জিডিপি ও ভারতীয় অর্থনীতি : কতটা সত্যি আর কতটা দুশ্চিন্তার

করোনা কালে সারা পৃথিবীর মানুষই ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন অন্য সময়ের অনেক বেশি। ইন্টারনেট তথ্যের মুক্তাঙ্গন। কিন্তু সেই তথ্য সত্যি না মিথ্যে, তার দায়ভার কেউ নেয় না। তাই অর্ধেক অস্পষ্ট জমানায় অনেকেই এই কয়েক মাসে ইলেকট্রিক গ্রিড স্পেশালিস্ট, ইমিউনিটি বাড়ানোর ডাক্তার কিম্বা সুশান্ত মৃত্যুর ( না হত্যার?)পর ক্ষণিকের সাইকোলজিস্ট হয়েছেন। কিন্তু এই ডিজিট্যাল সার্কাস বোধহয় একটি লেভেলে পৌঁছে গেছে জিডিপি নিয়ে আলোচনায়। যারা জীবনে অর্থনীতির ধারে পাশে হাঁটেননি, শুধু অর্থের কাছে গেছেন বা যাওয়ার চেষ্টা করেছেন, তারাও মতামত দিচ্ছেন। কিন্তু সব সমালোচনা কি অমূলক? এই চলতি অর্থবর্ষের প্রথম চার মাসের -২৩.৯% জিডিপি (GDP) কি আদেও হেলাফেলা করা যায়?

করোনা ভাইরাস চিন বাদ দিয়ে সমস্ত দেশের সিলেবাসের বাইরে, এই নিয়ে সত্যি কোন তর্ক নেই। শুরুতে হু কেন, কোনও রাষ্ট্রনেতা ভাবেননি যে এই মারণ করোনা ভাইরাস এইভাবে দৈনন্দিন জীবনের গতিকে রুদ্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু যতটা আন্দাজ করা গিয়েছিল, তার চেয়েও বেশি। পরিস্থিতি এতটাই সঙ্গীন যে খাস নিউইয়র্ক থেকে জারোয়াদের আন্দামান, কোভিড-১৯ ঘুম কেড়ে নিয়েছে সব দেশের। তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নতিশীল দেশ হিসেবে ভারতেও দীর্ঘদিন সমস্ত কর্মকান্ড বন্ধ ছিল। অসংগঠিত ক্ষেত্র ধুঁকছে, হাজার হাজার মানুষ কাজ হারিয়েছেন, বিদেশ থেকে কাজ হারিয়ে অনেক অসহায় ভারতীয় ফিরেছেন, শহর থেকে গ্রামের দিকে পা বাড়িয়েছেন অজস্র মানুষের মধ্যে বিশ্বমারীর দায়িত্ব বেশি, সরকারি গাফিলতি কম। সামাজিক সুরক্ষার দিকটি উঠে আসে ঠিকই কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় শুধু একটি দল বা সরকারকে দোষ দেওয়া বাস্তবিক নয়। কিন্তু জিডিপি নিয়ে সবাই চিন্তিত। সংখ্যাতত্বের দিক থেকে চিন্তা হওয়ারই কথা। কিন্তু জিডিপি কি? কিভাবে মাপা হয়ে থাকে? কি ধারণা করা যায় আর কতটা ধারণা করা যায়?

জিডিপি (GDP) র সাবেকি অর্থ Gross Domestic Product, অর্থাৎ যা কোনও সময়কালের মধ্যে দেশীয় পণ্যের উৎপাদন বা সার্বিক ব্যবসা বোঝায়। অবশ্য এর মধ্যে শুধু দেশীয় কোম্পানি নয়, বিদেশি সংস্থার লগ্নি করা কোম্পানির দিকটিও বোঝায়। দেশের গণ্ডির মধ্যে যা তৈরি হচ্ছে, তাই জিডিপির অন্তর্গত। সাধারণ ভাবে জিডিপি তিনভাবে মাপা যেতে পারে, একটি খরচের মাধ্যমে (Expenditure Method), একটি রোজগার (Income Method) এবং আরেকটি উৎপাদনের (Production Method) মাপকাঠির উপর। যেভাবেই দেখা হোক না কেন, গাণিতিক সংখ্যা একই আসা উচিত। ভারত যেইভাবে জিডিপির গণনা করে থাকে, সেখানে আটটি সেক্টর খুবই গুরুত্বপূর্ণ – কৃষি, বনজ, মৎস্য, খনন, উৎপাদন, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জলের জোগান, নির্মাণ, ব্যবসা, হোটেল, পরিবহন ও যোগাযোগ, অর্থ, বীমা, আবাসন এবং সম্প্রদায়, সামাজিক এবং ব্যক্তিগত পরিষেবা। বলাই বাহুল্য, হাতে গোনা কয়েকটি ক্ষেত্র বাদ দিলে, লকডাউন পর্বে ভারতের বেশিরভাগ শিল্প ক্ষেত্র স্তব্ধ ছিল। ভারত আমেরিকার মত ব্যবসা খুলে রাখার পক্ষপাতী ছিল না, কারণ খুবই স্পষ্ট। হার্ড ইমিউনিটির লক্ষ্য নিয়ে সবাইকে আক্রান্ত হওয়ার দিকে ঠেকে দেওয়া বিপজ্জনক এবং দেশের মানুষের জীবন সবচেয়ে দামী। দ্বিতীয়ত, ভারতের হাতে ১৪০ কোটি মানুষকে খাদ্য তুলে দেওয়ার শস্যভাণ্ডার মজুত রয়েছে।

ভুলে গেলে চলবে না এই ২৩.৯% এর হিসেব কিন্তু বার্ষিক হিসেব নয়। পুরো একটি অর্থবর্ষের হিসেব পেলে কোনও সিদ্ধান্তে আসা সহজ হবে। বলাই বাহুল্য, প্রথম বিশ্বের অনেকগুলো দেশের চেয়ে কিন্তু আমাদের উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গের মত রাজ্যে অনেক বেশি বসবাস করেন। তাই তুলনামূলক আলোচনা করার সময়ে বিজ্ঞান ভিত্তিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। ইতিমধ্যেই ভারতের বাজার ধীরে ধীরে খুলছে এবং ভ্যাকসিন পরবর্তী সময়ে এর উন্নতি হওয়া স্বাভাবিক। গাণিতিক মডেল অনুযায়ী এখনও ভারত করোনা র ক্ষেত্রে ‘peak’ পৌঁছয়নি। তাই অযথা জিডিপি-র দোহাই দিয়ে মানুষের জীবন বিপর্যস্ত করার মধ্যে সত্যি কোন দেশভক্তি নেই। পাশের দেশ কিন্তু দেশের মধ্যে অসন্তোষ সামলাতে না পেরে বরফের মধ্যে লাল ফৌজ নামিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে। তাই ভারতের অর্থনীতি নিয়ে শেষকথা বলার কিন্তু অনেক বাকি। হাজার বছরের অর্থনীতিক ঐতিহ্য নিয়ে এগিয়ে চলা ভারতের অর্থনীতি ঠিক করোনা সামলে নেবে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.