আনন্দমঠ’ এর চরিত্র তৈরি করেছিল বাস্তবের বিপ্লবীকে

একজন সাহিত্যিক কল্পনা আর বাস্তবের মিশ্রণে চরিত্র নির্মাণ করেন। চরিত্রের নিখুঁত চিত্রায়ণ পাঠকের মনে দাগ কাটে। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের অনন্যতা এই কারণে যে তাঁর উপন্যাসের চরিত্রের প্রভাব শুধু সাহিত্যের জগতেই সীমাবদ্ধ থাকে নি , ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিপ্লবী কর্মকান্ড ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপে তার সুস্পষ্ট প্রভাব বিতর্কের উর্ধ্বে।
অরবিন্দ ১৪ বছর পর দেশে ফিরলেন ১৮৯৩ সালে আর বঙ্কিমচন্দ্রের পরলোকগমন ১৮৯৪ সালে। সেইসময় অরবিন্দ বাংলা শিখছেন আর পড়ছেন বঙ্কিমচন্দ্রের একের পর এক উপন্যাস।বলাই বাহুল্য তাঁর উপরে সবথেকে বেশি প্রভাব পড়েছিল ‘আনন্দমঠ’-এর।
বঙ্কিমচন্দ্রের তিরোধানের ৩ মাস পর থেকে ‘ইন্দুপ্রকাশ’ পত্রিকায় অরবিন্দ ঘোষ ( সেই সময়ে বিপ্লবী আর তারও পরে ঋষি অরবিন্দ হতে অনেক বাকি) পরপর সাতটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন।
বঙ্কিমচন্দ্র কে সাহিত্যের সমস্ত গুণাবলীর নিরিখে ইংরেজি সাহিত্যিকদের থেকে এগিয়ে রেখেছেন অরবিন্দ। বঙ্কিমচন্দ্রের চাকুরী জীবন, তাঁর সমকালীন বাংলা, তাঁর সাহিত্য প্রতিভা আর সর্বোপরি ভবিষ্যতের ‘মূলধন’ হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যের দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
অন্তঃত অরবিন্দ নিজের মূলধন পেয়ে গিয়েছিলেন।
১৯০৮ সালের ২রা মে ‘আলিপুর বোমা মামলা’য় অভিযুক্ত ও বন্দী হওয়ার প্রায় তিনমাস আগে ,
১৯০৮ সালের ২৯শে জানুয়ারি রাজনীতিক অরবিন্দ ঘোষ ভবিষ্যৎবাণী করছেন ‘বন্দেমাতরম্’কে নিয়ে —–
The song, he said, was not only a National anthem as the European nations looked upon their own, but one replete with mighty power, being a sacred ‘mantra’ revealed to us by the author of “Ananda math” who might be called an inspired “Rishi”… The “mantra” of Bankim Chandra was not appreciated in his own day, and he predicted that there would come a time when the whole of India would resound with the singing of the song, and the word of the prophet was miraculously fulfilled.
১৯১২ সালে অরবিন্দ লিখছেন — “বত্রিশ বছর আগে বঙ্কিম তাঁর দুর্দান্ত গান লিখেছিলেন এবং খুব কম লোকই শুনেছিলেন; কিন্তু দীর্ঘ বিভ্রান্তি থেকে জাগ্রত হওয়ার আকস্মিক আন্দোলনে বাংলার মানুষ সত্যের দিকে তাকিয়েছিল এবং এক অদৃষ্ট মুহূর্তে কেউ একজন বন্দে মাতরম গেয়েছিল। মন্ত্র দেওয়া হয়েছিল এবং একদিনে সমগ্র মানুষকে দেশপ্রেমের ধর্মে দীক্ষিত করা হয়েছিল।”
প্রসঙ্গত ‘বন্দেমাতম্’ যেন ভারতের প্রাণভোমরা। ‘বন্দেমাতরম্’ গাইবার বিরুদ্ধে মুসলিম লীগের চাপকে মেনে নিয়েই জাতীয় কংগ্রেস ভারত বিভাজনের সামনে নতিস্বীকার করে।
১৯০৯ সালের ৬মে কারামুক্তির সাড়ে তিনমাস পর শ্রী অরবিন্দ ‘আনন্দমঠ’এর ইংরেজি অনুবাদ শুরু করেন। কারামুক্তির পর যখন তিনি আর আগের মতো উৎসাহ দেখতে পাচ্ছেন না সেইসময় বিপ্লবীদের মন্ত্রকে একসময়ের তাঁরই মতো ভারতীয় ভাষায় অপটু ভারতীয়দের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যই হয়তো আনন্দমঠের ইংরেজি অনুবাদ শুরু করেন যাতে করে ইংরেজিয়ানা ছেড়ে বিপ্লবীতে রূপান্তরিত হওয়ার মাঝে ভাষার ব্যবধান না থাকে।
কিন্তু আনন্দমঠের অনুবাদের আগে তাকে বাস্তবায়ন করার কাজ আগেই করেছিলেন শ্রী অরবিন্দ।
আনন্দমঠের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই তিনি বিপ্লবী কর্মকান্ডের পরিচালনার জন্য ‘ভবানি মন্দির’ নামে ছোট পুস্তিকা লেখেন। এই কথা স্বীকার করেছেন স্বয়ং তাঁর ছোটো ভাই অনুশীলন সমিতির সদস্য বারীণ ঘোষ। অরবিন্দ আনন্দমঠের অনুরূপ ভবানী মন্দির নামক আশ্রমের কল্পনা করেন এবং ‘ভবানী মন্দির’ পুস্তকে শক্তি উপাসনার মাধ্যমে ভারতবাসী কে রজোগুণের বিকাশের আহ্বান জানিয়েছিলেন।ব্রক্ষ্মচর্য ব্রত নিয়ে বিশ্বজননী ভবানীর পূজা দ্বারা কী করে স্বাধীনতা লাভ করতে হবে , শ্রীঅরবিন্দ এই পুস্তকে তা দেখিয়েছেন।


