হস্তান্তর হয়েছে মাত্র। যে জমি ঐতিহ্য, পরম্পরা বিশ্বাস সব দিয়ে রামের জন্য নিবেদিত ছিল, তা কেড়ে নিয়েছিল বিদেশি আক্রমনকারী বাবর। মুসলিম সমাজকে ‘মুসলিম ল বোর্ড’ যেভাবে প্ররোচিত করছে তাতে পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হতেই পারে। এরা স্বাধীনতার পর থেকে সংখ্যালঘু স্ট্যাটাসের নামে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা, ওয়াকফ বোর্ড, মুসলিম পার্সোনাল ল ভোগ করছে। সংখ্যালঘু কারা সেটা নিয়েও ধন্ধ। মে সব জেলায় হিন্দুরা সংখ্যালঘু সেখানে কিন্তু তারা সেই সুবিধা ভোগ করতে পারে না। এই দেশে জনসংখ্যা অনুপাতে সংখ্যালঘু নির্বাচন আশু প্রয়োজন। শুধু মাত্র একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায় সংবিধানের দোহাই দিয়ে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা ভোগ করবে আবার অন্যের বিষয়ে দখল দেবে, দুটো এক সাথে চলতে পারে না।

দুর্ভাগ্যের বিষয় এদের কাছে সবার উপরে ধর্ম। দেশ, জাতি, অন্যের ধর্মীয় অনুভূতির কোন মূল্য নেই। এদের কাছে রাষ্ট্রপতির মূল্য নেই, প্রধানমন্ত্রীর মূল্য নেই বিচারব্যবস্থার মূল্য নেই, বিচারপতির মূল্য নেই, সেনাবাহিনীর মূল্য নেই, সাধারণ মানুষের অনুভূতির মূল্য নেই। আছে শুধু রাজনীতি ও স্বার্থান্বেষী। যদিও এটা রাজনৈতিক কারণ নয় সংস্কারগত আচার এখানে প্রধান। হিন্দু কোন মতবাদ নয়, কোটি কোটি মানুষের সংস্কৃতি, আচার আচরণ। ধর্ম পালনের মৌলিক অধিকার সংবিধান স্বীকৃত, সেটা সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরু দুই সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে সমান ভাবে প্রযোজ্য। আজকের ভারত অন্য ভারত, নতুন ভারত যার কাছে ধর্মীয় পরিচয় ব্রাত্য নয়। রাম হিন্দুদের আবেগ। সেই আবেগের জন্য অনেক রক্তপাত হয়েছে। যে ভারত এক সময় অসহায় হয়ে বর্বর আক্রমণের কাছে পরাজিত হয়েছিল আজ তা উদ্ধার করতে পেরেছে। সেই লড়াই সহজ ছিল না। কেউ হিন্দুদের হাতে এক বিন্দু জমি দয়া করে দান করে নি, প্রমাণ সহযোগে পুনরুদ্ধার করেছে মাত্র। এই ভারত এক ভারত শ্রেষ্ঠ ভারত। এখানে হিন্দু বিদ্বেষের কোন স্থান নেই।

দেবযানী হালদার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.