‘ভবানী মন্দির’ এ লেখেন—-
আহ্বান পাঠাও তবে
যেথা যত আছ সনাতন
ভারত-সন্তান
মা ভৈঃ মন্ত্রে জাগো সংগ্ৰামের সাজে।
কোথা ধনু খড়্ গ তব ?চিরঞ্জয় জাগো
জাগো সুপ্তসিংহ জাগো
জননী জাগ্ৰতা ।। (৩১) (অনূদিত)
বাংলার বিপ্লবী সংগঠনগুলির লক্ষ্য ও কর্মপন্থা যে ‘ভবানী মন্দির’ এর আদলে চলছে আর ‘ভবানী মন্দির’ যে আনন্দমঠ দ্বারা অনুপ্রাণিত সে কথা ‘রাউলাট কমিটি’র রিপোর্টে পাওয়া যায় — সেই সময় ‘ভবানি মন্দির’ এর লেখকের পরিচয় অজ্ঞাত ছিল।১৭৭৪ সালের সন্ন্যাসী বিদ্রোহের পটভূমিতে রচিত আনন্দমঠ বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের ভিত্তিভূমি রচনা করেছিল। ১৮৯৪ সালে অরবিন্দ বঙ্কিমচন্দ্র কে এক ত্রুটিহীন শিল্পী হিসেবে দেখছেন আর ১৯০৭ সালে এসে ‘রাজনৈতিক গুরু’ হিসেবে বঙ্কিমপ্রতিভার এমন দিক তিনি ‘আবিষ্কার’ করলেন যার প্রভাব সন্দেহের ঊর্ধ্বে।
অরবিন্দ ‘আনন্দমঠ’ কে বাস্তবের মাটিতে নিয়ে এসে বিপ্লবী সন্ন্যাসীদের গুরু সত্যানন্দ হতে চেয়েছিলেন আর সত্যিই তিনি যে তা হয়েওছিলেন তাঁর প্রমাণ রেখে গেছে কিছু নাম —- ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকী,হেমচন্দ্র কানুনগো, কানাইলাল দত্ত , বারীণ ঘোষ।

পিন্টু সান্যাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.